কোন অমুসলিমের প্রশংসা করার সময় আমরা তার চরিত্র বা কাজের ঐ দিকগুলোতে ফোকাস করি যেগুলো ইসলামের শিক্ষার সাথে মেলে। যেমন অনেক অমুসলিম ব্যক্তি উদ্যোগে নিস্বার্থভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গাতে চ্যারিটি বা মানবিক সেবামূলক কাজ করে থাকে। এটা নিঃসন্দেহে তাদের ভালো দিক।

এ ধরনের কাজের প্রশংসা করার সময় আমরা সেগুলোকে ব্যাখ্যা করি সাদাকা, সৃষ্টির হক, রাহমাহর মতো কনসেপ্টগুলো দিয়ে। ভালোর যে চূড়ান্ত মাপকাঠি আমাদের কাছে আছে, সেটা দিয়েই আমরা তাদের ভালো দিকটাকে উপস্থাপন করি। আর এটাই স্বাভাবিক।

একই কাজ সেক্যুলাররাও করে। সেক্যুলার ফ্রেইমওয়ার্কের বাইরে ‘ভালো’- এর কোন ধারণা তাদের কাছে নেই। কোন কিছুকে ‘ভালো’ হিসেবে উপস্থাপন করতে হলে সেটাকে তারা সেক্যুলার ছাঁচে ফেলতে বাধ্য। সবাই ‘ভালো’-কে বোঝে এবং ব্যাখ্যা করে তার নিজ নিজ দ্বীন, এবং প্যারাডাইমের সাপেক্ষে।একটা উদাহরণ দেখা যাক।

মীর নীসার আলী তিতুমীর রাহিমাহুল্লাহ এর আন্দোলন নিয়ে সেক্যুলারদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রচলিত আছে। সমালোচনাকারীরা এ আন্দোলনকে তারা চিত্রিত করতে চেয়েছে ‘হিন্দুবিদ্বেষী’, ‘সাম্প্রদায়িক’, ‘ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিকারী’, ‘কট্টর’-ইত্যাদি হিসেবে।

অন্যদিকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা সেক্যুলারদের কেউ কেউ আন্দোলনের মধ্যে খুঁজে বের করেছেন ‘শ্রেনী সংগ্রাম’-এর বৈশিষ্ট্য। কেউ একে দেখাতে চেয়েছেন সাব-অল্টার্নের প্রতিরোধ হিসেবে। আবার অনেকেই একে ফেলেছেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের কাতারে।

এ ব্যাখ্যাগুলোর সবগুলোই যে পুরোপুরি ভুল, তা না। কিন্তু লক্ষনীয় বিষয় হল এ ধরনের ক্যাটাগরাইযেইশানে ব্যবহার করা শব্দগুলো মূলত ‘ভালো’ এবং ‘খারাপ’ এর প্রতিশব্দ।

‘হিন্দুবিদ্বেষী’, ‘সাম্প্রদায়িক’, ‘ধর্মীয় উন্মাদনা’ – মানে হল খারাপ।

‘শ্রেনী সংগ্রাম’, 'সাব-অল্টার্নের প্রতিরোধ', 'স্বাধীনতা আন্দোলন'–মানে ভালো।

আর ভালোমন্দের এই নির্দিষ্ট ধারণা আসছে লিবারেল-সেক্যুলার ফ্রেইমওয়ার্ক থেকে।

তিতুমীরের আন্দোলনকে একজন সেক্যুলার ভালো-খারাপ যাই মনে করুক, সেটা সে প্রকাশ করবে সেক্যুলার ছাঁচের মধ্যে ফেলে। এবং এই কাজটা করতে গিয়ে তিতুমীরের আন্দোলনকে বুঝে কিংবা না বুঝে সে সেক্যুলারাইয করবে।

মীর নিসার আলী তিতুমীর ছিলেন সৈয়দ আহমাদ শহীদ রাহিমাহুল্লাহ এর মুরিদ, একজন আলিম এবং একটি জামাআতের নেতা। তাঁর আন্দোলন শুরু হয় মুসলিমদের আদি ও অবিকৃত ইসলামের দিকে আহবান করা দিয়ে। এতে ছিল মুসলিম সমাজে উপমহাদেশের শিরকি ধর্মগুলোর প্রভাবে ঢুকে পড়া শিরক ও বিদআহ দূর করার প্রকল্প।

অন্যান্য তাজদীদি আন্দোলনের মতোই ছিল মুসলিম পরিচয় এবং ইসলামী আদর্শকে জীবনের কেন্দ্র বানানোর দাওয়াহ। পরে এ আন্দোলনে যুক্ত হয় মুসলিম সমাজের বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুও। এক পর্যায়ে এটি সশস্ত্র রূপ নেয়। ইসলামী ইতিহাসের অনেক তাজদীদি আন্দোলনের ক্ষেত্রে একই ধরনের গতিপথ দেখা যায়।

হিন্দুবিদ্বেষ কিংবা সাম্প্রদায়িকতা থেকে এই আন্দোলন তৈরি হয়নি। আবার এ আন্দোলনের আদর্শ শ্রেনী সংগ্রাম, সাব-অল্টার্নের প্রতিরোধ জাতীয় কিছুও ছিল না। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ আন্দোলনের ভিত্তি ছিল ইসলাম। এর উদ্দেশ্য এবং আদর্শ সবই এসেছিল ইসলাম থেকে।

সশস্ত্র ইসলামী আন্দোলনের জন্য ইসলামী শরীয়াহতে যে শব্দটা ব্যবহার হয়, তিতুমীর রাহিমাহুল্লাহ সেই শব্দই তখন ব্যবহার করেছেন। স্বাধীনতার কথা বলেননি। নারিকেলবাড়িয়াতে কর্তৃত্ব অর্জনের পর শাসক হিসেবে তিনি ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী শাসনেরও চেষ্টা করেছেন।

কোন ইসলামী আন্দোলনই কেবল লড়াই করার জন্য হয় না। সেখানে তাওহিদ ও ঈমানের দাওয়াহ, ইসলাহ, আদল, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করাসহ থাকে বিভিন্ন জিনিস। শুধু মুসলিম না, সমাজের সব ধরনের মানুষের কল্যাণের দিকও থাকে। এটাই ইসলামের সৌন্দর্য। ইসলাম থাকলে এগুলোও থাকবে।

কিন্তু এ আন্দোলনের মৌলিক ইসলামী চরিত্র ও উৎস বাদ দিয়ে সেটাকে সেক্যুলার কোন ক্যাটাগরি দিয়ে উপস্থাপন করা হলে, ঢাকা পড়ে যায় এর মূল শিক্ষা ও আদর্শ। এটা অনেকটা আফগ।নের গত বিশ বছরের ইতিহাসকে ‘মুক্তিযুদ্ধ’, বা ফিলিস্তিনের ইস্যুকে স্বাধিকারের ইস্যু বলার মতো। টেকনিকালি কথাগুলো শতভাগ ভুল না। কিন্তু আন্দোলনগুলোর মৌলিক চরিত্রকে এখানে বদলে ফেলা হচ্ছে।

এধরণের ক্যাটাগরাইযেইশান বা ব্যাখ্যা এই আন্দোলনগুলোর ইসলামী চরিত্রকে আড়াল করে। এগুলোর শিক্ষাকে মুসলিমদের সামনে করে তোলে অস্পষ্ট। সেক্যুলাররা হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবেই এটা করে। কারণ কোন কিছু ‘ভালো’ বলতে হলে তারা সেক্যুলার কাঠামোর ভেতর থেকেই সেটা বলবে। কিন্তু এধরনের ক্যাটাগরাইযেইশানের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার।

তাছাড়া ‘হিন্দুবিদ্বেষ’, ‘সাম্প্রদায়িকতা’, কিংবা ‘ধর্মীয় উন্মাদনা’র মতো পরিভাষাগুলোর সংজ্ঞায়নও আমরা নিয়ন্ত্রন করি না। এগুলো সীমানা বদলে যেতে পারে যেকোন সময়। হিন্দুয়ানি বলে মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন শিরক ও বিদআহ নির্মূল করার চেষ্টাকে অনেকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলতে পারে। ইসলামী শরীয়।হ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটাকে বলতে পারে ধর্মীয় উন্মাদনা।

তখন কি আমরা অসাম্প্রদায়িক প্রমানে এ তিতুমীরের আন্দোলনের এ দিকগুলো অস্বীকার করবো? বা চেষ্টা করবো নতুন কোন ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ ব্যাখ্যা দেয়ার?

এটা একটা লুসিং গেইম।

এভাবে ক্রমাগত আমাদের নিজেদের আদর্শ ও ইতিহাসকে নতুন করে ব্যাখ্যা করতে হবে, তাও আবার অন্যের ঠিক করে দেয়া প্যারামিটার অনুযায়ী।

আমাদের ইতিহাস, আমাদের আদর্শকে অন্যের তৈরি ছকের মধ্যে ফেলে বোঝার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। বরং এটা করতে গেলে নিজেদের অজান্তেই নিজেদের ঐতিহ্যের এক ধরনের সেক্যুলারায়ন আমরা করে বসবো।

শহীদ তিতুমীরের আন্দোলন একটা তাজদীদি আন্দোলন ছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ওপর ফিরিয়ে আনা, প্রচলিত শিরক ও বিদআহ দূর করা, মুসলিম ও অমুসলিম ওপর চালানো যুলুম বন্ধ করা, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং ইসলামী শরীয়।হ প্রতিষ্ঠা।

ব্যাখ্যা হিসেবে এটা যথেষ্ট। আর এটা সরাসরি স্বীকার করতে না পারা, গর্ব করে প্রচার করতে না পারা মুসলিম হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা। এবং একধরনের চিন্তার দাসত্ব।