সব ধর্মের কিছু না কিছু সুনির্দিষ্ট আকীদাহ, বিশ্বাস, সৃষ্টিতত্ত্ব, আর পবিত্রতার ধারণা থাকে। থাকে ধর্মীয় প্রতীক।

জাতীয়তাবাদেরও আছে।

জাতীয়তাবাদের ধর্মের পবিত্র প্রতীক পতাকা নিয়ে তো অনেক আলোচনা আছেই। পতাকা ছাড়া আরো আছে রাষ্ট্রীয় ইনসিগনিয়া। আছে জাতীয় সঙ্গীত নামে পবিত্র শ্লোক আর স্তোত্রও। এ সঙ্গীত প্রচারিত হলে দাড়াতে হয়। প্রকাশ করতে হয় সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভক্তি।

ধর্মের মতোই জাতীয়তাবাদেরও আছে সৃষ্টিতত্ত্ব। দূর কিংবা নিকট অতীতের কোন যুদ্ধ, বিপ্লব কিংবা আন্দোলন। ইতিহাসের এমন এক মাহেন্দ্রক্ষণ যখন জন্ম নিয়েছিল সেই রাষ্ট্র এবং জাতি। মহান কোন আত্মত্যাগের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিল মহিমান্বিত, চিরন্তন, ধ্রুব কোন চেতনা, উদ্দেশ্য কিংবা বিশ্বাস নিয়ে।

এই সৃষ্টিতত্ত্ব প্রশ্নের উর্ধে। যুক্তি, তর্ক, সন্দেহের উর্ধে। এমনকি ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ এবং সংশোধনেরও আওতার বাইরে।

অন্য ধর্মগুলোর মতো জাতীয়তাবাদও অনুসারী বিবেক, বুদ্ধি, কল্পনা-সব কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রন জারি করে।

বুদ্ধির দ্বারা জাতি ও রাষ্ট্রের এক সৃষ্টিতত্ত্ব কিংবা মিথ তৈরি হয়। কল্পজগতে তৈরি হয় জাতীয়তার চিরন্তন অতীত আর চিরস্থায়ী ভবিষ্যতের গায়েবী জগত। আবেগের রাজ্য নির্মিত হয় রাষ্ট্র নামক ইলাহর প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, ভক্তি, বিস্ময়, আনুগত্য এবং তাকে অসন্তুষ্ট করার তীব্র, প্রায় অবশ করা ভয়।

এই সৃষ্টিতত্ত্বই ঠিক করে দেয় সেই রাষ্ট্র এবং জাতির পবিত্র মিশন। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কেবল অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়ন না। বরং আরও বেশি কিছু। আরও গভীর, আরো শুদ্ধ কিছু। হয়তো কোন চেতনা, স্বপ্ন, অথবা স্রষ্টাপ্রদত্ত পবিত্র কোন কর্তব্য। সব প্রতিকূলতা সব বিপর্যয় পেরিয়ে রাষ্ট্র এবং জাতিকে এগিয়ে চলতে হয় সেই পবিত্র উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে। এটাই তার চিরন্তন নিয়তি। তার গন্তব্যে।

নাৎসিরা বিশ্বাস করতো থার্ড রাইখে – তৃতীয় সাম্রাজ্য। যা টিকে থাকবে হাজার বছর। আনবে নীল রক্তের আর্য জাতির বিজয়ের সহস্রাব্দ।

ফরাসী বিপ্লবীরা বিশ্বাস করতো বাকি ইউরোপের কাছে সাম্য, মুক্তি স্বাধীনতার পবিত্র শিক্ষা পৌছে দেয়া ফরাসী প্রজাতন্ত্রের পবিত্র দায়িত্ব।

অ্যামেরিকানরা বিশ্বাস করে পুরো বিশ্বের কাছে স্বাধীনতা, পুঁজিবাদ আর গণতন্ত্রের আলো পৌছে দেয়া তাদের কর্তব্য।

বিজেপি এবং আরএসএস মনে করে পুরো ভারতবর্ষকে একত্রিত করে অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করা তাদের অদৃষ্ট। ছোটখাটো দেশগুলোর অতো বড় বড় উদ্দেশ্য থাকে না। কিন্তু তারাও কোন জাতীয় পয়গম্বরের স্বপ্ন অথবা সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে জড়িত পবিত্র কোন চেতনা বাস্তবায়নে এগিয়ে চলে।

জাতীয়তাবাদী চিন্তক ও বুদ্ধিজীবিরা বিশাল বিশাল ভলিউম লেখেন দেশের ইতিহাস, জন্ম এবং বিকাশ নিয়ে। উপস্থাপন করেন সুক্ষাতিসুক্ষ বিশ্লেষণ। আপাত ক্ষুদ্র কোন ঘটনা থেকে তাফসীর করে বের করে নিয়ে আসেন গভীর শিক্ষা।

গুরুগম্ভীর, জটিল সেই বিশ্লেষণগুলো সহজ করে তুলে ধরা হয় পাঠ্যবই, পাঠচক্র, পত্রিকার পাতা কিংবা প্রবন্ধে।

তারপর শিল্প, সাহিত্য, টিভি-সিনেমা, কনসার্ট-কবিতা, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে তার অতি সরলীকৃত, অনেক সময় স্থুল চিত্রায়ণ পেশ করা হয় জনসাধারণের বোধগম্য করে।

বিশেষজ্ঞদের ইলমী বিশ্লেষণগুলো এভাবে আম জনতাকে গুলিয়ে খাওয়ানো হয় ডিজিটাল ওয়াজের মঞ্চের হাসিঠাট্টা আর হাকডাকের মাধ্যমে। বুদ্ধিজীবিদের তৈরি জাতীয়তাবাদী ধর্মতত্ত্ব এভাবে পরিণত হয় আম জনতার জন্য জাতীয়তাবাদী পুরাণশাস্ত্রে।

অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের মতো এ ধর্মের অনুসারীরাও ইবাদত করে প্রকাশ্যে ও গোপনে, নির্জনে ও ভীড়ে, একান্তে ও সমষ্টিতে। কারণ জাতীয়তাবাদ আর দশটা ধর্মের মতোই সামাজিক। তবে এর প্রধান ইবাদাতগুলো পালন করতে হয় বিশেষ কিছু দিনক্ষণ মিলিয়ে। সকলের সাথে মিলে, সকলের কল্যানে।

ধর্মের মতো জাতীয়তাবাদের আছে পবিত্র দিবস, বাৎসরিক ঈদ-উৎসবের দিন। জাতীয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বিপ্লব দিবস আরো কতো কি!

এই উৎসবগুলো যুক্ত রাষ্ট্র ও জাতির পৌরাণিক অতীত, মহান কোন বিজয় অথবা পরম কোন আত্মত্যাগের সাথে।

ঈদের দিনগুলোর আছে নিজস্ব আচার ও অনুষ্ঠান; রিচুয়াল। এক মিনিট নীরবতা পালন, শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন, বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা, প্রভাতফেরি, শোভাযাত্রা, সমবেত স্তোত্র। জামাআতবদ্ধ ইবাদাত। এগুলোর পালন অনুসারীদের মনে তৈরি করে গভীর ও সামষ্টিক আবেগ।

ইবাদাত শেষে সবাই একসাথে আনন্দ করে। রোমন্থন করে অতীতের স্মৃতি। উৎসবের দিন শেষ হয় শোককে শক্তিতে পরিণত করা, মহান কোন চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া, পবিত্র কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের আরোও পবিত্র কোন স্বপ্ন বাস্তবায়নের শপথ কিংবা এজাতীয় কিছু একটা দিয়ে।

ধর্মের মতো জাতীয়তাবাদেরও আছে জাতীয় বীর, ওলি-আউলিয়া, পয়গম্বর। লিঙ্কন, ওয়াশিংটন, বীরশ্রেষ্ঠ, জাতির পিতা। আছে নানা মন্দির ও তীর্থস্থান।

ইন্ডিপেন্ডেন্স হল, ক্রেমলিন, ওয়েস্ট মিনস্টার অ্যাবে, Arc de Triomphe, স্মৃতিসৌধ, ওয়াইট হাউস, শহীদ মিনার, মেমোরিয়াল, স্বাধীনতা স্তম্ভ, ক্যাপিটল বিল্ডিং, বিজয়ের শিখা। পবিত্র সংসদ ও সুপ্রীম কোর্ট।

মাজারের বদলে আছে জাতির পিতা, জাতীয় নেতা কিংবা জাতীয় বীরদের ‘চিরনিদ্রায় শায়িত’ হবার স্থান। প্রতিমার বদলে আছে ভাস্কর্য। ক্রুশ কিংবা স্টার অফ ডেইভিডের বদলে পতাকা, মধ্যযুগীয় কোন খ্রিষ্টীয় সেইন্টের বদলে রুশ্যো, ভলতেয়ার কিংবা অ্যাব্রাহ্যাম লিঙ্কনের আবক্ষ মূর্তি অথবা, কামাল, নাসের, জিন্নাহ, গান্ধীসহ অন্যান্য জাতির পিতা-মাতা-ভাই-বোনদের ছবি।

এই ধর্মে আছে আছে অবমাননাকারীর বিধানও। পবিত্র প্রতীকগুলোর (জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত) অবমাননা করা যায় না। বেফাঁস কিছু বলা যায় না ধর্মের পয়গম্বর কিংবা ওলি-আউলিয়াদের নিয়ে। বললে শাস্তি পেতে হয়। তুরস্কে যেমন ‘তুর্কি জাতির পিতা’ (আতাতুর্ক)-এর সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন না করায় ২১ বছর বয়েসী মেডিক্যাল ছাত্রী এমিনে শাহিন গ্রেফতার হয়েছিল। এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় বাড়ির কাছাকাছিও। পবিত্র ব্যক্তি আর প্রতীকের অসম্মান এ ধর্ম মেনে নেয় না।

জাতীয়তাবাদের ধর্ম সহনশীল। সবার ঈমানের অবস্থা এক রকম হয় না। সবাই একইভাবে আমল করতে পারে না। এ বাস্তবতাগুলো জাতীয়তাবাদে স্বীকার করা হয়। তাই কারো মধ্যে মৌলিক বিশ্বাস আর বাহ্যিক ফরয আমলগুলো পাওয়া গেলেই তাকে বিশ্বাসী হিসেবে গ্রহণ করা হয়। হৃদয়ে তল্লাশী করে প্রত্যেকের ইমানী হালত যাচাই করে না রাষ্ট্র।

তবে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ও বশ্যতা ছাড়া ঈমান থাকে না। অন্যান্য গুনাহখতা মেনে নেয়া গেলেও এধরনের কমতিতে সহ্য করা যায় না। সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধী প্রকাশ্য রাষ্ট্রদ্রোহীরা। ধরতে পারলে তাদের মেরে ফেলা হয় দ্রুততা ও দক্ষতার সাথে।

কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহীতার আভাস পাওয়া গেলেও যাদের ব্যাপারে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না, তাদের ব্যাপারটা গোলমেলে। সরাসরি কিছু করা যায় না, তাই তাদের দেখা হয় নিরন্তর সন্দেহের চোখে। এরা অঘোষিত সেকেন্ড-ক্লাস সিটিযেন। এদের ডাকা হয় দেশবিরোধী, দেশের শত্রু, বিচ্ছিন্নতাবাদী, রাজাকার, জঙ্গি কিংবা অন্য কোন নামে। নিয়মিত বলা হয় দেশকে ভালো না লাগলে দেশান্তরী হতে। সময়ে সময়ে এদের দিতে হয় দেশপ্রেম ও আনুগত্যের পরীক্ষা ও প্রমাণ।

বিশেষভাবে জাতীয় জীবনের সংকটের সময়গুলোতে এদের নিয়ে সুনাগরিকদের মধ্যে কাজ করে নানা ধরনের ভয়ভীতি। উঠে নাশকতা এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। এসব ছুপা রাজাকার কিংবা জাতীয়তাবাদ ধর্মের মুরত।দ।দের সনাক্ত করার জন্য তাদের সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্যগুলো ফলাও করে প্রচার হয় পত্রিকার পাতা, টিভি স্ক্রিন আর সোশ্যাল মিডিয়াতে।

স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে চায় না? শহীদ মিনারে নীরবতা পালন করে না? খেলায় অমুক দেশকে সাপোর্ট করেজাতীয় ঈদের দিন ঈদের পোশাকে জামাআতে যোগ দেয় না?...বেটা নির্ঘাত মুরতাদ!

এতো কিছুর পর, ‘জাতীয়তাবাদ ধর্ম না’ কথাটা খুব একটা জোর গলায় বলা যায় না। ধর্মের যে সংজ্ঞাই নিন না কেন, জাতীয়তাবাদের মধ্যে ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে বিদ্যমান এটুকু স্বীকার করতেই হয়।

কেউ হয়তো আয়োজন করে পতাকার কিংবা দেবতা জ্ঞানে রাষ্ট্রের পূজা করে না। কিন্তু যতোক্ষণ পতাকাকে সমাজে পবিত্র, ভক্তি ও শ্রদ্ধার লক্ষ্যবস্তু গণ্য করা হচ্ছে, ততোক্ষণ পতাকা একটা ধর্মীয় প্রতীক। যতোক্ষণ রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ বিধানদাতা, পরম আনুগত্যের আঁধার এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার মালিক মনে করা হচ্ছে ততোক্ষণ রাষ্ট্র কার্যত ইলাহ। এবং সেই ইলাহর মনোনীত ধর্ম জাতীয়তাবাদ।

1.5KAbu Mus'ab, Ahmed Sadiqur Rahman and 1.5K others28 comments247 sharesLikeCommentShare