পর্ব ৮

লেখাটি "What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ" সিরিযের অংশ। আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে, সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে

ইসলাম নিয়ে আবু জাহল আসলে কী ভাবতো তা নিয়ে খুব ইন্ট্রেস্টিং দুটা ঘটনা আছে। প্রথম ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় সীরাত ইবনু হিশামে।

মাক্কী যুগের কথা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতে তাঁর ঘরে সালাত আদায় করতেন। এক রাতে কুরাইশের কিছু নেতা গোপনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাসার কাছে এসে তাঁর কুরআন তিলাওয়াত শুনছিলো। এরা ছিল আবু সুফিয়ান, আখনাস আস-সাকাফী এবং আবু জাহল।

তিন জন এসেছিল আলাদা আলাদাভাবে, একজন আরেকজনের ব্যাপারে জানতো না। কিন্তু ভোরবেলা ফেরার সময় তাদের দেখা হয়ে গেল। বেশ বিব্রতকর অবস্থা। নিজেদের মধ্যে বেশ কিছুটা চোটপাটও হয়ে গেল তাদের, “...আরে এসব কী! মানুষ দেখে ফেললে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে! আর যেনো এমন না হয়...”– এধরনের কথাবার্তা।

কিন্তু একই ঘটনা পরের দিনও ঘটলো। এবং তার পরের দিন আবারও।

প্রতিবারই ভোরবেলা বাড়ি ফেরার সময় তিন জনের দেখা হয়ে যায়। প্রতিবারই তিনজন লজ্জা পায়, তারপর লজ্জা ঢাকতে হাকডাক করে। শেষমেষ তারা শপথ করলো, আর কখনো এরকম করা যাবে না। পরদিন সকালে আখনাস আলাদা আলাদাভাবে আবু সুফিয়ান এবং আবু জাহলের ঘরে গেল। জিজ্ঞেস করলো, মুহাম্মাদের কাছে যা শুনলে, তা নিয়ে তোমার অভিমত কী?’

আবু জাহলের উত্তর থেকে কুরআন এবং রিসালাতের নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়। আবু জাহল বেইসিকালি বললো–

আমরা (বানূ মাখযুম গোত্র) আর বানূ আব্‌দমানাফ দীর্ঘদিন ধরে মর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রতিদ্বন্দীতা করে আসছি। তারা যা করেছে আমরা সেটাতে পাল্লা দিয়েছি। আজ আমরা যখন সমান তালে আছি তখন তারা দাবি করছে তাদের মধ্যে নবী আছে, যার কাছে আসমান থেকে ওয়াহী আসে। এখন আমরা কিভাবে তাদের সমান হবো? আল্লাহর কসম, আমরা কখনো মুহাম্মাদকে নবী হিসেবে স্বীকার করবো না।

দ্বিতীয় ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় সাহাবী মুগীরাহ ইবনু শুবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে। এটি উল্লেখ করেছেন ইমাম বায়হাকী। মুগীরাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর বক্তব্য অনেকটা এরকম—

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে প্রথম যখন আমার পরিচয় হয়, সেই দিন আবু জাহল আর ও আমি মক্কার এক ছোট্ট গলি দিয়ে হাঁটছিলাম। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে আমাদের দেখা হল।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবু জাহলকে বললেন: হে আবুল হাকাম; আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে এসো।

আবু জাহল বললো: মুহাম্মাদ! তুমি কি আমাদের ইলাহদের নিন্দা করা বন্ধ করবে না? তুমি যদি চাও আমরা সাক্ষ্য দিই, তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছো, তাহলে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, তোমার যা জানানোর ছিল তুমি জানিয়েছো। তুমি পৌঁছে দিয়েছে। আল্লাহর কসম! আমি যদি জানতাম তুমি যা বলছো তা সত্য, তাহলে তো আমি তোমার অনুসরণই করতাম।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চলে গেলেন। আবু জাহল তখন বললো:

আল্লাহর কসম! আমি জানি, মুহাম্মাদ যা বলে তা সত্য। কিন্তু একটা জিনিস আমাকে এই সত্য গ্রহণ করতে বাঁধা দেয়।

বানূ কুসাই (নবী ﷺ –এর গোত্র) দাবী করলো, কা’বার চাবি আমাদের। আমরা বললাম: হাঁ।

তারা বললো: যমযম এবং হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্ব আমাদের। আমরা বললাম: হাঁ।

তারা বললো”: ‘পরামর্শ সভার দায়িত্ব আমাদের।’ আমরা বললাম: হাঁ।

তারপর তারা বললো: যুদ্ধের পতাকা আমাদের।’ আমরা বললাম: হাঁ।

সব কিছু আমরা তাদের জন্য ছেড়ে দিলাম। তারপর আমরা ধীরে ধীরে আগালাম, তাদের সাথে পাল্লা দিতে শুরু করলাম। আজ যখন আমরা তাদের সমকক্ষতা অর্জন করেছি তখন তারা বলা শুরু করেছে, “আমাদের মধ্যে নবী আছে”!

এর সাথে তো পাল্লা দেয়া সম্ভব না। আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই এটা (নুবুওয়্যাত) মেনে নেবো না।

সত্য জেনেও নবীরাসূলদের প্রত্যাখ্যানের এই প্রবণতা অনেক পুরনো। বিশেষ করে কুরআনে যাদেরকে আল-মালা বলা হয়েছে—অর্থাৎ সমাজের নেতা বা এলিটদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি থাকে।

যুগে যুগে সামাজিক, রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ব্যবসায়ীক এলিটরা নবীরাসূলদের বিরোধিতা করেছে। নবীদের বিরোধিতায় আল-মালা বা এলিটদের ভূমিকার কথা সূরা আ’রাফে বারবার এসেছে। এলিটরা বুঝতো নবীদের দাওয়াহ তাদের গড়ে তোলা আধিপত্যের কলুষিত কাঠামোর জন্য হুমকি। তাই নবীরাসূলদের বিরোধিতায় তারা থাকতো সবার আগে।

আবু জাহলের যুক্তিটাই লক্ষ্য করুন না।  আবু জাহলের জানতো মুহাম্মাদ (ﷺ) সত্য বলছেন। তার কথা থেকে এটা স্পষ্ট। কিন্তু গোত্রীয় মর্যাদাবোধ, আর ক্ষমতার হিসেবনিকেশের কারণে এ সত্যকে সে অস্বীকার করলো। কারণ মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে নবী হিসেবে মেনে নিলে তার নিজের গোত্র প্রতিযোগিতায় হেরে যাবে। আধিপত্য হারাবে।

পুরো ব্যাপারটা থেকে আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়। সামাজিক-রাজনৈতিক যেসব হিসেবনিকেশের কারণে আবু জাহল সত্যকে অস্বীকার করেছিল, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তা সেকেলে হয়ে যায়। কুরাঈশ গোত্রগুলোর ছোটখাটো প্রতিযোগিতার সীমানা ছাড়িয়ে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বজুড়ে। মুসলিমদের হাতে পরাজিত হয় সেই সময়কার দুই পরাশক্তি—রোম ও পারস্য। গড়ে ওঠে হাজার বছরের এক অবিস্মরণীয় সভ্যতা।

আবু জাহল এ সভ্যতার অংশ হতে পারতো। সেই সুযোগ তার ছিল। সে ছিল কুরাইশের অনেকগুলো শাখার মধ্যে একটা শাখার নেতা। মক্কার বাইরে যার তেমন কোন ক্ষমতা নেই। অন্য দিকে ইসলাম গ্রহণ করার কারণে তার সমসাময়িক আবু বাকর, উমার, উসমান, আলী, সা’দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মত মানুষরাই অল্প কিছু বছরের ব্যবধানে বিস্তীর্ণ ভূমির শাসক হয়েছেন। বিশ্বজুড়ে এমন সম্মান, মর্যাদা, ক্ষমতা আর নেতৃত্ব পেয়েছেন জাহিলিয়্যাহর যুগে কুরাইশের লোকজনের পক্ষে যা চিন্তা করাও সম্ভব ছিল না।

আবু জাহল যোগ্যতাসম্পন্ন লোক ছিল। ইসলাম গ্রহণ করে দুনিয়াতে এই সম্মান ও মর্যাদার ভাগীদার সে হতে পারতো, আর আখিরাতে পেতে পারতো জান্নাত। কিন্তু অস্বীকার করে দুনিয়া আর আখিরাত সবই সে হারালো।

আবু জাহল এমন এক প্যারাডাইম বা কাঠামোর মধ্যে চিন্তা করছিলো যা সেই সময়ের হিসেবে আপাতভাবে যৌক্তিক ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে দাওয়াহ এনেছিলেন তা একে বাতিল করে সেখানে নিয়ে আসে নতুন এক প্যারাডাইম। সমাজ ও রাজনীতির যেসব হিসেবনিকেশ আগে খুব যৌক্তিক মনে হতো, অল্প কয়েক বছরের মধ্যে সেগুলো হয়ে পড়ে গৌণ কিংবা অপ্রাসঙ্গিক।

যে জিনিসটাকে আমরা মেটাপলিটিকস বলছি, সব তত্ত্ব কথার পর তার মূল উদ্দেশ্য এটাই।

  • কোন কোন রাজনৈতিক অবস্থান সঠিক,
  • কোন কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য কাঙ্ক্ষিত, এবং
  • কোন রাজনৈতিক ফলাফল অর্জন করা সম্ভব

–এ ব্যাপারে মানুষের চিন্তাকে বদলে দেয়া। চিন্তার কম্পাস পালটে দেয়া। চিন্তার যে কাঠামোর মধ্যে আজকের বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ চলছে সেটাকে অপ্রাসঙ্গিক, তামাদি বানিয়ে ফেলা। একে এমন এক কাঠামো দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যার মূল ভিত্তি হবে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়। 

পরের পর্বের লিঙ্ক