জুয়াড়িদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে,’the house always wins’। শেষ পর্যন্ত ক্যাসিনোই (জুয়াঘর) জিতবে। কিন্তু এই প্রচলন এবং আরো অনেক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও জুয়াড়িরা ধরে নেয় তারা ক্যাসিনোকে হারাতে পারবে। ক্যাসিনো একটা ব্যবসা, কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠান না। ব্যবসা মাত্রই প্রফিটের চিন্তা করবে। আর মাঝারী মানের কোন ব্যবসায়ীও নিজের প্রফিটকে র্যানডম চ্যান্স বা দৈবচয়নের ওপর ছেড়ে দেবে না। সমান সম্ভাবনার মায়া তৈরি করলেও ক্যাসিনোগুলো নিজেদের নেট প্রফিট নিশ্চিত করেই ‘খেলায়’ নামে। ক্যাসিনোগুলো এটা করে বিভিন্নভাবে। যেমন সাইকোলজিকাল ম্যানিপুলেইশন। ঝলমলে আলো, উষ্ণ উত্তেজক পরিবেশ, সুন্দরী নারী, দ্রুতগতির মিউযিক, ‘খেলোয়াড়দের’ জন্য বিনামূল্যে মদ, যাদের পকেট ভারী তাদের জন্য কমপ্লিমেন্টারি রুম – এসবই ক্যাসিনোতে ঢোকা একজন মানুষের মধ্যে তারল্য নিয়ে আসে। উত্তেজনা সৃষ্টি করে। একসময় ক্যাসিনোগুলোতে কোন ঘড়ি আর জানালা থাকতো না, যাতে সময় সম্পর্কে ধারণা করা না যায়। ক্যাসিনোর ভেতরে রাত ৩টা আর দুপুর ৩টার মাঝে তফাত নেই। এরকম বিভিন্নভাবে ক্যাসিনো জুয়াড়ির ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব সৃষ্টি করে। দরজা দিয়ে ঢোকা প্রতিটি মানুষকে যতো বেশিক্ষন সম্ভব আটকে রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হয় ক্যাসিনোগুলো।
তবে এই মনস্তাত্ত্বিক কৌশলগুলোর ওপরেই শুধু ক্যাসিনোগুলো নির্ভর করে না। তাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, খেলার নিয়মটা তারাই বানায়। একারণে প্রতিটা ‘খেলায়’ পরিসংখ্যানগতভাবেই ক্যাসিনোর একটা সুবিধা – স্ট্যাটিসটিকাল এজ (house edge) থাকে। সোজা বাংলায়, জুয়ার প্রতিটা খেলার নিয়মগুলোর এমনভাবে বানানো হয় যাতে করে দিনশেষে নিশ্চিত থাকে ক্যাসিনোর নেট প্রফিট। খেলতে হলে আপনাকে এই নিয়মেই খেলতে হবে - ক্যাসিনোর এ কর্তৃত্ব মেনে নিয়েই টেবিলে বসে জুয়াড়ি। এসবকিছু জানার ও বোঝার পরও অনেক জুয়াড়িরা মনে করে ক্যাসিনোকে তারা হারাতে পারবে। আর অতি, অতি অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তারা ভুল প্রমাণিত হয়। লাভের নেশায় নিয়মিত হারতে থাকে, কেউ সর্বস্বান্ত হয়। তবুও জেদ ধরে খেলা চালিয়ে যায়। জেতার চেয়ে তখন তাদের ঘাড়ে শক্ত হয়ে চেপে বসে খেলার নেশা। দিনশেষে ক্যাসিনোই জিতে – The house always wins.
বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা শর্তহীনভাবে প্রচার করা ও চাপিয়ে দেয়া ধর্ম গণতন্ত্রের সাথে ইসলাপন্থিদের সম্পর্কটা ক্যাসিনো আর জুয়াড়ির মতো। একপক্ষ সব নিয়ম তৈরি করে অন্যপক্ষ মাথা নিচু করে সেটা মেনে নেয়। নিয়ম বানানোর সময়েই সিস্টেমটা এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে করে কিছু নির্দিষ্ট লোক সুবিধা পায়, আর কিছু কিছু নির্দিষ্ট লোক পড়ে বেকায়দায়। তার ওপর যেকোন সময় এক পক্ষ পূর্ণ অধিকার রাখে খেলার যেকোন নিয়ম বদলে ফেলার। ক্যাসিনোর মতো গণতন্ত্রেও পকেট গরম লোকজনের কদর বেশি হয়। ইন থিওরি অ্যাটলিস্ট - গন্ডমূর্খ আর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষের পয়সার জেতার সমান সম্ভাবনা থাকে...
এরকম অনেক সাদৃশ্যের কথা বলা যায়। জুয়ার দৈবচয়ন আর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে (আংশিক) দৈবচয়নের ভূমিকার মধ্যেও সাদৃশ্য লক্ষ না করে পারা যায় না। তবে এই মূহুর্তে আমার কাছে যেটা সবচেয়ে রিমার্কেবল সাদৃশ্য মনে হচ্ছে, সেটা হল বারবার হারতে থাকা জুয়াড়ির সাথে ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিকদের সাদৃশ্য। জুয়াড়ি জানে যে সে হারবে, তবুও সে খেলা চালিয়ে যায়। সে খেলা চালিয়ে যায় পরাজয়, ঋণ, অপমান, লাঞ্চনা, আত্মধিক্কারের পরও। ‘খেলার নেশা’ তাকে পেয়ে বসে। খেলার মজাটাই মুখ্য, জেতা না – এই বলে এ ধরনের আচরণের সাফাই গায় অনেক জুয়াড়ি। যদিও শুরুতে সে খেলতে নামে জেতার লক্ষ্য নিয়েও।
ইসলামি গণতান্ত্রিকরাও বারবার হারে। এমনকি যখন জেতে তখনও হারে। নব্বইয়ের দশকে আলজেরিয়ার ইসলামিক স্যালভেইশান ফ্রন্ট, তুরক্সের নাযিমুদ্দীন এরবাকান, মিশরের মুরসি, গাযায় হামাস – উদাহরন আছে অনেক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কখনোসখনো অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ফলাফল চলে আসলে, ক্যাসিনো জাস্ট খেলার নিয়ম বদলে ফেলে। এক জায়গায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বোমা ফেলে, আরেক জায়গায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে হঠাতে টেলিভাইযড ম্যাসাকারে একদিনে ১৪০০ মানুষ মেরে ফেলে। পুরো খেলাই যে ওভাবে সাজানো। The house always wins.
এই পাতানো খেলায় বারবার হেরেও গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থিরা গণতন্ত্রের সাফাই গেয়ে যান। নিজেদের উন্মাদনার (আইন্সটাইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী) পক্ষে নানা ব্যাখ্যা দেন। আর একসময় তারাও - খেলার মজাটাই মুখ্য, জেতা না – এর মতো একটা কথা বানিয়ে নেন। যেমন, ইসলামপন্থী অনেক দল গণতন্ত্রকে প্রথমে গ্রহণ করে একটি কৌশল হিসেবে। তাদের পথচলা শুরু হয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা, খেলাফত প্রতিষ্ঠার এক পাইপ ড্রিম দিয়ে। কিন্তু এক পর্যায়ে গিয়ে তাদের আন্দোলনের ফোকাস চলে যায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার দিকে। টুল বা উপকরণ হিসেবে গণতন্ত্রকে ব্যবহার করার কথা বলে শুরু করলেও এক সময় তারা নিজেরাই স্থুল হাতে ব্যবহৃত-ব্যবহৃত হয়ে বলির পাঠা হয়ে যায়। যেমন ইখওয়ানুল মুসলিমীন ও জামায়াতে ইসলামীর সাথে সংযুক্ত অনেকেই ৭০ ও আশির দশকে – ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্র – এই যুক্তি এনেছিল। কিন্তু এখন অনেকের জন্যই এটা হয়ে গেছে – ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগে গণতন্ত্র।
মিশরের সাম্প্রতিক দুঃখজনক ঘটনার পর সবচেয়ে বেশি প্রচার হওয়া কথার মধ্যে একটা হল, ‘মিশরের ইতিহাসের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট…’! খুব গর্বের সাথে বলা হচ্ছে কথাটা। যেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়াটা কোন ক্রেডিটের ব্যাপার, বৈধতার পরিয়াপক এবং শার’ঈ উদ্দেশ্য। ছবিতে এখন আর ইসলাম নেই। সে জায়গা দখল করে নিয়েছে নির্বাচন আর গণতন্ত্রের দাবি। দেখুন যেটা ‘কৌশল’ সেটা এখন উদ্দেশ্য হয়ে গেছে। খেলার মজাটাই মুখ্য, জেতা না! পাশাপাশি অনেকে সরাসরি কিংবা ঘুরিয়েপ্যাচিয়ে এটাও বলছে, যে বর্তমানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা। এটাই সঠিক পদ্ধতি, আর যে এ পদ্ধতির বিরোধিতা করে সে হয় যায়নিস্টদের এজেন্ট, কিংবা আলে-সাউদের দালাল, অথবা রাজতন্ত্রের পক্ষে প্রচারণাকারী। যে ঘটনা গণতান্ত্রিক কুফরি পদ্ধতির রূঢ় বাস্তবতা এবং এর হুমকির প্রতি সচেতন হবার একটা ওয়েইক-আপ কল হবার কথা ছিল, সেটা হয়ে গেছে নিজেদের ভ্রান্তি আকড়ে থাকার অজুহাত। আবেগের উদার স্রোতে মহিমান্বিত করা হচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ভুলকে। পাড় জুয়াড়ির মতোই ইসলামী গণতান্ত্রিকরা প্রতি পরাজয়ের সাথে আরো বেশি টাকার বাজি ধরে, নামে আরো হাই স্টেইক্সের খেলায়। আর নিজেকে প্রবোধ দেয় - আর একবার মাত্র। এক দানে জিতলেই তুলে নেয়া যাবে লাভে-আসলে সব টাকা।
কৌশল পরিণত হয়েছে উদ্দেশ্যে। জাদু ফিরে গেছে জাদুকরের দিকে। একটা ম্যাকাভিলিয়ান লেভেলে পশ্চিমাদের এই মুন্সীয়ানার প্রশংসা না করার কোন উপায় নেই।
ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত একজন আরব নেতা কথা থেকে পুরো ব্যাপারটা সামড-আপ হয় –
ভেড়া সাজিয়ে আমরা তাদের নেকড়েদের জগতে পাঠাই আর সাবাড় হওয়া কঙ্কাল হয়ে তারা আমাদের কাছে ফিরে আসে।
The house always wins.