লেখাটি “What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ” সিরিযের অংশ। আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে, সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে

আমাদের আলোচনা শুরু হয়েছিল একটা প্রশ্ন দিয়ে।

সমাজ ও রাষ্ট্রে ক্রমশ বাড়তে থাকা ইসলামবিদ্বেষ ও সেক্যুলারায়নের মোকাবিলা এবং বাংলার মুসলিমদের দ্বীন ও আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখতে হলে কী করণীয়?  

এ প্রশ্নের জবাব আমরা দেয়ার চেষ্টা করেছি মোট ৫টি ধারণাকে ব্যবহার করে।

  • সামাজিক আধিপত্য (Cultural Hegemony)
  • সাংস্কৃতিক যুদ্ধ  (Kulturekampf)
  • আর্থ-সামাজিক
  • সামাজিক শক্তি অর্জন
  • মেটাপলিটিকস (Metapolitics)

সামাজিক আধিপত্য: বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিমদের দুর্বলতার মূল কারণ সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠীর সামাজিক আধিপত্য। বাংলাদেশে তারা এমন এক সামাজিক কাঠামো তৈরি করেছে যা ইসলাম ও মুসলিমদের “অপর” এবং “শত্রু” হিসেবে দেখে, এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে পরিকল্পিতভাবে দূরে সরিয়ে রাখে। ইসলাম ও মুসলিমদের আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখতে হলে সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠীর সামাজিক আধিপত্য ভাঙ্গা আবশ্যক। ইসলাম ও সেক্যুলারিসমের এই সংঘাতই বাংলাদেশের সমাজ ও শাসনের প্রধান দ্বন্দ্ব। অন্য সব কিছু গৌণ।

সাংস্কৃতিক যুদ্ধ: সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠীর সামাজিক আধিপত্য ভাঙার পদ্ধতি হল বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে চালানো সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য সমাজে যে বিভাজন প্রচ্ছন্নভাবে আছে তা স্পষ্ট করে তোলা, ইসলাম ও সেক্যুলারিসমের দ্বন্দ্বকে সমাজের মূল প্রশ্নে পরিণত করা, এবং এর ভিত্তিতে সমাজের মেরুকরণ।

আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও বাস্তবতার আলোচনা: প্রতিপক্ষের সামাজিক আধিপত্য ভাঙ্গা এবং সেক্যুলার ব্যবস্থার কার্যকরী বিকল্প হিসেবে ইসলামকে উপস্থাপন করতে হলে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ও সমস্যা নিয়ে ইসলামের অবস্থান থেকে আলোচনা করতে হবে। স্রেফ ব্যক্তিগত জীবনে দ্বীন পালনের নাসীহাহ কিংবা সেক্যুলার ব্যবস্থার খণ্ডন বা সমালোচনা করে এটা হবে না।

সামাজিক শক্তি অর্জন: সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এবং ইসলামী বিকল্পের আলোচনা সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দিতে হলে বাস্তব দুনিয়াতে, তৃণমূলে কাজ করা আবশ্যক। তাই মুসলিমদের; বিশেষ করে তরুণদের এমন কিছু প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে যেখানে তারা একত্রিত হবার সুযোগ পাবে। যেগুলোর মাধ্যমে সমাজের সামনে এই আলোচনাগুলো তারা তুলে ধরতে পারবে।

মেটাপলিটিকস: এই সবগুলো উপাদান এক সাথে কাজ করবে সার্বিক মেটাপলিটিকাল ফ্রেইমওয়ার্ক বা পরিকল্পনার ভেতর। যার উদ্দেশ্য হল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশের চিন্তার ধরন আর ওয়ার্ল্ডভিউ পাল্টে দেয়া। কোন সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান সঠিক, কোন লক্ষ্যগুলো কাঙ্ক্ষিত, এবং কোন ফলাফলগুলো অর্জন করা সম্ভব–এ ব্যাপারে মানুষের চিন্তাকে বদলে দেয়া। যে কাঠামোর মধ্যে আজকের বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ চলছে সেটাকে অপ্রাসঙ্গিক, তামাদি বানিয়ে ফেলা। একে এমন এক কাঠামো দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যার মূল ভিত্তি হবে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়।

আমাদের বাস্তবতা, প্রেক্ষাপট, সীমাবদ্ধতা এবং সামর্থ্য বিবেচনায় বর্তমান পর্যায়ে এটি আমার মতে বাংলাদেশের মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর কর্মপদ্ধতি। এবং আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।

***

সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠীর সামাজিক আধিপত্য ভাঙ্গা, সামাজিক শক্তি অর্জন এবং সমাজের মানুষের চিন্তায় মেটাপলিটিকাল পরিবর্তন না আনলে যতোই ক্ষমতার পালাবদল হোক না কেন, বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিমদের অবস্থার উন্নতি হবে না। বরং সেক্যুলারাইযেইশান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দিন দিন সমাজে ইসলামের জায়গা আরও সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। বাড়বে ইসলামবিদ্বেষ, অশ্লীলতা, অবক্ষয় এবং অবমাননা।

অন্যদিকে মুসলিমদের আবেগ বারবার শুধু সেক্যুলার রাজনীতির খেলায় ব্যবহৃত হতে থাকবে। নির্বাচনের সময় নেতানেত্রীদের হাতে তসবীহ উঠবে, মাথায় বসবে কাপড় কিংবা টুপি, পিঠে হাত বুলিয়ে কিছু ফাঁপা প্রতিশ্রুতিও দেয়া হবে। ক্ষমতার লড়াইয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজপথের দখল নিতে ইসলামী দলের কর্মী কিংবা মাদ্রাসাছাত্রদের গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। তারপর ক্ষমতা পাকাপোক্ত হবার পর সব কিছু বদলে যাবে। কোন বিদেশী প্রভু হয়তো “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” ঘোষণা করবে। আরেক প্রভু হয়তো “অখন্ড ভারত” এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইবে। আর প্রভুদের খুশি করতে গিয়ে বলির পাঁঠা বানানো হবে ইসলামপন্থীদের। গতকালের মিত্ররা সক্রিয় শত্রু হয়ে যাবে। এমনটাই হবে, এমনটাই হয়ে এসেছে।

এই চক্র ভাঙ্গতে হবে। এবং এই চক্র ভাঙ্গা সম্ভব, বিইযনিল্লাহ।

চিন্তা করে দেখুন বাংলাদেশের মুসলিমদের কাছে কী কী রিসোর্স আছে।

আমাদের আছে একটি পূর্ণাঙ্গ নৈতিক, আত্মিক, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা—ইসলামী শরীয়াহ। অর্থাৎ বিদ্যমান কলুষিত ব্যবস্থার রেডিমেইড বিকল্প আমাদের হাতে আছে। এবং এটি হল এমন বিকল্প যা পরিপূর্ণ ও প্রমাণিত। এটি নিছক তাত্ত্বিক বা কাল্পনিক কিছু না। এই ব্যবস্থা প্রবল প্রতাপের সাথে একসময় বিশ্বকে শাসন করেছে, জন্ম দিয়েছে হাজার বছরের চোখধাঁধানো সভ্যতার। এবং আজো এই ব্যবস্থা বাস্তবায়নযোগ্য। 

আমাদের পেছনে ইতিহাস আছে। আছে এই বাংলাতেই সাড়ে পাঁচশো বছরের বেশি মুসলিম শাসনের ঐতিহ্য।

আমাদের আছে এমন এক আকীদাহ যা আসমান ও যমীনের সব কিছুর চেয়ে বেশি দামি। যার জন্য হাসিমুখে মানুষ জানমাল কুরবান করতে পারে। এমন আকীদাহ যা পৃথিবীকে শাহাদাতের মর্যাদা আর অর্থ শিখিয়েছে।

আমাদের আছে জনশক্তি। সেক্যুলার রাজনৈতিক দলগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে জনসমাগম করতে হিমশিম খেয়ে যায়। রাজপথের দখল নেয়ার জন্য তাদের নিতে হয় নানা চিন্তা, পরিকল্পনা আর প্রস্তুতি। অন্যদিকে যখন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) এর দিকে আহ্বান করা হয় তখন মাদ্রাসার ছাত্র হোক কিংবা সেক্যুলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, মুমিনরা দলে দলে রাস্তায় নেমে আসে। তাও বিনা খরচে, কোন সমন্বয় কিংবা পরিকল্পনা ছাড়াই।

আমাদের সাথে তরুণরা আছে, আছেন প্রাজ্ঞ আলিমরাও।

এবং সবার প্রথমে এবং সবার শেষে আমাদের সাথে আসমান ও যমীনের একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ জাল্লা ওয়া ‘আলা আছেন। নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের মাওলা আর কাফিরদের কোন মাওলা নেই।

এতো কিছুর থাকার পরও আমরা যদি ইসলামকে সমাজের প্রধান শক্তি হিসেবে হাজির করতে না পারি, এ মাটিতে মুসলিম পরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, তাহলে এর দায় পুরোপুরি আমাদের। এটা আমাদের চিন্তার দুর্বলতা, কল্পনার অক্ষমতা, সদিচ্ছার অভাব এবং নিজেদের অযোগ্যতা ছাড়া আর কিছু না। এবং আমাদের এমন অযোগ্যতা এবং ব্যর্থতা ইতিহাস হয়তো ক্ষমা করবে না।

যা কিছু দরকার তার অনেক কিছুই আমাদের আছে। এখন প্রয়োজন উদ্যোগ, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা, হিম্মত, সবর, হিকমাহ, তাওয়াক্কুল, ইখলাস, কুরবানী এবং তাকওয়ার।

আমাদের সম্পদ ও সামর্থ্য এতো দিন আমরা অন্যদেরর পেছনে খরচ করেছি। আমরা হয়েছি অন্যদের স্বার্থসিদ্ধি আর ক্ষমতায় চড়ার সিড়ি। আমাদের যমিনে আমাদের সামনেই গড়ে তোলা হয়েছে কুফরর প্রাসাদ। আমাদের মিনারগুলোর ওপর ওড়ানো হয়েছে বিজাতীয় আদর্শের নিশান। আর আজ পুরো কওম, পুরো সমাজ, পুরো জাতিকে এর কুফল ভোগ করতে হচ্ছে। এই ঐতিহাসিক ভুল শোধরানোর সময় হয়েছে। সময় হয়েছে ইতিহাসের দেয়া দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার।

যদি আমরা না হই, তাহলে কারা?

যদি এখন না হয়, তাহলে কখন?

***

সমুদ্রে স্রোত আসবেই। কিন্তু সমুদ্র পাড়ি দিতে হলে অনাগত স্রোতের ভরসায় বসে থাকা যায় না। গন্তব্যহীনের মতো নিজেকে স্রোতের ওপর ছেড়েও দেয়া যায় না। হ্যা, স্রোত আসবে। কিন্তু সেই অন্ধ স্রোতকে পথ দেখাতে হবে। পরিচর্যা করে তাকে আরও শক্তিশালী, আরও ব্যাপক, আরও সর্বগ্রাসী করে তুলতে হবে। তারপর স্রোতের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগোতে হবে গন্তব্যের দিকে। এই সক্ষমতা এবং দক্ষতা রাতারাতি তৈরি হবে না। তা গড়ে তুলতে হবে ধাপে ধাপে, ধীরে ধীরে।

প্রয়োজনীয় সব উপাদান আমাদের সাথেই আছে, আলহামদুলিল্লাহ। এখন প্রয়োজন সেই অগ্রগামী দলের, সেই নাবিকদের, দুর্গম সমুদ্র পাড়ি দেয়ার স্পর্ধা দেখানো সেই অভিযাত্রিকদের, যারা কওমকে পথ দেখিয়ে গন্তব্যে নিয়ে যাবে।

কাজটা সহজ না। কাজটা সস্তা না। এমন যাত্রায় অবধারিতভাবেই মুখোমুখি হতে হয় ঝড়-ঝঞ্ঝার। দিতে হয় চড়া মূল্য। এটাই ইতিহাসের রীতি, এটাই পরিবর্তনের দাম। এবং এই দাম অন্যায্য না। অগ্নিকুণ্ডের তীব্র উত্তাপেই লোহা ইস্পাতে পরিণত হয়। স্বর্ণকে শুদ্ধ হতে হয় আগুনে পুড়েই।  

আমি আশা করি এই আলোচনা অভিযাত্রিকদের সেই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে, দেখাতে এবং তা বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করবে।

নিঃসন্দেহে সাফল্য ও তাওফীক কেবল আল্লাহরই পক্ষ থেকে। এই আলোচনায় যদি কল্যাণকর কিছু থেকে থাকে তাহলে তা কেবল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর এতে যা কিছু ভুলভ্রান্তি এবং অকল্যাণ রয়েছে তা আমার এবং শয়তানের পক্ষ থেকে।

নিশ্চয় সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর, সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ), তাঁর পরিবার ও সাহাবীদের ওপর।

[সমাপ্ত]