নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন ঘটনায় কওমি অঙ্গনের বর্তমান অবস্থান চোখে পড়ার মতো। ফজলে আবেদকে নিয়ে আবেগের আতিশয্য, পতাকা নিয়ে আদিখ্যেতা, গণতন্ত্র নিয়ে মুগ্ধতা, জাতীয় সঙ্গীত, দেশপ্রেম কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাখ্যাবাজি, মুভ নিয়ে মুভমেন্ট, শোকরানা কিংবা শোকপ্রকাশ – এমন উদাহরণ এখন অনেক। এর মধ্যে কিছু কিছু বিষয় দু-একটা নির্দিষ্ট দলের সাথে সম্পর্কিত হলেও, মোটাদাগে পুরো ঘরানার মধ্যেই এখন বিভিন্ন মাত্রায় এ সমস্যাগুলো আছে। এগুলো আসলে বড় একটা সমস্যার উপসর্গ। কিন্তু প্রত্যেকটা ঘটন-অঘটনের আলোচনাগুলো সিম্পটমে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। মূল রোগ নিয়ে কথা হচ্ছে না।

বর্তমান বিশ্বে নিজের স্বকীয়তা এবং আদর্শিক বিশুদ্ধতা টিকিয়ে রাখতে হলে ইসলামী বিভিন্ন ঘরানা ও আন্দোলনগুলোকে কোন না কোন ভাবে পশ্চিমা চিন্তার সাথে একটা বোঝাপড়া করতে হবে। সেই বোঝাপড়ার বিভিন্ন ধরন আছে। কেউ বোঝাপড়া বলতে বোঝেন আপোস, কেউ বোঝাপড়া বলতে বোঝেন মোকাবেলা। কেউ এ দুই অ্যাপ্রোচের বিভিন্ন মিশ্রন তৈরি করেন। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল সেটা ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু মুসলিম হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক, নৈতিক এবং পদ্ধতিগত অবস্থানের ওপর এটার একটা বড় প্রভাব থাকে। এই অ্যাপ্রোচটা তৈরি হবার জন্য দরকার নিজেদের একটা স্বতন্ত্র ও সুনির্দিষ্ট আদর্শ থাকা। প্রয়োজন সুস্পষ্ট রেফারেন্স পয়েন্ট। নিজস্ব চিন্তাধারাও থাকা দরকার। এই সব কিছু মিলে মর্ডানিটির সর্বগ্রাসী আক্রমনের সামনে এক শক্ত দেয়াল তৈরি করে।

গত কয়েক বছরের (সীমিত) অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে, এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের কওমি অঙ্গনের মাঝে নেই। আমি জানি এ কথাটা খুবই অপছন্দনীয় হবার কথা, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও এ উপসংহারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো তেমন কিছু পাইনি। কওমি অঙ্গনের মধ্যে অনেক কিছু আছে, কিন্তু এ ধরনের আগ্রাসনের মোকাবেলা করার মতো কোন আদর্শিক কাঠামো নেই। এখানে আছে এক ধরনের ট্র্যাডিশানালিযম। যেটার বাস্তবায়ন দেখা যায় আকাবীর, মুরুব্বী, বড়দের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য ও অনুসরণের মাঝে। নেতাদের এক ডাকে রাস্তায় নেমে আসা, কিংবা দ্বীন ইসলামের জন্য কুরবানী দেয়ার ইচ্ছার মাঝে। কিন্তু, চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শ কোন নির্দিষ্ট ধাঁচে, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এখানে গড়ে উঠে না। বিভিন্ন পীর, প্রতিষ্ঠান, আকাবীর, মুরুব্বী, ইত্যাদির সাপেক্ষে ঠিক করা হয় হক-বাতিল, উত্তম-অনুত্তমের ধারণা। কোন কনসিস্টেন্সি পাওয়া যায় না। একজন আকাবীরের বক্তব্য, আরেকজন মুরুব্বীর কাজ, তৃতীয় আরেকজনের মৌন সম্মতি, ইত্যাদি মিলিয়ে তৈরি হয় রঙবেরঙের এক মিশ্রণ। অনেক সময়ই যার একাংশ হয় অন্য অংশের সাথে সাংঘর্ষিক। সেই সাথে থাকে প্রয়োজনমতো যেকোন মুখস্থ উত্তর মেলানোর প্রায় সীমাহীন আগ্রহ ও সক্ষমতা।

আমার মতে, আজকে যে উপসর্গগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো হল এই সমস্যার ফলাফল। বাইরে থেকে অতিকায় মনে হওয়া এ অট্টালিকার, ভিত সম্ভবত ঘুণে খেয়ে ফেলছে। একদিকে অনেক বড়রা আল্লাহ্‌র ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। অন্যদিকে ইন্টারনেটের যুগে ক্রমাগত আলগা হচ্ছে ছোটদের ওপর বড়দের লাগাম। ফলে একদিকে তৈরি হয়েছে শূণ্যতা, অন্যদিকে আসছে নতুন সব চিন্তার প্রভাব। এগুলোর মোকাবেলা করা এবং শূন্যতা পূরণের কোন মেকানিযম নেই। সবাই আকাবীরদের কথা বলেন, দেওবন্দের আদর্শের কথা বলেন, কিন্তু সেই আদর্শটা আসলে কী, সেটা নিয়ে একমত হতে পারেননা নিজেরাই। নিজের স্বকীয়তার কথা বলেন, শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেন – কিন্তু সেই স্বকীয়তাটা কী? উম্মাহর জন্য বর্তমানে প্রজেক্টটা কী? সেটার স্পষ্ট কোন উত্তর কেউ দিতে পারেন না। কিছু বুঝ দেয়া, লাম্প-সাম কথাবার্তা যদিও তৈরি থাকে। ব্যক্তি পর্যায়ে এর বিভিন্ন ব্যতিক্রম থাকলেও, সার্বিকভাবে সম্মিলিত অর্থে ব্যতিক্রম নেই।

ছোটদের একটা জনপ্রিয় খেলা আছে। চাইনিজ উইসপার। সবাই প্রথমে লাইন হয় দাড়ায়। তারপর লাইনের প্রথমজন, দ্বিতীয়জনের কানে ফিসফিসিয়ে কোন একটা কথা বলে। দ্বিতীয়জন সেটা ফিসফিস করেই পৌছে দেয় তৃতীয় জনের কানে। এভাবে চলতে থাকে। লাইনের শেষ জনের কাছে এসে দেখা যায়, শুরুর কথাটা আমূল বদলে গেছে। ট্র্যাডিশানালিযমের সমস্যাটা এখানেই। অনবরত চলতে থাকা চাইনিজ উইসপারের কোন আসরের মতো, প্রত্যেকটা রেফারেন্স নির্ভর করে অন্য কোন সেকেন্ডারি রেফারেন্সের ওপর। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করেন একেক মুরুব্বীকে। এটা ভুল হলে কী অমুক মুরুব্বী বলতেন না? এটা ঠিক হলে কি অমুক আকাবীর করতেন না? – এরকম পিছলে যাওয়া প্রশ্নের মধ্য দিয়ে আলোচনাগুলো শুরু ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে চলতে একসময় হয় মূল শিক্ষা হারিয়ে যায়, অথবা বিকৃত হয়ে আজকের মতো অবস্থা তৈরি হয়।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের, সংস্কার ও সংশোধনের তেমন কোন পথ, পদ্ধতি এখনো দেখা যাচ্ছে না। বরং কোন সমস্যা যে আছে, সেটা স্বীকার করার মনোভাবই অনুপস্থিত। কোন সেলফ কারেক্টিং মেকানিযমের অবর্তমানে কোন আন্দোলনের মধ্যে এই সমস্যা সৃষ্টি হলে সেটার সম্ভাব্য এবং অবধারিত ফলাফল একটাই।