এই পর্বটি বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে ফেমিনিযম, গণতন্ত্র, ইন্ডুভিযুয়ালিযম, সেক্যুলারারিযম সহ বিভিন্ন পশ্চিমা আদর্শকে ইসলামাইয করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের বক্তব্য ও অবস্থানের সাথে এ অধ্যায়ে আলোচিত ব্যক্তিদের অবস্থান, বক্তব্য ও আদর্শের অনেক মিলই সচেতন পাঠক খুঁজে পাবেন। এ সকল বিচ্যুতির শেকড় একই। ]

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ভবিষ্যৎবাণী বাস্তবে পরিণত হল যখন সালাফ আস-সালেহিনের পরবর্তী যুগে আহলুল কালাম এবং উসুল ও ফিক্বহের কিছু আলিম এক বিপদজনক ধারার সূচনা করলেন। তারা কিছু নির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন ও গ্রহণ করলেন এবং এমন একটি চরমপন্থী অবস্থান গ্রহণ করলেন যে, যদি হাদিসসমূহের বক্তব্য তাদের প্রণীত এইসব নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবেই সেগুলো গ্রহণযোগ্য হবে, আর যদি এগুলো তাদের এসকল নীতির মাপকাঠিতে উত্তীর্ন না হয় তবে তা গ্রহণীয় নয়।[1] এভাবে তারা পুরো বিষয়টিকে উল্টে দিলেন। যেখানে হাদিসের মাপকাঠি হবার কথা এবং হাদিসের আলোকে বিচার করা কথা, সেখানে তারা হাদিসকে এসব নীতির অধীনে বিচার করা শুরু করলেন [দেখুন The hadith is proof itself in belief & law. By: Sheikh Nasir-Ud-Din Al-Albani[2]]। এধরনের নীতিসমূহের উদাহরণ হল – “আক্বিদাহ সংক্রান্ত বিষয় আহাদ হাদিস থেকে গ্রহণ করা যাবে না”[3] এবং “যে হাদিস ক্বুর’আনের বর্নিত নিয়মের সাথে বিধান যোগ করে সেগুলো গ্রহণযোগ্য নয়।” অতঃপর যারা এই ভ্রান্ত নীতিগুলোর অনুসরণ করলো, তারা ক্রমেই এনিয়মগুলোকে ভিত্তি করে আরো বিভিন্ন আনুষঙ্গিক নীতি তৈরি করতে লাগলো। একপর্যায়ে এই মূল থেকে উৎসারিত কিছু দল খোলাখুলিভাবে হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ঢালাওভাবে প্রশ্ন তুললো এবং হাদিস অস্বীকার করা শুরু করলো। আর একাজের পেছনে তাদের উদ্দেশ্য তাদের পূর্বের ওই আহলুল কালামের অনুরূপ; হাদিসকে পাশ কাটিয়ে দ্বীনের মধ্যে নানা মতামত, দর্শন ও অনুমানভিত্তিক অবস্থান গ্রহনের উন্মুক্ত করা। হাদিস অস্বীকারকারীদের মাঝে বিভিন্ন ধারা আছে।

অর্থাৎ হাদিস অস্বীকারকে একেক দল একেকভাবে প্রকাশ করে। যেমন –

১) কিছু দল ও ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে হাদিস অস্বীকার করে। যেমন রাশাদ খলিফাহ[4] ও তার অনুসারীরা

২) আবার অনেকে সরাসরি সব হাদিসকে অস্বীকার করে না কিন্তু হাদিসকে তারা ওয়াহিলব্ধ জ্ঞান হিসেবে না বরং কিছু উপকথা, প্রথা, সংস্কার, ঐতিহ্যের সমাহার হিসেবে দেখে। আর যখন কোন হাদিস ক্বুর’আনের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় কেবলমাত্র তখনই তারা কোন হাদিসকে স্বীকার করে। যেমন গোলাম পারভেজ[5]।

৩) অনেকে সম্পূর্ণভাবে হাদিসসমূহের বৈধতা, গ্রহণযোগ্যতা, প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ইসলাম বোঝা ও পালনের ক্ষেত্রে হাদিসকে অগুরুত্বপূর্ণ গৌণ উৎস হিসেবে বিবেচনা করে। যেমন আমিন আহসান ইসলাহি।[6]


[1] উল্লেখ্য তাঁদের এই বাছবিচারের নীতি হাদিসের সনদের সাথে সম্পর্কিত ছিল না। অর্থাৎ কোন হাদিস কি নিশ্চিত ভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছ থেকে বর্নিত হয়েছে কি না – এ সংশয় নিরসনের জন্য তাদের এ নীতিসমূহ প্রণীত হয় নি। বরং তাদের বাছবিচার ছিল হাদিসের বক্তব্য গ্রহনের ক্ষেত্রে। রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে সঠিক সনদে বর্নিত হাদিসের বক্তব্যও যদি তাদের প্রণীত নীতিমালার কাঠামো ও মাপকাঠির সাথে সাঙ্ঘর্ষিক হত, তবে তারা সেই হাদিস গ্রহণ না করার অবস্থান গ্রহণ করেন।

[2] https://d1.islamhouse.com/data/en/ih_books/single/en_Hadith_is_Proof_Itself_in_Belief_Laws.pdf

[3] এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্য দেখতে পারেন - https://islamqa.info/en/130918

[4] রাশাদ খলিফাহ ছিল মিশর থেকে অ্যামেরিকায় পাড়ি জমানো একজন অভিবাসী। রাশাদ খলিফাহ দাবি করে সে ক্বুর’আনের মধ্যে “১৯” সংখ্যাটি এবং এর গুণিতকসমূহের একটি গাণিতিক প্যাটার্ণ খুঁজে পেয়েছে। সে আরো দাবি করে তার এই আবিষ্কার হল নবী-রাসুলদের আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম সাথে যেমন আলৌকিক ব্যাপার ঘটে (মু’জিযাহ) তেমন একটি আলৌকিক ব্যাপার। আর তাই সে এই “মু’জিযাহর” ভিত্তিতে নিজেকে একজন রাসূল বলে দাবি করে।

“১৯“ নিয়ে মোহাচ্ছন্নতার কারনে রাশাদ খলফিয়াহ ক্বুর’আনের দুটি আয়াত অস্বীকার করে বসে। কারন এই দুটী আয়াত তার দাবিকৃত ১৯ এর গাণিতিক প্যাটার্নের সাথে খাপ খাচ্ছিলো না। এ আয়াতদুটো ছিল সূরা তাওবাহর ১২৮ ও ১২৯ নম্বর আয়াত। (যখনই কোন সূরাহ নাযিল হয় তখনই তারা পরস্পরে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে আর (ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে) ‘তোমাদেরকে কেউ দেখছে না তো?’’ অতঃপর তারা চুপিসারে সরে পড়ে। আল্লাহ তাদের অন্তরকে (সত্য পথ থেকে) ফিরিয়ে দিয়েছেন, কেননা তারা এমনই এক সম্প্রদায় যারা বুঝে না। তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের নিকট একজন রসূল এসেছেন, তোমাদেরকে যা কিছু কষ্ট দেয় তা তার নিকট খুবই কষ্টদায়ক। সে তোমাদের কল্যাণকামী, মু’মিনদের প্রতি করুণাসিক্ত, বড়ই দয়ালু। এ সত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে বলে দাও- আল্লাহ্ই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি ছাড়া সত্যিকারের কোন ইলাহ নেই, তাঁর উপরই আমি ভরসা করি, তিনি হলেন মহান আরশের মালিক। [সূরা তাওবাহ, ১২৭-১২৯])

সে আরো দাবি করেছিল রাসূলুল্লাহর ﷺ একমাত্র ভূমিকা ছিল ক্বুর’আন মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া। আর তাই তিনি ﷺ শুধু এটুকুই করেছেন, ক্বুরআনের কোন ব্যাখ্যা ও ক্বুর’আনকে অনুসরণের অর্থ তিনি ﷺ শিখিয়ে যান নি। রাশাদ খলিফা সম্পূর্ণভাবে হাদিস অস্বীকার করেছিল এবং এই ঘোষণা দিয়েছিল যারাই কালিমাতে “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” যুক্ত করে তারা মুশরিক হবে। (অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বা আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” যে বলে, রাশাদ খলিফাহর মতে সে ব্যক্তি মুশরিক।)

রাশাদ খলিফার এই ১৯ ভিত্তিক গাণিতিক প্যাটার্ন বিষয়ক গবেষণা সম্বন্ধে ড.বিলাল ফিলিপস বলেছেন, "অনেক মুসলিমই প্রথমদিকে কোনরকম পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়াই খুব উৎসাহভরে রাশাদ খলিফাহর এই মতবাদ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু, যখন সুক্ষদর্শী সমালোচকেরা তার এই সংখ্যাগুলো পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন, তারা অসংখ্য অসামঞ্জস্যতা এবং জালিয়াতি খুঁজে পেলেন। কোন একটি অক্ষর বা শব্দ কোন একটি সূরা বা কয়েকটি সূরাতে কয়বার এসেছে সেই সংখ্যার উপর ভিত্তি করে রাশাদ খলিফাহ তার এই থিওরি তৈরি করেছিল। অনুসন্ধানে দেখা গেল, নিজের থিওরি প্রমান করার জন্য কোন সূরাতে কয়টি আলিফ প্রয়োজন তার উপর ভিত্তি করে কখনো কখনো সে হামযা কে আলিফ হিসেবে গণ্য করেছে আবার কখনো করে নি।

কখনো কখনো জায়গায় সে এমন অক্ষর গুনেছে যেটা আদৌ ঐখানে নেই, আবার কখনো দেখা গেছে যে সে কিছু অক্ষর গোণায় ধরে নি। কখনো কখনো তিনি দুইটি শব্দকে একটি শব্দ হিসেবে গণনা করেছে। তিনি মাঝেমাঝে ক্বুর’আনের আয়াতের সাথে সংযোজন করেছে আবার কখন ক্বুর’আন থেকে কিছু অংশ বাদ দিয়েছে। আর এসবই সে করেছে যাতে করে তার নিজের থিওরিকে প্রমানের জন্য প্রয়োজনীয় অংক মেলানো যায়। [বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুনঃ “The Quran’s Numerical Miracle: Hoax and Heresy” by Dr. Bilal Philips]

[5] গোলাম পারভেজ ছিল অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ রাজের অধীনের একজন সরকারি কেরানি। ভারতের বিভক্তির পর সে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কাজ করেন। গোলাম পারভেজ “তলু-ই-ইসলাম ট্রাস্ট”-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং হাদিস অস্বীকার করার ব্যাপারে অনেক বইয়ের লেখক।

[6] আমিন আহসান ইসলাহির জন্ম আযমগড়। পেশায় ছিলেন একজন সাংবাদিক। তিনি হামিউদ্দিন ফারাহীর কুরআন থেকে সরাসরি অর্থ আহরনের (direct deliberation on the Qur’aan) দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। আমিন আহসান ইসলাহি ছিলেন মাওলানা মওদূদীর 'জামা'আত ইসলামী' দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যসমূহের অন্যতম।

ইসলাহির মতো হাদিস নিয়ে মওদূদীর অবস্থানও ছিল সন্দেহজনক এবং মওদূদি এবং ইসলাহি দুজনেই হাদিসের সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় ও অবিশ্বাসের প্রসার ঘটিয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ 'আলিম হাদিস ও সুন্নাহ বিষয়ক মওদূদীর ভ্রান্তমতগুলোকে সনাক্ত করেছেন। তাদের মধ্যে মুহাম্মাদ ইসমাইল আস-সালাফি (আল্লাহ তার উপর রহম করুন, মৃ,১৩৮৭ হিজরী) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি মাওক্বিফ আল-জামা'আত আল-ইসলামিয়্যাহ মিন আল-হাদিস আল-নাওয়াবি (নবীর ﷺ হাদিসের প্রতি জামা'আত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি) নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা রচনা করেছেন।

মাওলানা ইসমাঈল আস-সালাফির গবেষণা অনুসারে -
একথা সত্য যে মাওলানা ইসলাহির কথার ধরন ও প্রকাশভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন কিন্তু উদ্দেশ্যর দিক দিয়ে তা মাওলানা মওদূদীর চিন্তাধারা হতে আলাদা কিছু নয়। হাদিসের ব্যাপারে এই দুজন মুরুব্বীর দৃষ্টিভঙ্গি অনেকাংশে একই রকম।"
[হুজ্জিয়াত হাদিস, শেইখ মুহাম্মাদ ইসমাঈল গুজরানওয়ালা, পৃ ৮৭ (Jamaat Islami's Views on Hadith – a critcal analysis)]। ইন শা আল্লাহ পরবর্তীতে এ বিষয়টি নিয়ে আমরা আরো আলোচনা করবো।

কোন হাদিসের সত্যতা নিরূপণের ব্যাপারে মওদূদী এক অদ্ভুত মানদণ্ডের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, "কোন ব্যক্তি যদি ইসলামের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞান রাখে এবং গভীরভাবে ক্বুর’আন এবং রাসুলুল্লাহর ﷺ চরিত্র ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অধ্যায়ন করে থাকে, তবে সেই ব্যক্তি রসুলুল্লাহর ﷺ চরিত্র ও তাঁর ﷺ সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। আর তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সে তখন অনুধাবন করতে সক্ষম হবে কোন কথাটি কোন নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে রসুলুল্লাহর ﷺ পবিত্র মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছে, আর কোন কথাটি রসুলুল্লাহর ﷺ এর মুখনিঃসৃত নয়।
[তাফহিমাত, খণ্ড ১/৩৩৮, ইসলামি পাবলিকেশন্স লিমিটেড, লাহোর ২০০০ ইং]

হাদিসের ব্যাপারে আমিন ইসলাহির দৃষ্টিভঙ্গি ও হাদিস গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষেত্রে তার নীতি বর্তমানে তার ছাত্র জাভেদ আহমেদ গ্বামিদি চৌকস ভাবে মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করে বেড়াচ্ছে।

ইসলামে হিজাবের কোন ভিত্তি নেই, সঙ্গীত হারাম না, একজন মহিলার ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান/ইমাম হতে কোন শরয়ী বাঁধা নেই, আল্লাহর রাসূল ﷺ শারীরিক ভাবে মিরাজে যান নি, রযমের বিধান অস্বীকার, ঈসা আলাইহিস সালামের অবতরণ অস্বীকার, আল-মাহদি ও দাজ্জালের আগমন অস্বীকার সহ আরো অনেক বাতিল ধারণা সে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। কিছুদিন আগে মাসজিদে “মহিলা ইমাম” নিয়ে অ্যামেরিকায় ঘটে যাওয়া প্রহসনের ক্ষেত্রেও এই ব্যক্তি মহিলার জন্য ইমাম হওয়া জায়েজ এই অবস্থান সমর্থন করেছিল [সাম্প্রতিক সময়ে ফেমিনিযম, গণতন্ত্র, ইন্ডুভিযুয়ালিযম, সেক্যুলারারিযম সহ বিভিন্ন পশ্চিমা আদর্শকে ইসলামাইয করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে এধরনের অনেক অবস্থানই প্রচার করে থাকেন। ]

*[A Critical Analysis of Modernists & Hadith Rejectors, (Sajid A. Kayum) থেকে অনূদিত]

আরো পড়ুনঃ কেন্দ্র থেকে বিচ্যুতিঃ হাদীস সায়েন্স কি অনির্ভরযোগ্য? http://bit.ly/2eskG3v