১৫ই মার্চ, ২০১৯। ক্রাইস্টচার্চ, নিউযিল্যান্ড।

দুপুরটা দেড়টার মিনিট পাঁচেক পর আন-নূর মসজিদের পাশের ড্রাইভওয়েতে ঢুকল একটা সুবারু আউটব্যাক। গাড়িটার প্যাসেঞ্জার সিটে রাখা তিনটে বন্দুক। চতুর্থ বন্দুকটা রাখা ড্রাইভারের সিট আর দরজার মাঝখানে। স্ট্রোভ লাইট লাগানো একটা এআর-১৫ সেমি অটোম্যাটিক রাইফেল। কারও দিকে ওটা তাক করলে ক্রমাগত জ্বলতে-নিভতে থাকা স্ট্রোভ লাইটের তীব্র আলোয় দিশেহারা হয়ে যাবে টার্গেট–বিশেষ করে অন্ধকার, সরু গলি, কিংবা হলওয়েতে। বন্দুকগুলোর গায়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে যত্নের সাথে লেখা হয়েছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মধ্যযুগের বিভিন্ন ইউরোপীয় নেতা আর আধুনিক শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের নাম। চালকের আসনে বসা আপাদমস্তক ট্যাকটিকাল গিয়ারে ঢাকা লোকটার পুরো শরীরে খালি জায়গা বলতে কেবল ক্লিন শেইভড মুখটুকুই। গায়ে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট আর মিলিটারি জ্যাকেট, হাতে ফিঙ্গারলেস গ্লাভস, হাঁটুতে নি-প্যাড, পায়ে প্রটেক্টিভ ট্যাকটিকাল বুট। মাথায় চাপানো হেলমেটের সাথে সতর্কতার সাথে লাগানো হয়েছে একটা গো-প্রো হেলমেট ক্যামেরা।

ড্রাইভওয়ের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে এনে, ইঞ্জিন চালু রেখেই এআর-১৫ হাতে নেমে এল বন্দুকধারী। পেছনের ট্রাংকে শোয়ানো দুটো অস্ত্রের মধ্য থেকে বেছে নিল সেমি অটোম্যাটিক শটগানটাকে। এআর-১৫ কাঁধে ঝুলিয়ে ধীরেসুস্থে মসজিদের মূল দরজার দিকে এগুলো শটগান হাতে। গাড়ির স্পিকারে তখন উচ্চৈঃস্বরে গান বাজছে। মসজিদের ভেতরে থাকা প্রায় দু শ মুসল্লি প্রস্তুতি নিচ্ছে জুমুআহর সালাতের। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ৫ সেকেন্ডের মধ্যে ৯ রাউন্ড গুলি ছুড়ল বন্দুকধারী। তারপর শটগান ফেলে হাতে তুলে নিল এআর-১৫। ঘড়িতে তখন একটা বেজে চল্লিশ মিনিট।

পরের দু-মিনিট মসজিদের ভেতর শান্ত, নির্বিকার ভঙ্গিতে নির্বিচারে গুলি চালাল বন্দুকধারী। ঠান্ডা মাথায় গুলি করে মারল মসজিদের করিডোর আর কোনায় আটকা পড়া মুসলিমদের। দু-মিনিট পর গাড়ির কাছে ফিরে এসে আরেকটা সেমি অটোম্যাটিক রাইফেল নিয়ে আবারও ঢুকল মসজিদে। ততক্ষণে মসজিদ মোটামুটি খালি হয়ে গেছে। মৃতদেহগুলোর মাঝে যারা আহত হয়ে পড়ে ছিল এবার তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করল। পুরো ব্যাপারটায় খরচ হলো মাত্র ৭০ সেকেন্ড। তারপর বেরিয়ে এল মসজিদ থেকে। দরজার সামনে থাকা অবস্থায় দূর থেকে গুলি করল দেয়ালের ফাঁক দিয়ে পালানোর চেষ্টারত একজন মহিলাকে। আহত হয়ে মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকা অবস্থায় তার মাথায় আরও দু-বার গুলি করল খুব কাছ থেকে। তারপর ট্রাংক বন্ধ করে চেপে বসল গাড়িতে। ড্রাইভওয়ে থেকে বের হবার সময় মাড়িয়ে দিলো মহিলার মৃতদেহ। সুবারু আউটব্যাক ফুল স্পিডে ছুটল ৫ কিলোমিটার দূরের লিনউড ইসলামিক সেন্টারের দিকে। ঠান্ডা মাথায় প্রতিটি ধাপ হিসেব করে চালানো পুরো হামলাটা হেলমেটে লাগানো গো-প্রো ক্যামেরার মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার হলো ফেইসবুকে।

ব্রেন্টন ট্যার‍্যান্ট এর লাইভ ভিডিও থেকে স্টিলস

১.৫৫ তে লিনউড ইসলামিক সেন্টারের সামনে পৌঁছল বন্দুকধারী। প্রথমদিকে ঢোকার দরজার খুঁজে না পেয়ে গুলি করতে শুরু করল মসজিদের বাইরে থেকেই। গুলিবিদ্ধ হলো মসজিদের বাইরে থাকা বেশ কয়েকজন। বন্দুকধারী শেষ পর্যন্ত যখন মসজিদের ভেতর ঢুকে গুলি করতে শুরু করল ততক্ষণে মসজিদ থেকে বের হয়ে গেছেন অধিকাংশ মুসল্লি। কিছুক্ষণ পর গুলি শেষ হলে অস্ত্র বদলানোর জন্য গাড়ির কাছে পৌঁছালে ওর ফেলে দেয়া শটগানই ওর দিকে ছুড়ে দিলেন একজন মুসলিম। সম্ভবত প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত গাড়ি নিয়ে বের হয়ে এল ও। ২.২০ এর দিকে তৃতীয় টার্গেটের দিকে যাবার সময় ওকে গ্রেফতার করল পুলিশ।

গ্রেফতার হবার আগে দুই মসজিদের ভেতর মোট ৫০ জন মুসলিমকে হত্যা করা এ হামলাকারীর নাম ব্রেন্টন হ্যারিসন ট্যার‍্যান্ট। অস্ট্রেলিয়ান, বয়স ২৮।

ট্যার‍্যান্টের ম্যানিফেস্টো

ব্রেইভিকের মতোই হামলার অল্প কিছুক্ষণ আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ ৩০টি ইমেইল অ্যাড্রেসে নিজের লেখা ৭৩ পৃষ্ঠার ম্যানিফেস্টো পাঠায় ট্যারান্ট। সেই সাথে ম্যানিফেস্টোর ডাউনলোড লিংক এবং হামলার লাইভস্ট্রিমের লিংক পোস্ট করে টুইটার এবং ৮-চ্যানে[1]। ম্যানিফেস্টোতে নিজের অনুপ্রেরণা হিসেবে বিশেষভাবে ব্রেইভিকের নাম উল্লেখ করে ট্যার‍্যান্ট। ব্রেইভিকের ১,৫০০ পৃষ্ঠার ম্যানিফেস্টো ছিল এলোমেলো, বিশৃঙ্খল। অন্যদিকে হামলার মতোই ট্যার‍্যান্টের ম্যানিফেস্টোও ছিল গোছানো, হিসেবি। ‘দা গ্রেইট রিপ্লেইসমেন্ট’ নামের এ ম্যানিফেস্টোর বক্তব্য অনুযায়ী হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল এশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে চলা অভিবাসনের স্রোত বন্ধ করা। পশ্চিমা সরকার এবং কর্পোরেশানগুলোর পলিসির মাধ্যমে উৎসাহিত এ বৈধ অভিবাসনকে ট্যারান্ট দেখে ‘আগ্রাসন’ হিসেবে। একদিকে দিন দিন সাদাদের জন্মহার কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে অভিবাসীদের সংখ্যা। আবার দেখা যাচ্ছে অভিবাসীদের জন্মহার সাদাদের চেয়ে অনেক বেশি।

ব্রেইভিকের মতো ট্যারান্টেরও উপসংহার হলো, এ সমীকরণের অবধারিত ফলাফল শ্বেতাঙ্গ জাতি এবং ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিলুপ্তি। ট্যার‍্যান্ট মনে করে পশ্চিমের এ পতনের পেছনে অভিবাসন ছাড়া অন্য আরও অনেক কারণ আছে। পশ্চিমের অবক্ষয় ও আদর্শিক দৈন্য নিয়েও সে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। কিন্তু এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় হুমকি হলো অভিবাসন। তাই যেকোনো মূল্যে একে থামাতে হবে। ট্যারান্ট নিজেকে দেখে ইউরোপিয়ানদের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য অপরিহার্য এ দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করা একজন সাধারণ শ্বেতাঙ্গ হিসেবে। তার এ হামলার উদ্দেশ্য হলো অভিবাসীদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া, পশ্চিমে তারা নিরাপদ না। ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউযিল্যান্ড এগুলো সাদাদের জন্য, সাদাদের জায়গা। অভিবাসীরা এখানে আর আমন্ত্রিত না।

এ হামলার জন্য মসজিদ বেছে নেয়ার কারণ নিয়েও নিজ ম্যানিফেস্টোতে খোলাখুলি আলোচনা করে ট্যার‍্যান্ট। পশ্চিমে আসা অভিবাসীদের মধ্যে সংখ্যাগুরুদের অন্যতম মুসলিমরা। মুসলিমদের আছে শক্তিশালী ঐতিহ্য, মজবুত সামাজিক বন্ধন এবং উচ্চ জন্মহার। এসব কারণে ‘আগ্রাসী’ হিসেবে মুসলিম অভিবাসীরা বেশি বিপজ্জনক। এ ছাড়া ইসলামের আছে ইউরোপের সাথে হাজার বছরের সংঘাতের ইতিহাস। সব অভিবাসীর মধ্য থেকে শ্বেতাঙ্গদের কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত হলো মুসলিমরা। তাই তাদের হামলা করলে পাওয়া যাবে সবচেয়ে বেশি সমর্থন।

ম্যানিফেস্টোর বক্তব্য অনুযায়ী, হামলার অন্যান্য লক্ষ্যের মধ্যে আছে পশ্চিমের সাথে মুসলিমদের সংঘাতকে আরও তীব্র করা এবং পশ্চিমা সভ্যতার অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও অস্থিশীলতা বৃদ্ধি করা, বিশেষ করে উদারনৈতিক বামপন্থী এবং ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে। কারণ, পচে যাওয়া পশ্চিমা সভ্যতার শুদ্ধির জন্য ধ্বংস আর সশস্ত্র বিল্পব ছাড়া অন্য কোনো পথ এখন আর খোলা নেই। পাশাপাশি অস্ত্র আইনকে কেন্দ্র করে অ্যামেরিকান লিবারেল আর জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে মেরুকরণ বাড়ানোও উদ্দেশ্য। ট্যারান্টের বিশ্বাস, মার্কিন সরকার নাগরিকদের অস্ত্র রাখার অধিকার ছিনিয়ে নিলে সেটা অ্যামেরিকাকে নিয়ে যাবে গৃহযুদ্ধের দিকে। এমন একটি সংঘাত অ্যামেরিকার জনগণকে বিভক্ত করে ফেলবে বর্ণ ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে। সাদারা তখন বাধ্য হবে নিজেদের শ্বেতাঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে একত্র হতে। শ্বেতাঙ্গ জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এমন স্পষ্ট বিভাজন এবং যুদ্ধ আবশ্যিক। যুদ্ধ ছাড়া এখন আর কোনোভাবে ঘুমন্ত শ্বেতাঙ্গ জাতিকে জাগানো এবং শ্বেতাঙ্গদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা পশ্চিমা বিশ্বের সরকারগুলোর মোকাবেলা করা সম্ভব না।

ট্যার‍্যান্ট এর টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে

নিজের কাজকে ট্যারান্ট দেখে স্বজাতির উদাসীনতার ঘুম ভাঙানোর জন্য চালানো এক অনুপ্রেরণামূলক হামলা হিসেবে। তার আশা, আগামী বছরগুলোতে তার এ হামলা গভীরভাবে প্রভাবিত করবে পশ্চিমের সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাকে এবং উদ্বুদ্ধ করবে তার মতো আরও অনেক হামলাকারীকে।

চিন্তাপরাধ বইয়ের ‘শ্বেত সন্ত্রাস’’ প্রবন্ধ থেকে।

চলবে ইন শা আল্লাহ্‌


[1] ৮-চ্যান পোস্টের আর্কাইভ সংস্করণ – https://archive.fo/yxi4m#selection-8647.3-8647.15