পর্ব

লেখাটি "What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ" সিরিযের অংশ। আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে, সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে

সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের কালচারাল হেজেমনি ভাঙ্গার অর্থ কী- এ নিয়ে কিছু ভুল ধারণা আমাদের মধ্যে কাজ করে। এগুলোর নিষ্পত্তি প্রয়োজন।


প্রথম যে বিষয়টা বোঝা দরকার, সেটা হল সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের যে আধিপত্য বা কালচারাল হেজেমনির কথা বলে হচ্ছে, তার অর্থ আসলে কী?
অনেকে মনে করতে পারেন,


বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য, মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন সেক্যুলারদের দখলে, এটাই বোধহয় কালচারাল হেজেমনি। আর এটা ভাঙ্গার অর্থ হল এই অঙ্গনগুলোতে ঢুকে তাদের সাথে পাল্লা দেয়া বা তাদের বিকল্প কিছু তৈরি করা।

এই ধারণা সঠিক না।

কালচারাল হেজেমনির অর্থ আরো অনেক গভীর ও ব্যাপক।

হেজেমনি (আধিপত্য) হল সমাজের আলোচনাগুলো নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা। কোন বিষয়গুলো আলোচিত হবে কোনগুলো উপেক্ষিত হবে তা ঠিক করতে পারা। কোনটা ‘অপশক্তি’ আর কোন “শুদ্ধশক্তি” সেটা ঠিক করার ঠিকাদারী। যেকোন বিষয়ে ন্যারেটিভ (বয়ান) নির্মাণ আর সামষ্টিক স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা। এই ক্ষমতার মাধ্যমে সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠী এক অর্থে আমাদের জাতীয় চিন্তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রন করে।


ইতিহাসের যেই ছবি আর ব্যাখ্যা তারা তুলে ধরে সেটাই গৃহীত হয়। ‘হাজার বছরের সংস্কৃতি’র সীমানা তারাই ঠিক করে। এভাবে এক নির্দিষ্ট পরিচয় ও ইতিহাস বাকি সবার ওপর তারা চাপিয়ে দেয়। এটা হল অতীতের ওপর নিয়ন্ত্রন।


সমাজ ও রাষ্ট্রের আলোচনাকে নিয়ন্ত্রন করা, যেকোন ইস্যুতে তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা ও বয়ান বাকি সবার ওপর চাপিয়ে দেয়া, ইসলাম ও মুসলিমদের ‘অপর’ বানিয়ে রাখা-এগুলো হল বর্তমানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রন।


আবার, ভবিষ্যতে আমরা কেমন দেশ চাই, এ আলোচনার সীমানাও ওরাই ঠিক করে। ওদের বেঁধে দেয়া সীমানার বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক কোন চিন্তার অধিকার কারো নেই। বাংলাদেশের ভবিষ্যত কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তা করতে গেলে একদিকে “চেতনাবাদী” গরম সেক্যুলারিসম অন্যদিকে “ফ্যাসিবাদবিরোধী” কুসুম কুসুম সেক্যুলারিসম; একদিকে এক দিকে “৭১ এর চিরন্তন চেতনা” অন্যদিকে “জাতীয়তাবাদী আদর্শ”—এ দুইয়ের মধ্য কোন একটাকে আপনার বেছে নিতেই হবে।

সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের ঠিক করে দেয়া এই সীমানার বাইরে গিয়ে ইসলামের জায়গা থেকে রাজনৈতিক কোন চিন্তা করার সুযোগ আপনার নেই। এমন যে কোন চিন্তাকে সেক্যুলার-প্রগতিশীলরা বেআইনী সাব্যস্ত করবে।


অর্থাৎ আগামী নিয়ে স্বপ্ন দেখার অধিকারও আমাদের নেই। দেখতে হলে ওদের স্বপ্নটাই ধার করতে হবে। আর সেখানেও আমরা থেকে যাবো চির-অবাঞ্চিতই। এটা হল ভবিষ্যতের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রন।


কালচারাল হেজেমনি এই সব কিছুকে ধারণ করে। শিল্প, মিডিয়া এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ওপর নিয়ন্ত্রন এর একটা অংশ, কিন্তু এটাই মূল বিষয় না।


মূলত ইংরেজিতে কালচার (culture) শব্দের অর্থ ও প্রয়োগ যতোটা ব্যাপক, বাংলা ‘সংস্কৃতি” শব্দে তা পুরোপুরি ধরা পড়ে না। ফলে শাব্দিক অর্থের দিক থেকে চিন্তা করতে গেলে “কালচারাল হেজেমনি ভাঙ্গার অর্থ সাংস্কৃতিক/মিডিয়া পরিমণ্ডলে সেক্যুলারদের আধিপত্য ভাঙ্গা”- এমন ভুল ধারণা তৈরি হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। এই বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য কালচারাল হেজেমনির বাংলা হিসেবে “সাংস্কৃতিক আধিপত্য” এর বদলে “সামাজিক আধিপত্য” শব্দদ্বয় ব্যবহার করা অধিক উপকারী। এবং এই লেখার পরের সব অংশে আমরা এই শব্দ দুটোই ব্যবহার করবো।


দ্বিতীয় ভুল ধারণা সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের আধিপত্য ভাঙ্গার পদ্ধতি নিয়ে। এ ব্যাপারে সাধারনত দুটো ভুল দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়।


ক) একীভূত হওয়া (Integration)
খ) ‘ইসলামী’ বিকল্প তৈরি

একীভূত হওয়া (Integration): সোজা কথায় এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ হল সমাজে নিজের অবস্থান ধরে রাখা বা নতুন করে অবস্থান তৈরি করার জন্য ‘আমরাও বাঙ্গালি’-এই কথা প্রমাণের চেষ্টা। সেক্যুলার-প্রগতিশীলরা বাঙ্গালিত্বের যেসব সূচক ঠিক করেছে, যে মাত্রা ঠিক করেছে, আমরা সেগুলো সব মেনে নেবো, নিজেদের মধ্যে ধারণ করবো, আর ওপরে ওপরে কিছু ইসলামী ফ্লেভার যুক্ত করবো-এটাই হল ইন্ট্রেগ্রেশন বা একীভূত হয়ে যাওয়া।


সেক্যুলার দেশপ্রেমের বদলে ইসলামী দেশপ্রেম, সেক্যুলার বাঙ্গালিয়ানার বদলে ইসলামী বাঙ্গালিয়ানা, নীরবতা পালনের বদলে মিলাদ করা, অমুকের স্মরণে মূর্তির বদলে মসজিদ বানানোর কথা বলে নিজেকে ‘বাঙ্গালি’, ‘দেশপ্রেমিক’ ইত্যাদি প্রমানের চেষ্টা। একুশে ফেব্রুয়ারীতে মিনারের সামনে মাহফিল কিংবা সালাত আদায় করা, পহেলা বৈশাখে ফাতিহা পড়া, কনসার্টের বদলে কাওয়ালী এজাতীয় হাস্যকর কর্মকাণ্ড হল এই পলিসির ফসল।


এ পদ্ধতিতে কোন ভাবেই সেক্যুলারদের আধিপত্য ভাঙা সম্ভব না। কারণ এখানে শুরুতেই তাদের বেঁধে দেয়া সংজ্ঞা আর সূচকগুলো মেনে নেয়া হচ্ছে। নিজেদের যে আমরা ‘বাঙ্গালি’ প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছি সেই ‘বাঙ্গালিত্ব’-এর সংজ্ঞাটা নেয়া হচ্ছে সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের কাছ থেকেই। এসব করে যদি কলকাতাপন্থী সেক্যুলারদের বলয় থেকে অল্পস্বল্প বেরও হওয়া যায়, তবে ফের ঢুকতে হচ্ছে ‘ফ্যাসিবাদবিরোদী’, মার্কিনপন্থী সেক্যুলারদের বলয়ে। ঘুরেফিরে সেই একই কথা।


এ পথে গেলে বিদ্যমানতা যতোটুক বদলাবে তার চেয়ে নিজেদের মধ্যে বিকৃতি আসবে বেশি। এর অনেক প্রমাণ আমাদের সামনেই আছে। কাজেই এ পদ্ধতি কেবল অকার্যকর না, বরং মুসলিমের ঈমান ও আত্মপরিচয়ের জন্য ক্ষতিকর।


‘ইসলামী’ বিকল্প তৈরি: এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সব কিছুর ‘ইসলামী’ বিকল্প তৈরি করতে হবে। গান, সিনেমা, সাহিত্য, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, মিডিয়া, সবকিছুর। বাস্তবতা হল এসব ক্ষেত্রে আমরা শত্রুর সাথে পাল্লা দেয়ার ক্ষমতা রাখি না। এর মধ্যে দু-একটি ক্ষেত্রে কাজ করা সম্ভব হলেও শার’ঈ বিধিবিধান এবং এসব বলয়ের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজ করা সম্ভব না।


কাজেই ঈমান ও আমলের প্রতি হুমকির বিষয়টা এখানেও থাকছে। দাওরা হাদীস করার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর “জাতে উঠতে” ব্যস্ত হয়ে যাওয়া কওমী তরুণদের অবস্থা দেখলেই বিপদের মাত্রা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। পাশাপাশি এসব অঙ্গনে ঢুকে কাজ করতে হলে সেক্যুলার সাথে মিলেমিশে কিংবা তাল মিলিয়ে চলার প্রবণতা নিয়ন্ত্রন করাও খুবই কঠিন।


তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এই অঙ্গনগুলোতে কাজ করার কারণে যে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রতিপক্ষের তৈরি হয়েছে সেটা আমাদের নেই। এর জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। দৌড় প্রতিযোগিতায় দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বীর গতি সমান হলেও, যে ত্রিশ মিনিট আগে দৌড় শুরু করেছে সে বরাবরই সামনে থাকবে। আর আমরা তো গতির দিক থেকেও তাদের চেয়ে পিছিয়ে।


ফাইনালি এটাও মনে রাখা উচিৎ যে সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের সাথে আমাদের মোকাবিলার ধরন দাবা খেলার মতো না। এটা দাবা বা লুডুর মতো কোন সিকোয়েনশিয়াল গেইম না, যেখানে একজন চাল দেয়ার সময় অন্যজনকে চুপচাপ বসে থাকতে হয়। বরং এখানে দু’পক্ষ একই সাথে চাল দিতে পারে।


যার অর্থ হল, আপনি যখন বিকল্প তৈরি করে ধাপে ধাপে বিভিন্ন অঙ্গনে ও প্রতিষ্ঠানে অনুপ্রবেশ করে সেগুলো দখলের চিন্তা করবেন, সেক্যুলাররা তখন সেটা চুপচাপ বসে বসে দেখবে না। তারা আপনার চাল দেখবে, সেটা কাউন্টার করবে এবং আপনাকে কোণঠাসা করার জন্য নিজে অন্য কোন চাল দেবে। তাত্ত্বিকভাবে যে সরলরৈখিক চিন্তা আমরা অনেকে করি, বাস্তব দুনিয়া সেভাবে কাজ করে না।


কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিকল্প তৈরির পদ্ধতির সফলতার সম্ভাবনা আছে। তবে সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন গতানুগতিক চিন্তা থেকে বের হয়ে এসে ডিজিটাল মিডিয়া এবং প্ল্যাটফর্মগুলোর হিসেবি ব্যবহার। যেমন জৌ রৌগানের মত জনপ্রিয় পডক্যাস্ট কিংবা নিজস্ব নিউজ পরিবেশনা। তবে এই সম্ভাবনাগুলো সত্ত্বেও বিকল্প তৈরির এই পদ্ধতি কখনোই মূল স্ট্র্যাটিজি হতে পারবে না। এটা বেশি থেকে বেশি হলে সম্পূরক হিসেবে থাকতে পারে।


মূলত এধরনের ঘুরপ্যাঁচের পথের বদলে আমাদের বাস্তবতায় অনেক বেশি কার্যকরী পদ্ধতি হল সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের সামাজিক বৈধতাকে আক্রমন করা। বাঙ্গালি সংস্কৃতি, চেতনা, ইতিহাস, নৈতিকতা এবং রাজনীতির যে বয়ান তারা তৈরি করেছে সেটাকে সব দিক থেকে আঘাত করা এবং ব্যবচ্ছেদ করা। তাদের বয়ানকে ‘ইসলামীকরণ’ করার চেষ্টা বাদ দিয়ে প্রত্যাখ্যান করা। মুসলিম পরিচয়কে শক্ত ভাবে সামনে নিয়ে আসা। অনলাইনের পাশাপাশি, অফলাইনেও।


যে মেরুকরণ সেক্যুলাররা শুরু করেছে সেটাকে ব্যবহার করে সমাজের গ্রহণযোগ্য আলোচনার সীমানাকে ঠেলে আমাদের দিকে নিয়ে আসা। কোন কোন রাজনৈতিক অবস্থান সঠিক, কোন কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য কাঙ্ক্ষিত এবং কোন রাজনৈতিক ফলাফল অর্জন করা সম্ভব–এ ব্যাপারে মানুষের চিন্তাকে বদলে দেয়া। সহজ ভাষায়, মানুষের রাজনৈতিক চিন্তার সীমানাকে ‘শিফট’ করা। মানুষের চিন্তার ধরণকে পালটে দেয়া। মানুষের ওয়ার্ল্ডভিউ বদলে দেয়া।


যদি এই স্ট্র্যাটিজির ব্যাপারে একমত হওয়া যায়, তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন দাঁড়ায়-
এর বাস্তবায়ন কিভাবে হবে?


সেই আলোচনা আলাদাভাবে করতে হবে।

পরের পর্বের লিঙ্ক