আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল ক্বুর’আনে বলেন,

হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রবর্তী হয়ো না এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।" [সুরা আল হুজুরাত (৪৯):১]

এ আয়াতের ব্যাপারে প্রখ্যাত সাহাবী রইসুল মুফাসসিরিন [1] হযরত ইবনে আব্বাসের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায়, এই আয়াতটি রাসূলুল্লাহর ﷺ পরবর্তী সকল প্রজন্মের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হয়েছে। ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রবর্তী হয়ো না” এর অর্থ হল, "এমন কোনকিছু বলো না যা কুরআন এবং সুন্নাহ পরিপন্থী।"

ইবন আব্বাসের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এই কথা থেকে এই সূরার পরবর্তী আয়াতের অর্থ সম্পর্কে আমরা ধারনা পেতে পারি –

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নবীর আওয়াজের উপর তোমাদের আওয়াজ উঁচু করো না এবং তোমরা নিজেরা পরস্পর যেমন উচ্চস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরকম উচ্চস্বরে কথা বলো না। এ আশঙ্কায় যে তোমাদের সকল আমল-নিষ্ফল হয়ে যাবে অথচ তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না।“[সুরা আল হুজুরাত(৪৯):২]

রাসূলুল্লাহর ﷺ উপস্থিতিতে উচ্চস্বরে কথা বলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও এই দুটি আয়াত থেকে আমরা আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা পাই। আর তা হল মুসলিমদের কর্তব্য হল রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তার বিপরীতে নিজ থেকে আগ নিজস্ব মতামত প্রকাশ ও তর্ক করা থেকে বিরত থাকা ।[2]

বিশেষ করে খেয়ালখুশি, ধারণা বা মতের উপর ভিত্তি করে কুর’আনের কোন আয়াতের অবৈধ এবং ভিত্তিহীন ব্যাখ্যা করা থেকে সর্বাবস্থায় বিরত থাকা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। কারন দ্বীনের কোন ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর ﷺ কোন বক্তব্য থাকলে সেখানে অন্য কারো কোন মত দেবার সুযোগ আর নেই। কারন তিনিই হলেন সেই ব্যক্তি ﷺ যাকে সমগ্র মানবজাতির মধ্যে থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মনোনীত করেছেন শেষ নবী হিসেবে, এবং তাকেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন তাঁর বাণী প্রচার ও ব্যাখ্যা করার জন্য।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

অতীতের রসূলদেরকে পাঠিয়েছিলাম) স্পষ্ট প্রমাণাদি আর কিতাব দিয়ে; আর এখন তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করছি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে আর যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। [সূরা আন-নাহল, ৪৪]

এবং নিঃসন্দেহে, আল্লাহর রাসূল ﷺ তার দায়িত্ব এমনভাবে পূর্ণ করে গেছেন যে, যে কেউই তার শিক্ষা, নির্দেশনা ও পদ্ধতি থেকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এর দায়ভার আর কারও নয় বরং তার নিজের উপরেই বর্তাবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

“আমি তোমাদের কাউকে যেন এ অবস্থায় কিয়ামতের দিন না পাই যে, তার কাঁধে বকরী বয়ে বেড়াচ্ছে আর ক্ষীণস্বরে করে চিৎকার দিচ্ছে। অথবা তাঁর কাঁধে রয়েছে ঘোড়া আর তা চি হি করে আওয়াজ দিচ্ছে। ঐ ব্যক্তি আমাকে বলবে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না। আমি তো (দুনিয়ায়) তোমার নিকট (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দিয়েছি। ”[3]

রাসূলুল্লাহর ﷺ উপস্থিতিতে আগ বাড়িয়ে কথা বলার জন্য এই কঠিন হুশিয়ারি এমন এক সময় প্রদান করা হয়েছিল, যখন কোন মুসলিমের পক্ষে রাসূলুল্লাহর ﷺ কোন কথার বিরোধিতা করা ছিল অকল্পনীয়। বর্ণিত আছে, সূরা হুজুরাতে রাসূলুল্লাহর ﷺ উপস্থিতিতে উচ্চস্বরে কথা বলা সম্পর্কীয় এই আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার পর উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এতো নিচু স্বরে কথা বলছিলেন যে রাসূলুল্লাহ ﷺ সেটা বোঝার জন্য তাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন একইভাবে আনাস বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, যখন এই আয়াত (৪৯:২) নাযিল হয়েছিল সাবিত বিন ক্বায়িস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যিনি স্বাভাবিকভাবেই একটু জোরে কথা বলতেন, বললেন, 'আমিই সেই ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহর ﷺ চেয়ে জোরে কথা বলেছিলাম। আমি তো জাহান্নামের বাসিন্দা হয়ে গেছি। আমার সমস্ত নেক আমল ব্যর্থ হয়ে গেল।' তিনি পীড়িত হৃদয়ে তার বাড়িতে বসে ছিলেন যে পর্যন্ত না রাসূলুল্লাহ ﷺ তার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করেন, এবং তার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু অনুপস্থিতির ব্যাপারে অন্যান্য সাহাবীদের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন জিজ্ঞাসা করেন। যখন রাসূলুল্লাহকে ﷺ সাবিতের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আশংকার কথা অবহিত করা হল তখন তিনি বললেন, "না, সে (সাবিত) জান্নাতের অধিবাসীদের একজন।"[4]

এই ঘটনা রাসূলুল্লাহর ﷺ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান সম্পর্কে সাহাবীদের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন উপলব্ধি ও সতর্কতার সাক্ষ্য বহন করে, যে কারনে শুধু রাসূলুল্লাহর ﷺ উপস্থিতিতে উচ্চস্বরে কথা বলাও তাদের অন্তরে এমন ভীতির সঞ্চার করত। সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন কখনোই রাসূলুল্লাহর ﷺ মতের বিরোধিতা করতেন না, প্রতিবাদ করতেন না, সন্দেহ প্রকাশ করতেন না অথবা দ্বীনের কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহর ﷺ কোন বক্তব্য থাকলে সে বিষয়ে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করতেন না। রাসূলুল্লাহর ﷺ আদেশের প্রতি কেবলমাত্র পরিপূর্ণ আনুগত্য ছাড়া তাদের মাঝে আর কিছুই প্রকাশ পেত না। এমন এক প্রেক্ষাপটে আল্লাহর রাসূল ﷺ এমন একটি বিষয়ে তাদের সতর্ক করেছিলেন, যা ছিল সাহাবীদের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন জন্য অকল্পনীয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

“তোমাদের কেউ কি তার পালংকে আধশোয়া হয়ে একথা চিন্তা করে যে আল্লাহ শুধু ওই বিষয়গুলো নিষিদ্ধ করেছেন যা ক্বুর’আনে উল্লেখিত আছে? আল্লাহর শপথ, আমি কুর’আনে যতটুকু আছে তার সমান বা এর চেয়ে বেশি এমন অসংখ্য বিষয়াবলী বলেছি, আদেশ করেছি এবং তা থেকে নিষেধ করেছি।”[5]

তিনি ﷺ জানিয়েছেন,

“জেনে রাখ, আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি এবং তার সাথে আরও অনুরূপ আরেকটি জিনিস। অচিরেই দেখা যাবে, যখন বিছানায় আরামে হেলান দিয়ে থাকা কোন ব্যক্তি বলবে: ক্বুরআনের সাথেই থাকো । এতে যে সকল বস্তু হালাল পাবে সেগুলোকে হালাল মনে কর, আর যে সব বস্তুকে হারাম পাবে সেগুলোকে হারাম মনে কর।“[6]

*[A Critical Analysis of Modernists & Hadith Rejectors, (Sajid A. Kayum) থেকে অনূদিত]

আরো পড়ুনঃ কেন্দ্র থেকে বিচ্যুতিঃ হাদীস সায়েন্স কি অনির্ভরযোগ্য? http://bit.ly/2eskG3v


[1] ইবনু ‘আববাস (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তাঁর শরীরের সঙ্গে) আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেনঃ হে আল্লাহ্! তাকে কিতাবের ইলম দাও। সাহিহ আল বুখারি, (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৭৬২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৭৭৪)

[2] দেখুন তাফসির ইবন কাসির সূরা হুজুরাত আয়াত ১ ও ২

[3] সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ ৪৮/ জিহাদ , হাদিস নম্বরঃ ২৮৫৬, পাবলিশারঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন

[4] দেখুন তাফসির ইবন কাসির সূরা হুজুরাত আয়াত ১ ও ২

[5] আবু দাউদ (৩০৪৪)

[6] আবু দাউদ, মিকদাদ ইবনে মাদিকারাব থেকে বর্ণিত, সনদ সহীহ