[১]
আজকালকার অন্য অনেক কিছুর মতোই ঘটনাটার শুরুটা অনলাইনে। বেশ ক’বছর ধরে এলাকায় চলছে নগরায়ন প্রকল্প। পুরনো বিল্ডিংগুলোর ধ্বংসস্তূপের ওপর দাড়াচ্ছে নতুনগুলো। নানগাং মসজিদের স্থান পরিবর্তনের করার দরকার দেখা দিল। নতুন জায়গা ঠিক করে দিল নগর কর্তৃপক্ষই। বিশাল এক অত্যাধুনিক কন্ডোমিনিয়ামের পাশে। কিন্তু ব্যাপারটা পছন্দ হলো না কন্ডোমিনিয়ামের মধ্যবিত্ত বাসিন্দাদের। চীনের জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েইবুতে শুরু হল ইসলামবিদ্বেষী প্রচারনার ঝড়। প্রতিবাদকারীদের অধিকাংশই হান চাইনিজ। একজন বুদ্ধি দিয়ে বসলেন, নগর কর্তৃপক্ষের কাছে মসজিদ তৈরি বন্ধের দাবি জানানো উচিৎ। এতে কাজ না হলে, শুয়োরের মাথা, শুয়োরের রক্ত! অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পুরলো চারটা শব্দ – শুয়োরের মাথা, শুয়োরের রক্ত! ডিসেম্বর নাগাদ আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়লো মুসল্লিদের মাঝে। ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে অভিযোগ করতে শুরু করলেন অনেকে।
ওরা বলছে মসজিদের সামনে শুয়োরের মাথা ঝুলিয়ে দিবে।
- তাহলে আমরা সরিয়ে দেবো
ওরা বলছে মাটিতে শূকরের মাথা পুতে রাখবে
- আমরা সেটা মাটি খুড়ে তুলে নেব!
২০১৭ এর পহেলা জানুয়ারী ওরা ঠিক তাই করলো। নানগাঙ্গ মসজিদের বাইরে ঝুলিয়ে দেয়া শুয়োরের কাঁটা মাথা, ছেটানো হল রক্ত। মসজিদের সামনের মাটিতে পুতেও রাখা হল কিছু। ইমাম সাহেব নিজ হাতে মাটি খুড়ে মাথাগুলো বের করেছিলেন কি না জানা যায় না। তবে এটুকু জানা যায় যে, পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করার পর, সাংবাদিকদের মাধ্যমে শুয়োরের রক্তওয়ালা মানুষগুলো কাছে শান্তির বার্তা পৌছে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন – ‘আমি চাই তারা জানুক যে মুসলিমরা ভালো মানুষ, ভালো নাগরিক। আমরা শান্তিপ্রিয়, সহনশীল, যৌক্তিক। আমরা ভালো চাইনিয।’ কথাগুলো বলার সময় ইমাম সাহেবের পেছনের দেয়ালে ঝুলছিল, চাইনিয ধর্ম মন্ত্রনালয়ের অফিসারদের সাথে তার হাস্যোজ্জল ছবি।
ঘটনা ২০১৬ এর শেষদিকের। আমরা এখন ২০২০ শুরু করতে যাচ্ছি, চাইনিয কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে বন্দী ২০ লক্ষের বেশি বন্দী মুসলিমের ওজন মাথায় নিয়ে। শান্তিপ্রিয়তা, সহনশীলতা, আর আদর্শ নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেয়া আমাদের ধর্ষিতা বোন, নির্যাতিত ভাই কিংবা বাবা-মা ছাড়া শীতে জমে মারা যাওয়া শিশুদের কোন কাজে আসেনি।
[২]
২০১৯ এর শেষদিকের কথা। চলছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে কোটি কোটি মুসলিমদের অ-নাগরিকে পরিণত করা পায়তারা। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় জেনোসাইডের প্রস্তুতি। প্রতিবাদে উত্তাল ভারত। বিক্ষোভকারী মুসলিমদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে গেরুয়া পুলিশ। নিহতের সংখ্যা ৩০ এর কাছাকাছি। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী সাহরানপুরের দেওবন্দে দাঁড়িয়ে প্রশাসন ও পুলিশকে উদ্দেশ্য করে মাহমুদ মাদানি নামের এক মাওলানা বললেন -
“আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আপনাদের আচরণ দুঃখজনক। যদি আপনারা মনে করেন– আপনাদের কাছে লাঠি আছে, তাহলে শুনে রাখুন, আমাদেরও পিঠ আছে। তোমাদের বন্দুক আছে, আমাদেরও বুক রয়েছে। তোমাদের বন্দুকের গুলি একদিন শেষ হয়ে যাবে; কিন্তু আমাদের বুক শেষ হবে না।”
“শ্রী রামচন্দ্র’ আর গান্ধীজির শিক্ষার ‘বাড়া সামঝদার’ এই ভদ্রলোক আবার ভারতীয় মুসলমানদের বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সেক্রেটারি। পরের দিনের পত্রিকায় খবর আসলো, ‘বিজেপি প্রশাসনকে হুমকি দিলেন মাওলানা মাহমুদ মাদানী’।
কে, কাকে, কীসের হুমকি দিলো তা অবশ্য বোঝা গেল না।
[৩]
নানগাঙ্গ, ২০১৬। সাহরানপুর, ২০১৯। স্থান-কাল বদলে যায়। বদলায় চরিত্রগুলোর নাম। কিন্তু নাটকের স্ক্রিপ্ট পালটায় না। কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়নার জায়গা নেয় বিজেপি-আরএসএস-হিন্দুতভা। চীনা রাষ্ট্রযন্ত্রের জায়গা নেয় ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র। মাটি খুড়ে শুয়োরের মাথা বের করা ইমামের কথার সাথে মিলে যায় বড় বড় বুক-পিঠওয়ালা মাওলানার কথা। এক শান্তিপ্রিয়, সহনশীল, ভালো নাগরিকের চোখেমুখে দেখা যায় অপরের প্রতিচ্ছবি।
অস্ত্রে শান দেয় অপেক্ষমান শত্রু। সতর্ক চোখে বুক আর পিঠের মাপ নেয়। গড়ে ওঠে ক্যাম্প, মিলিশিয়া, প্রপাগ্যান্ডা আর্মি। হিন্দের ভূমির ওপর বিস্তৃত হতে থাকে গাঢ়, কালো ছায়া। কাশগড়ের কান্নার ছাপ দেখা যায় মুযাফফারনগর, দিল্লী আর আসানসোলে। আক্রান্ত মুসলিমদের ঘুম পাড়িয়ে রাখে মাওলানারা। হাস্যোজ্জল মুখে ছবি তোলে শুয়োরের মাথা, শুয়োরের রক্তওয়ালাদের সাথে, গো-পূজারী আর গো-মূত্রপানকারীদের সাথে। তৃপ্ত মনোদেহপ্রাণে ফিরে যায় পার্টি অফিসে, মসজিদে, মাদ্রাসায়, খানকায়। ওরা ভালো মানুষ, ভালো নাগরিক। শান্তিপ্রিয়, সহনশীল, যৌক্তিক।
সম্মান চায়নি, স্বীকৃতি চেয়েছিল ওরা শুধু। আত্মমর্যাদা চায়নি, কেবল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একূল-ওকূল দুটোই গেল। কপালে জুটলো না কোনটাই।
https://facebook.com/AsifAdnan88/posts/2478689095768907
https://web.facebook.com/AsifAdnan88/posts/2526694140968402