পর্ব ১২
লেখাটি "What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ" সিরিযের অংশ। আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে, সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে
ইসলামী দাওয়াহকে সত্যিকারভাবে সামাজিক শক্তিতে পরিণত করতে হলে ব্যক্তিগত অঙ্গন থেকে একে বের করে আনতে হবে। আর তা করার অন্যতম উপায় হল আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ও সমস্যা নিয়ে ইসলামের অবস্থান থেকে আলোচনা নিয়ে আসা। শুধু বিদ্যমান ব্যবস্থার সমালোচনা করে সমাজের নেতৃত্ব অর্জন করা সম্ভব না।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে ফিরিঙ্গিরা খুব দক্ষভাবে ইসলামী শাসন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙ্গে ফেলে সেখানে বসায় ইউরোপ থেকে আমদানী করা বিভিন্ন কাঠামো। ফিরিঙ্গিরা চলে যাবার পর থেকে তাদের বাদামী চামড়ার আদর্শিক সন্তানরা সেই ব্যবস্থাকেই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বে আজ যে রাষ্ট্রগুলো আছে, সেগুলো আসলে ভিন্ন নামে, ভিন্ন মুখোশে আর কিছুটা ভিন্ন পদ্ধতিতে সেই ঔপনিবেশিক শাসনেরই ধারাবাহিকতা।
অধিকাংশ মানুষ আজ তাই ইসলামকে দেখে বিমূর্ত আকীদাহ আর ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলের কিছু আচারআচরণের সমষ্টি হিসেবে। ইসলামকে সামাজিক শক্তিতে পরিণত করতে হলে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলাতে হবে।
যতোক্ষণ মানুষ ইসলামকে শুধু ‘আসমানের ওপরের আর যমিনের নিচের’ আলোচনা হিসেবে দেখবে ততোক্ষণ ইসলামী ব্যবস্থা অধিকাংশের কাছে একটা তাত্ত্বিকতা হিসেবেই থেকে যাবে। বাস্তব সমাধান হিসেবে ইসলামের কথা তারা চিন্তা করবে বা চিন্তা করতে পারবে না।
আর তার জন্য প্রয়োজন আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোকে ইসলাম কিভাবে ব্যাখ্যা ও মোকাবেলা করতে শেখায় তা মানুষের সামনে তুলে ধরা। আমাদের মূল্যবোধ আর আদর্শ মানুষের মধ্যে অনুরণিত হবে যখন ইসলামকে আমরা তাদের সমাজ ও জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান হিসেবে দেখাতে পারবো।
আর এ কাজটা আমাদের জন্য নতুন হলেও খুব একটা কঠিন হবার কথা না। সামাজিক দিক থেকে চিন্তা করলে মডার্নিটির (আধুনিকতা) অসুখগুলোর তৈরি সমাধান ইসলামের মধ্যেই আছে।
আমাদের সমাজের প্রধান সমস্যাগুলোর কথা চিন্তা করুন।
মাদক, নারী নির্যাতন, ধর্ষন, যিনা, পরিবারের ভাঙ্গন, পর্নোগ্রাফি আসক্তি, যৌন বিকৃতি, পৌত্তলিক সংস্কৃতির আগ্রাসন, ডিপ্রেশন, আত্মহত্যা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, দুর্নীতি, অপরাধ...এধরনের অনেক সমস্যার সামগ্রিক সমাধান ইসলামী শিক্ষা ও বিধান থেকে পাওয়া যায়।
আধুনিক সাইকোলজিস্টের কাউন্সেলিং আর মনমগজ অবশ করে দেয়া ওষুধের চেয়ে তাসাউফ, তাযকিয়াতুননাফস, যুহুদ, এবং ক্বা’নার শিক্ষা অনেক বেশি ফুলফিলিং। ফ্রয়েড কিংবা কার্ল ইয়ুং এর চেয়ে মনের ডাক্তার হিসেবে অনেক বেশি স্বার্থক আল-গাযযালি, ইবনু জাওযী কিংবা ইবনুল কাইয়্যিমরা। আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারাক আর আহমাদ ইবনু হানবালদের শিক্ষার তুলনায় হাল আমলের ভাসাভাসা আধ্যাত্বিকতা ছেলেখেলার মতো।
কাঁচামালগুলো আমাদের হাতেই আছে, আমাদের শুধু সেগুলো উপযুক্তভাবে কাজে লাগাতে হবে। পশ্চিমের অন্ধ অনুসরণের মনোভাব বাদ দিলে এটা অসাধ্য কিছু না।
অর্থনৈতিক সমস্যার ক্ষেত্রেও ইসলামের অবস্থান থেকে আলোচনা আনা সম্ভব। আর্থসামাজিক উন্নয়নে যাকাত, সাদাকাহ এবং করদ্বে হাসানের সম্ভাবনা পশ্চিমা অ্যাকাডেমিকরাও এখন স্বীকার করে। পশ্চিমা বিশ্বের ধনী দেশগুলো মিলে রাষ্ট্রীয়ভাবে মোট যতোটুকু মানবিক ত্রাণ (হিউম্যানেটেরিয়ান এইড) দেয়, মুসলিমদের দেয়া বাৎসরিক যাকাতের পরিমাণ তার চেয়ে কমপক্ষে পনেরো থেকে বিশ গুণ বেশি।
গ্রামীণ ব্যাংকের সুদ ভিত্তিক মাইক্রোফাইন্যান্স মডেলের চেয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে অনেক বেশি সফল পাকিস্তানের আখুওয়াতের করদ্বে হাসানাহ ভিত্তিক মাইক্রোফাইন্যান্স মডেল। পশ্চিমের এজেন্ডা পালন করে যাওয়া আগাছার মতো এনজিও-গুলোর চেয়ে সফলতা বেশি কওমী মাদ্রাসাগুলোর।
অন্যদিকে আধুনিক ফিনটেকের (fintech) বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে মুদারাবা এবং মুশারাকার মতো চুক্তি ব্যবহার করে ব্যাংকের সুদভিত্তিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে অতি-ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিকল্প অর্থায়নের আছে ব্যাপক সম্ভাবনা।
এছাড়া আইনী ব্যবস্থার আগে ইসলাম হল একটি নৈতিক ব্যবস্থা। ইসলাম শুধু আইন দেয় না, বরং এমন ব্যক্তি ও সমাজ তৈরি করে যারা গভীরভাবে কিছু নৈতিক শিক্ষার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামের এই নৈতিক শিক্ষাগুলো সুদ, ঘুষ, মজুতদারি, স্পেকুলেটিভ ট্রেইডিং (শেয়ারবাজারের ফটকাবাজি), প্রেডেটোরি লেন্ডিংসহ অনেক আধুনিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে।
পরাজিত মানসিকতার মুসলিমরা সমাজ কল্যাণের মডেল হিসেবে এখন পশ্চিমের কল্যাণরাষ্ট্রের দিকে তাকায়। কিন্তু কল্যাণরাষ্ট্রের চেয়ে আরো কার্যকরী এবং টেকসই সমাধান আমরা পাই ইসলামী ওয়াকফ ব্যবস্থার মধ্যে। ইসলামী শাসনামলে অধিকাংশ মুসলিম ভূখন্ডের ৪০-৫০ শতাংশ ভূমি মালিকানা ছিল ওয়াকফের অধীনে। সমাজ ও অর্থনীতিতে আওকাফ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে ওয়াকফের আর্থ-সামাজিক সম্ভাবনা অসীমের কাছাকাছি।
ওপরে বলা প্রতিটা বিষয়ের আলোচনা আরো বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এবং বর্তমান বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সীমিতভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব।
হ্যা, আমাদের কাজের সুযোগ সীমিত। এই সম্ভাব্য সমাধানগুলোর অনেকগুলোই, এমনকি অধিকাংশই হয়তো বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব না। কিন্তু এই বিকল্পগুলোর, আধুনিক সমস্যার এই সমাধানগুলোর আলোচনা উপস্থাপন করতে তো সমস্যা নেই। বরং এই ধরণের উপস্থাপনাই মানুষের মধ্যে ইসলামী ব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষাকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে।
ইসলামী শাসন কী জিনিস, ইসলামী শাসন কেমন ছিল, আধুনিক মানুষ তা জানে না। আমাদের কারো ইসলামী শাসন প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়নি। তবু ইমানের জায়গা থেকে, তাকওয়া এবং ভালোবাসার জায়গা থেকে আজো সাধারণ মুসলিমরা বলে তারা ইসলামী শাসন চায়। চিন্তা করুন, তাদের সামনের ইসলামী শাসনের বাস্তবতা, এর উৎকর্ষ ছিল, এবং কিভাবে ইসলামী শাসন আজো আমাদের জীবনকে সুন্দর করে তুলতে পারে তার কিছু উদাহরণ যদি তুলে ধরা যায় তাহলে তাদের মনে ইসলামী ব্যবস্থার প্রতি আকর্ষন কেমন হবে?
নিঃসন্দেহে জানার পর, এক ঝলক দেখার পর আকর্ষন আরো তীব্রতর হবে।
হ্যা, সেক্যুলারিসম, লিবারেলিসম, ফেমিনিসমসহ মডার্নিটির সৃষ্ট বিভিন্ন বাদমতবাদের খণ্ডন প্রয়োজন। নাস্তিকদের আদর্শিক মোকাবিলা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের সামাজিক আধিপত্যকে চিহ্নিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের আধিপত্যের এই কাঠামোকে নষ্ট করা আবশ্যক।
এ সবই সঠিক। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট না। এগুলোর পাশাপাশি সমাধান হিসেবে ইসলামের আলোচনা আনাও প্রয়োজন। এবং সেটা শুধু ঢালাও কিছু বক্তব্য, মুখস্থ কিছু বুলি আউড়ে না। বরং অন্তত কিছু ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট এবং বিস্তারিত আলোচনা মানুষের সামনে উপস্থাপন করা জরুরী।
ধরুন, বাজারে তেলের দাম বেড়ে গেল। পত্রিকায় প্রতিবেদন আসলো সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে জনপ্রিয় বক্তারা আলোচনা করে দেখাতে পারেন –ইসলামী শাসনের অধীনে কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা হতো। কিভাবে মুহতাসিব বা বাজার পরিদর্শকরা ইসলামী শাসনামলে নিয়মিত এসব বিষয়ে নজরদারি করতেন। ইসলামী শাসনের অধীনে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর মতো অপরাধের শাস্তি কী হতো। এবং কিভাবে ইসলামী ব্যবস্থার তুলনায় আধুনিক সেক্যুলার, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এসব সমস্যার সমাধানে অক্ষম।
একইভাবে জনপ্রিয় লেখকরা এব্যাপারে আলোচনা করতে পারেন। এই ধরণের বিষয়ের ওপর ওয়েবিনার বা সেমিনারও হতে পারে।
লক্ষণীয় বিষয় হল, ইসলামের অবস্থানগুলো আদতে দেশে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, সেটা এখানে মুখ্য না। বর্তমান সেক্যুলার রাষ্ট্রে ইসলামের সমাধান বাস্তবায়নের আশা করা যায় না। এখানে মূল উদ্দেশ্য হল সাধারণ মানুষের সামনে ধীরে ধীরে একটা বর্তমান ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে ইসলামী ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করা। অমুক সরকারের বদলে তমুক সরকারের চিন্তা থেকে বের হয়ে মানুষের চিন্তাকে সেক্যুলার ব্যবস্থার বদলে ইসলামী ব্যবস্থার সমীকরনে নিয়ে আসা।
আরও একটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার। সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের সামাজিক আধিপত্য নষ্ট করে ইসলামকে সামাজিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। এই কাজের জন্য প্রয়োজন যোগ্য, আন্তরিক এবং আত্মত্যাগের মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ। শুধু খণ্ডন, সমালোচনা, ইত্যাদি দিয়ে সাধারণত এধরণের মানুষকে আকৃষ্ট করা যায় না।
মডার্নিটির সমালোচনা হোক। এই সমালোচনা দরকার, এই সমালোচনা অপরিহার্য। কিন্তু দিন শেষে বিকল্প হিসেবে একটা সলিড লক্ষ্য দাড় করাতে হবে। এমন কোন কোন গন্তব্য, এমন কোন ভিশনকে সামনে রাখতে হবে যার জন্য মানুষ নিজেকে উজাড় করে দিতে প্রস্তুত থাকবে।
জঙ্গল অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে শুরু করলে দাবানলের দরকার হয়। কিন্তু নতুন করে বীজ বোনা না হলে দাবানল শেষে ভস্মীভূত ধ্বংসস্তূপ আর কিছুই বাকি থাকে না। তাই ভাঙ্গার পাশাপাশি নতুন করে গড়ার গুরুত্বও আমাদের বুঝতে হবে।