পর্ব ১০

লেখাটি "What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ" সিরিযের অংশ। আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে, সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে

আমরা আলোচনা করছিলাম, বাংলাদেশের মুসলিমদের দ্বীন ও আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখার জন্য করণীয় কী হতে পারে, তা নিয়ে। এখন পর্যন্ত আমরা তিনটি মূল ধারণার কথা আলোচনা করেছি।

১। সামাজিক আধিপত্য (Culrural Hegemony) 

২। সাংস্কৃতিক যুদ্ধ (Kulturkampf)

৩। মেটাপলিটিকস

বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর ইসলামবিরোধী সেক্যুলার-প্রগতিশীল এলিটদের নিয়ন্ত্রণ এবং মুসলিমদের দুর্বলতাকে আমরা সামাজিক আধিপত্য বা কালচারাল হেজেমনির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে পারি।

বিদ্যমান বাস্তবতায় আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো মাথায় রেখে সেক্যুলারদের এই আধিপত্য ভাঙার একটি মাধ্যম হিসেবে আমরা গ্রহণ করতে পারি সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে।

এই সাংস্কৃতিক যুদ্ধ চলবে মেটাপলিটিকাল সংগ্রামের আদলে। যার উদ্দেশ্য মানুষের চিন্তায় ‘গ্রহণযোগ্য রাজনীতির’ যে সীমানা আছে, সেটাকে প্রশস্ত করা। মানুষকে নিজেদের আদর্শের দিকে টেনে আনা। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশের চিন্তার ধরন আর ওয়ার্ল্ডভিউ পাল্টে দেয়া।

এই তিন তত্ত্বের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় চিহ্নিত করা যায় যেগুলোকে কেন্দ্র করে আমাদের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ শুরু হতে পারে। নিচে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল। তবে এর প্রতিটি নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব এবং দরকার।

১। ইসলামবিদ্বেষ: “বাংলাদেশে ইসলাম আক্রান্ত, ইসলামের বিধান পালনের কারণে, ইসলামী শরীয়াহ চাওয়ার কারণে মুসলিমরা বৈষম্য ও যুলুমের শিকার”- বারবার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে এই বাস্তবতা মানুষের মাথায় গেঁথে দিতে হবে। 

“বাংলাদেশ ৯০% মুসলিমের দেশ”- এই বক্তব্য থেকে বিদ্যমান অবস্থাকে বদলানোর চিন্তা তৈরি হয় না, বরং এক ধরণের আত্মতৃপ্তির মনোভাব তৈরি হবার আশঙ্কা থেকে। অন্যদিকে ইসলাম ও মুসলিমরা আক্রান্ত হবার বাস্তবতার ওপর ফোকাস করলে এই বাস্তবতা পরিবর্তনের কিভাবে হবে, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে জন্ম নেবে।

বৈষম্য ও যুলুমের শিকার হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই একে ইসলামবিদ্বেষ হিসেবে শনাক্ত করতে পারেন না। এবং এই ইসলামবিদ্বেষের পেছনে মূল চালিকাশক্তি কারা সেটাও চিহ্নিত করতে পারেন না সফলভাবে। তাদের মধ্যে এই সচেতনতা তৈরি করতে হবে। মুসলিম নামধারী সেক্যুলাররা যে চেতনা, প্রগতি, আধুনিকতা কিংবা অন্য কোনো অজুহাতে আইনী বা সামাজিকভাবে ইসলাম পালনকে অপরাধ সাব্যস্ত করে, তা সমাজের সামনে স্পষ্ট করতে হবে।

ইসলামবিদ্বেষের আলোচনাকে শক্তিশালী করতে হলে তিনটি বিষয় জরুরী -

ক) অ্যাকাডেমিক আলোচনা –শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, সিনেমা, সংবাদ কিংবা সুশীলতার নামে কে, কিভাবে ইসলামবিদ্বেষ প্রচার করছে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গবেষণা করে দেখাতে হবে। এই ইসলামবিদ্বেষের উৎস কী, কারণ কী, ধারক ও বাহক কারা তা তুলে ধরত হবে প্রামাণিকভাবে। এ ধরনের আলোচনা হবে দালিলিক এবং যুক্তিনির্ভর। আবেগনির্ভর না। আলোচনা এমন হতে হবে যাতে কেউ আদর্শিকভাবে আপনার সাথে দ্বিমত করলেও উত্থাপিত প্রমাণ যেন মেনে নিতে বাধ্য হয়। গবেষণাপত্র, জরিপ, জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদন, ডকুমেন্টারি, সাহিত্য সমালোচনা, শিল্প সমালোচনা, প্রবন্ধ, তথ্যনির্ভর বক্তব্য, ওয়াজ- অনেক ভাবেই এ ধরনের কাজ হতে পারে।

খ) বাস্তব উদাহরণ: ইসলামবিদ্বেষের বিভিন্ন উদাহরণ, মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে হবে। এই যুলুম ও বৈষম্যের ব্যাপারগুলো যে বিমূর্ত কিছু না, বরং আমাদের চারপাশের সমাজের বাস্তবতা, তা তুলে ধরার জন্য এ ধরনের আলোচনা অত্যন্ত জরুরী।

গ) ক্রমাগত প্রচারণা: যাতে এ বিষয়, এই বার্তা, এই শব্দগুলো এবং এ আলোচনাগুলো সমাজের সবার কাছে পৌঁছে যায়।

২। আত্মপরিচয়ের বয়ান: বাংলার মুসলিমদের আত্মপরিচয়ের একটি বয়ান তৈরি করা, যেখানে সবার আগে থাকবে ইসলাম। পাশাপাশি থাকবে এ অঞ্চলে মুসলিমদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস। এখানে দুটো বিষয় লক্ষ রাখা আবশ্যক।

ক) সংস্কৃতি গ্রহণ বা বর্জন করা হবে শরীয়াহর মাপকাঠি অনুযায়ী। সংস্কৃতিকে মাপকাঠি বানিয়ে ‘বাঙালি ইসলাম’ তৈরি করা যাবে না। বাঙালি পরিচয় প্রমাণ করতে গিয়ে ইসলামী শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক কিছু গ্রহণ করা যাবে না।

‘বাংলার মুসলিমরা সুফীবাদী, অসাম্প্রদায়িক। তারা সমন্বয়বাদে বিশ্বাসী, আরবের বেদুইন ইসলামের মতো না।'

অথবা,

'শত শত বছর ধরে এ অঞ্চলের মুসলিমরা অমুক তমুক রসম-রেওয়াজ পালন করে এসেছে, তাই এগুলো এ অঞ্চলের ইসলামের বৈশিষ্ট্য।'

এ ধরনের বয়ান অগ্রহণযোগ্য। আমরা শরীয়াহ অনুসরণে আদিষ্ট, বাপদাদার অন্ধ অনুসরণে না। ইসলাম বাদ দিয়ে মুসলিম পরিচয় হয় না। এক্ষেত্রে শহীদ তিতুমীর, হাজী শরীয়াতুল্লাহ এবং ইমাম সাইয়্যিদ আহমাদ শহীদ এর দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। রাহিমাহুমুল্লাহ।

খ) ইসলামী আন্দোলনগুলোকে সেক্যুলারাইয করা যাবে না। তিতুমীরকে “অসাম্প্রদায়িক স্বাধীনতাসংগ্রামী”, ফরায়েযী আন্দোলনকে “সর্বহারার প্রতিরোধ” হিসেবে চিত্রিত করা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে তাঁদের তাজদীদি আন্দোলনের প্রকৃত চরিত্র চাপা পড়ে, আর পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাঁদের দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নেয়া থেকে বঞ্চিত হয়। এ বাস্তবতা বুঝতে হবে।

গ) বাংলার মুসলিম ইতিহাসকে গুরুত্বের সাথে সমাজের সামনে আনতে হবে। এক্ষেত্রে শাহী বাংলা (সুলতানী আমলের বাংলা) বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলায় ইসলামের আগমণ ও বিজয়ের সাথে জড়িত নামগুলো আলোচনায় আনতে হবে।   

৩। ইতিহাসের বয়ান: ৪৭, ৭১ এবং ১৩ এর মত ঐতিহাসিক সময়গুলোর ব্যাপারে একটি ন্যারেটিভ তৈরি করতে হবে, যা ঐতিহাসিকভাবে সঠিক হবে আবার দ্বীনের সাথে আপস করবে না। ‘...আমরাও মুক্তিযুদ্ধ করেছি’, বা ‘...অমুক রাহিমাহুল্লাহ’ – এ জাতীয় কপি-পেইস্ট বক্তব্য এতে কার্যকর না। এধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের তৈরি করা ঐতিহাসিক বয়ানই মূলত গ্রহণ করে নেয়া হয়।   

৪। মূর্তি ভাঙা:  মোটা দাগে এর দুটি অংশ আছে:

ক) লিবারেল-সেক্যুলার ওয়ার্ল্ডভিউয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারণাকে চিহ্নিত করে আক্রমণ করতে হবে। যেমন: ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র, নারীবাদ, প্রগতি, মানবাধিকারের আলোচনা, ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণা, সেক্যুলার নৈতিকতা, বিশ্বশান্তি ইত্যাদি। এগুলোকে খণ্ডন করতে হবে অ্যাকাডেমিক এবং প্র্যাকটিকাল দিক থেকে।

খ) সাংস্কৃতিক জমিদারদের গড়ে তোলা সংস্কৃতিতে যেসব ব্যক্তি ও ধারণাগুলো পবিত্র মনে করা হয় সেগুলোকে আক্রমণ করতে হবে। যা কিছু তারা পরম শ্রদ্ধার সাথে বেদিতে বসিয়েছে, সব টেনে নামিয়ে আছড়ে আছড়ে ভাঙতে হবে।

চিন্তার সমালোচনা আর ব্যবচ্ছেদ, বিভিন্ন ব্যক্তি কিংবা ধারণার ব্যাপারে মানুষের মনে গড়ে ওঠা সমীহ ভেঙে ফেলা–সবই এর অংশ। তবে কখন কোন মূর্তিতে ফোকাস করা হবে তা চিন্তাভাবনা করে ঠিক করতে হবে।

৫। বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুকে কাজে লাগাতে হবে। এবং ইস্যুকে শেষ পর্যন্ত সিস্টেমস লেভেল সমস্যা হিসেবে দেখাতে হবে। যেকোনো ইস্যুকে ব্যবহার করে ইসলামবিদ্বেষ, বিদ্যমান কালচার ও ব্যবস্থার সমালোচনা, ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিকতা অথবা ইসলামী সমাধানের আলাপ নিয়ে আসতে হবে। মানুষ যেন বিচ্ছিন্ন বিষয়গুলোকে আস্তে আস্তে দুটো দ্বীনের সংঘাত হিসেবে দেখতে শুরু করে। প্রত্যেক ইস্যুকে দেখাতে হবে একটা যুলুমপূর্ণ, কলুষিত ব্যবস্থার ফলাফল হিসেবে। যাতে মানুষের চিন্তা কেবল বিচ্ছিন্ন ইস্যুতে সীমাবদ্ধ না থাকে। মূল সমস্যাকে যেন তারা চিনতে শেখে। যেমন:

ক) ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলাকে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক উগ্রবাদ হিসেবে তুলে ধরেছে, এই ব্যাপারে মূল বার্তা হতে পারে- 

"'আসসালামু আলাইকুম’ বলাকে জঙ্গিবাদ হিসেবে চিহ্নিত করা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না। এটা নিছক একজন ব্যক্তির কথাও না। বরং বাঙালি সংস্কৃতির নামে এমন এক ঘৃণাবাদী আদর্শ আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, যা এই ধরনের বক্তব্যের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের সেক্যূলার সমাজ এভাবেই ইসলামকে সংজ্ঞায়িত করে।"

খ) কোন সেলিব্রিটি নায়িকা/গায়িকা বলেছে, “পুরুষ যা ইচ্ছা পরতে পারলে নারী পারবে না কেন?”, এই ব্যাপারে মূল বার্তা হতে পারে,

“ইসলাম আমাদের শেখায় এই মহাবিশ্ব থেকে শুরু করে আমাদের শরীর, সম্পদ পর্যন্ত সব কিছুর মূল মালিক হলেন আল্লাহ। আমরা কেবল সাময়িক সময়ের জন্য এগুলো ব্যবহারের এখতিয়ার পেয়েছি। যেহেতু আল্লাহই মালিক, তাই আল্লাহর মালিকের ঠিক করে দেয়া নিয়ম মেনে চলতে হবে। চাইলেই আমি যেকোন খাবার আমার দেহে প্রবেশ করাতে পারবো না। যে কোন পোশাক পরতে পারবো না। যে কারো সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে পারবো না। এই শরীরের মালিক, এই সম্পদের মালিক, এই দুনিয়ার মালিক আমাকে নির্দিষ্ট নিয়ম দিয়েছেন। তিনিই নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক নিয়ম দিয়েছেন। মালিকের দেয়া নিয়ম আমাকে মেনে চলতে হবে। 

কাজেই মূল সমস্যা এখানে নারী বা পুরুষের অধিকার নিয়ে না। বৈষম্য নিয়েও না। মুল সমস্যা হল দ্বীন নিয়ে। এখানে দুটো দ্বীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। ইসলাম আমাদেরকে শেখায় চূড়ান্ত মালিক আল্লাহ, আমি তাঁর গোলাম। তাই আমি তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করবো। আর সেক্যুলার ব্যবস্থা, যেটা আজকে আমাদের সমাজকে নিয়ন্ত্রন করছে - সেটা শেখায় মানুষ নিজেই তার শরীরের মালিক, সে যা ইচ্ছা তাই করবে। দ্বীন ইসলাম শেখায় আল্লাহর আনুগত্য করতে, সেক্যুলারিসমের দ্বীন শেখায় নিজের খেয়ালখুশি, মিডিয়াতে প্রচার করা মূল্যবোধ আর মানুষের বানানো বাদমতবাদের আনুগত্য করতে। মূল দ্বন্দ্বটা আসলে দুটি দ্বীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব। কিন্তু আজকে আমাদের সমাজের মানুষ এই দুই দ্বীনের মধ্যে মিশ্রণ করছে। আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি কোন দ্বীনের অনুসরণ করবেন। আপনি কার আনুগত্য করবেন...”

৬। প্রতিপক্ষের বয়ানের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করা: এটা বিভিন্নভাবে হতে পারে। তাদের বয়ানকে খণ্ডন করে বিশ্লেষণ, যুক্তি-পাল্টাযুক্তির মাধ্যমে এটা হতে পারে। আবার সাংস্কৃতিক জমিদারদের বক্তব্য এবং অবস্থানগুলোকে ব্যঙ্গবিদ্রুপের মাধ্যমে হাস্যস্পদ করে তোলা, বিভিন্ন তুচ্ছার্থক শব্দ ও বিশেষণের প্রচলন ঘটানোর মাধ্যমেও হতে পারে। যেকোনো ভাইরাল ইস্যুতে জমিদারদের মূল যুক্তি/বক্তব্য চিহ্নিত করে সেগুলো নিয়ে মিম করার মাধ্যমেও হতে পারে। এসব কিছুর মূল উদ্দেশ্য হল জমিদারদের পাবলিক ডিসকোর্সকে শর্টসার্কিট করা।

৭। জমিদাররা শব্দ ও পরিভাষার প্রয়োগে বিভিন্ন ধ্যানধারণাকে বৈধ ও অবৈধ সাব্যস্ত করে। যেমন: ধর্মব্যবসা, মৌলবাদী, উগ্রবাদী, চরমপন্থী, জঙ্গি, প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক, মধ্যযুগীয়—এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করে মুসলিম পরিচয় এবং ইসলামের বক্তব্যকে তারা নাকচ করার চেষ্টা করে। আবার ‘ভারতবিরোধীতা’র নাম দিয়ে বাংলার মানুষের অনেক যৌক্তিক ক্ষোভকে উড়িয়ে দেওয়া হয়।

এই ধরনের শব্দ, পরিভাষা ও আলোচনাকে চিহ্নিত করে মানুষের সামনে তুলে ধরে খণ্ডন করতে হবে এবং এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করতে হবে। এবং পাল্টা, শব্দ, পরিভাষা এবং ট্রেন্ড তৈরি করতে হবে।

৮। সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিকল্প মিডিয়া গড়ে তোলা আবশ্যক। শান্তনু কায়সার বা এই ধরণের সাংবাদিকদের মতো ইউটিউব চ্যানেল, সাইফুর সাগরের মতো ফেইসবুক লাইভ ইত্যাদি।  পডকাস্ট, ফেইসবুক লাইভ, ওয়েবিনার—ইত্যাদি ফরম্যাটগুলো ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে।

৯। যেভাবে নাস্তিকতার বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এবং নাস্তিকতা বিরোধীতার একটি ট্রেন্ড চালু হয়েছে, তেমনিভাবে সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের সামাজিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে লেখালেখির ট্রেন্ড চালু করতে হবে। মেটাপলিটিকাল ভ্যানগার্ড বা এই সাংস্কৃতিক যুদ্ধের অগ্রগামী একটি দল প্রাথমিকভাবে এই ধারা চালু করায় ভূমিকা রাখতে পারে, কিন্তু মূল উদ্দেশ্য হবে যেন একসময় নিজে থেকেই এই লেখাগুলো বের হয়ে আসতে থাকে।

১০। মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারণায় জমিদাররা কিছু বিষয় বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করে। যেমন –

  • নারী (নারী অধিকার, বহুবিবাহ, সমতা ইত্যাদি)
  • যুদ্ধ-বর্বরতা (জিহাদ, হুদুদ, ইত্যাদি)
  • যৌনতা (হুর, দাসী, পর্দার বিধান ইত্যাদি)
  • পশ্চাৎপদতা, অজ্ঞতা (মোল্লা, ছাগু ইত্যাদি)
  • যেকোনো প্রকৃত বা আপাত নৈতিক স্খলনকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা

ইত্যাদি

এই বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়। সংবাদ প্রতিবেদন, গান, নাটক, উপন্যাস, বিজ্ঞাপন, দেয়ালচিত্র, পথনাটিকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্লগের অশ্লীল কৌতুক, কার্টুন—নানা পদ্ধতিকে তারা কাজে লাগায়।

একইভাবে আমরাও কিছু বিষয়কে চিহ্নিত করতে পারি, যেগুলো তাদের বয়ানকে আক্রমণ এবং আমাদের বয়ান প্রচারে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যাবে। এই বিষয়গুলো সঠিকভাবে বাছাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়গুলো কী হতে পারে তা নিয়ে আলাদা আলোচনা জরুরী। সম্ভাব্য কিছু থিম হতে পারে -

  • সেক্যুলারদের দ্বিমুখীতা
  • দুর্নীতি
  • আপসকামীতা (মুখে আদর্শের আলাপ কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে উল্টো করা)
  • নৈতিক স্খলন
  • সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের পারিবারিক জীবনের ব্যার্থতা
  • নারীবাদীদের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতা
  • সামাজিক অবক্ষয় (সবই সেক্যুলার ব্যবস্থার আর বহুল প্রচারিত ‘প্রগতি’র ফসল)
  • তাদের শান্তি ও অসহিংসতার বয়ানের ভন্ডামি
  • মানবাধিকারের বয়ান ও কাজের মধ্যে দ্বিমুখীতা

ইত্যাদি

এগুলো শুধু উদাহরণ হিসেবে যুক্ত করা। চূড়ান্ত কিছু না। ময়দান উন্মুক্ত। সংযোজনের ও বিয়োজনের সুযোগ আছে।

১১। ট্রোলিং এবং মিম: যদিও এরইমধ্যে একাধিকবার এ দুটো বিষয়ের কথা এসেছে, কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনায় এটি আলাদাভাবে উল্লেখ করা হলো। অনলাইনে মেটাপলিটিকাল স্ট্রাগলের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যমের অন্যতম হল ট্রোলিং এবং মিম। এর বিভিন্ন কারণ আছে।

A picture is worth a thousand words.

একটি ছবি হাজারও শব্দের চেয়ে শক্তিশালী।

তাছাড়া বর্তমান সময়ে মানুষের অ্যাটেনশান স্প্যান (দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা) কমে যাওয়াতে ছবির মাধ্যমে দেয়া মেসেজ, লেখার মাধ্যমে দেয়া মেসেজের চেয়ে বেশি কার্যকরী। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এসব ক্ষেত্রে শরয়ী সীমা মেনে চলার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। আল্লাহর অবাধ্যতা করে আল্লাহর দ্বীনের কাজ করে বারাকাহ আশা করা যায় না।

সংক্ষেপে উপরোক্ত বিষয়গুলোতে ফোকাস করে সাংস্কৃতিক যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শুরু করা যেতে পারে। তবে দুটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার।

প্রথমত, আদর্শিক বিশুদ্ধতা, আকীদাহগত দৃঢ়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অ্যামেরিকার গতানুগতিক ডানপন্থা অনেকদিক থেকে সফল হবার পরও সাংস্কৃতিক যুদ্ধে হারার বড় একটা কারণ হল তাদের আদর্শিক বিশুদ্ধতা ছিল না। আকীদাহ আমল ছাড়া নিছক বামপন্থীদের মতো অ্যাক্টিভিসম ইসলামের কোনো প্রয়োজন নেই।

দ্বিতীয়ত, মেটাপলিটিকাল এই সংগ্রামের জন্য অনলাইন নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনার জন্য অনলাইনের কাজ যথেষ্ট না। শুধু অনলাইনের প্রচারণার মাধ্যমে এ ধরনের সামাজিক পরিবর্তন আনার চিন্তা অবাস্তব। অফলাইনে উপস্থিতি এবং কাজ থাকা আবশ্যক। বিদ্যমান বাস্তবতায় সেই উপস্থিতি এবং কাজ ঠিক কিভাবে হতে পারে, সেটা ঠিক করাও বেশ কঠিন। তবে সেই আলোচনাতে অবধারিতভাবেই আমাদের যেতে হবে। 

পরের পর্বের লিঙ্ক