ইসলামবিদ্বেষের কদর্য চেহারার সাথে বাংলাদেশের মানুষের আনুষ্ঠানিক পরিচয় হয় ২০১৩ এর শাহবাগ আন্দোলনের সময়। বাক্‌স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীলতার নামে বিভিন্ন ব্লগে যে ভয়ঙ্কর ইসলামবিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, এ ব্যাপারটা আমাদের অধিকাংশেরই ধারণার বাইরে ছিল। ঘৃণার এই মাত্রা ও তীব্রতার মুখোমুখি হবার প্রস্তুতি বাংলাদেশের মুসলিমদের ছিল না, এমন বলাটা ভুল হবে না। বলা যায়, ২০১৩ পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ এই জাতিকে—সেক্যুলার ও মুসলিম—একটি বিশ্বাসের সঙ্কটের (Crisis of faith) মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ব্যক্তিপরিচয়, জাতীয় পরিচয় এবং রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যাপারে বেশ কিছু অমীমাংসিত কঠিন প্রশ্নের জবাব খোঁজা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হতে পারে এ সঙ্কটের শুরু ২০১৩-তে, কিন্তু এ সঙ্কট, এ দ্বন্দ্বের শেকড় প্রোথিত আরও গভীরে।

ইসলাম নিয়ে বাংলাদেশের সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের অ্যালার্জি বেশ পুরোনো। সংখ্যার বিচারে সংখ্যালঘু কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর প্রভাবের দিক দিয়ে সংখ্যাগুরু সমাজের এ অংশটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। কেউ তাদের ‘সুশীল সমাজ’ বলে থাকেন, কেউ বলেন ‘প্রগতিশীল’। কেউ বলেন ‘সংস্কৃতিমনা’ অথবা ‘মুক্তমনা’। অনেকে তাদের জাতির বিবেকও বলেন। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, বাংলাদেশের মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ওপর এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ তৈরির ক্ষেত্রে তাদের আধিপত্য প্রশ্নাতীত। মফস্বল থেকে মেট্রোপলিটনে, শিক্ষিত ও ‘আলোকিত’ হবার চেষ্টায় ব্যস্ত মানুষেরা জ্ঞাতসারে অথবা অজান্তে এই ক্ষুদ্র কিন্তু প্রভাবশালী অংশটির চিন্তাচেতনা দ্বারা প্রভাবিত।

অজানা কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সুশীলতা, প্রগতিশীলতা, মুক্তচিন্তা এবং ‘জাতির বিবেকের’ ওপর নিরঙ্কুশ জমিদারিত্ব অর্জন করা এ অংশটি ইসলামকে আধুনিক সভ্যতার অ্যান্টিথিসিস (antithesis) হিসেবে উপস্থাপন করে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নিরলসভাবে ইসলামের বিভিন্ন বিধানকে মধ্যযুগীয়, বর্বর, অমানবিক, পশ্চাৎপদ ইত্যাদি প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। ‘বাঙালি’ কিংবা ‘বাংলাদেশি’ হবার আবশ্যক শর্তাবলির লিস্টে পশ্চিমা জাতিরাষ্ট্র, উদারনৈতিকতা (Liberalism) আর সেক্যুলারিযমের দর্শনকে সরাসরি কাট-পেইস্ট করে বসিয়ে দেয়। আর এর সাথে ৭১ এর ব্যাপারে একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা মিশিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের এমন একটি বয়ান তৈরি করে, বাঙালিয়ানা বা বাংলাদেশিত্বের এমন এক সংজ্ঞা তৈরি করে, যা সরাসরি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।

এ ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য সাথে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং এ ভূখণ্ডের যেসব মানুষ ৭১-এ পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, তাদের বক্তব্যের অদ্ভূত মিল পাওয়া যায়। দুদলই ৭১ ও ইসলামকে মুখোমুখি দাঁড় করায়। এক দল পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ইসলামের সমার্থক দাবি করে শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের যুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রমাণ করতে চেয়েছিল। অন্য দল পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দ্বারা চালিত যুদ্ধ দাবি করে এমন এক “ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” আবিষ্কার করে, যা বাক্‌স্বাধীনতা আর চিন্তার স্বাধীনতার নামে ইসলামবিরোধিতা ও ইসলামবিদ্বেষের লাইসেন্স দেয়। 

একই সাথে তারা ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের (Enlightenment) মুখস্থ অনুকরণে ধর্মকে; এ ক্ষেত্রে ইসলামধর্মকে, উপস্থাপন করে উন্নতি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য প্রতিবন্ধক হিসেবে। তারা মুক্তচিন্তা, মুক্তমন, আধুনিকতা আর প্রগতিশীলতার একটা সিলেবাস তৈরি করে। প্রথাবিরোধিতার নামে নতুন প্রথা তৈরি করে।  ইসলামবিদ্বেষকে এ প্রথাগত প্রথাবিরোধিতার অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে নেয়। আর যেহেতু আধুনিক যুগে জীবিকার পাশাপাশি চিন্তার দিক থেকেও মানুষ কেন্দ্রমুখী তথা শহরমুখী, তাই শহুরে এই প্রথাগত ইসলামবিদ্বেষ বিভিন্ন মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে বৃহত্তর সমাজের বিভিন্ন স্তরে। ২০১৩ সালে শাপলা বনাম শাহবাগ দ্বন্দ্বকে উপলক্ষ করে মুক্তচিন্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামবিদ্বেষের যে তীব্র রূপ আমরা দেখেছি, বাক্‌স্বাধীনতার আড়ালে ইসলামবিদ্বেষকে বৈধতা দেয়ার যে প্রচেষ্টা দেখেছি, সেটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই প্রক্রিয়ার ফলাফল; কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

তবে এ সঙ্কটের দায়ভার কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ওপর পুরোপুরি চাপানো যায় না। যারা ইসলামকে তাদের আদর্শিক শত্রু হিসেবে নির্ধারণ করে নিয়েছে, তারা সুপরিকল্পিতভাবে ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন শক্তিশালী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘদিন ধরে ছড়ানো ইসলামবিদ্বেষ প্রভাবিত করছে সামাজিক চিন্তা ও নৈতিকতাকে, প্রভাবিত করছে আমাদের যুবসমাজের উল্লেখযোগ্য একটি অংশকে; একথা অবশ্যই সত্য। কিন্তু কেন বাংলাদেশের মুসলিমরা সঠিকভাবে এই সিস্টেম্যাটিক ইসলামবিদ্বেষের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হলো, কেবল ‘নাস্তিক-মুরতাদ’-দের ওপর দোষ চাপিয়ে সেই প্রশ্নের জবাব মেলে না। এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য আমরা ঠিক কী পদক্ষেপ নিয়েছি, এ প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের মুসলিমসমাজের সংখ্যাগুরু অংশ এ সমস্যার সমাধান হিসেবে উটপাখির মতো বালুতে মাথা গুঁজে রাখাকে বেছে নিয়েছেন। যেন যথেষ্ট সময়জুড়ে, যথেষ্ট জোরে চোখ বুজে রাখলে একসময় আপনাআপনি এ সমস্যা দূর হয়ে যাবে। বস্তুত ২০১৩ এর মতোই এখনও বাংলাদেশের মুসলিমরা এ সঙ্কটের মোকাবেলা করতে অপ্রস্তুত। আর এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো, সার্বিকভাবে ইসলামের ব্যাপারে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।

‘বাংলাদেশ ৯০% মুসলিমের দেশ’—এ জাতীয় কথা আমরা হরহামেশাই শুনে থাকি। বার বার এ ধরনের কথার পুনরাবৃত্তির মাঝে আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাই। কিন্তু মুখস্থ বুলির আড়ালে বাস্তবতার দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি না অথবা করতে চাই না। আমাদের শহুরে শিক্ষিতসমাজের একটি বড় অংশের মাঝেই ইসলামের ব্যাপারে প্রচ্ছন্ন হীনম্মন্যতা কাজ করে। ইসলামের সামাজিক ও শাসন সম্পর্কিত বিধিবিধানের কথা বাদই দিলাম, নিছক ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সম্পর্কিত নানা বিধানের ব্যাপারে আমরা যারা মুসলিম বলে নিজেদের দাবি করি, তাদেরই নানা অজুহাতে বিরোধিতা করতে দেখা যায়।

একটি সহজ উদাহরণ দিই। দাড়ি-টুপি, হিজাব-নিকাব, বোরকা-জুব্বা নিয়ে ঠাট্টা করার প্রবণতা আমাদের সমাজে ব্যাপক। যদি ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি হজ্ব করার পর দাড়ি রাখেন, পাঞ্জাবি বা জুব্বা পরা শুরু করেন, তাহলে সেটা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আধুনিক সমাজের কোনো যুবক দাড়ি রাখবে, টুপি পরবে, গোড়ালির ওপর কাপড় রাখবে—এটা আমাদের কাছে কট্টরতা। ইসলামের ফরজ বিধান পর্দা করা, কিংবা ফ্রি-মিক্সিং থেকে দূরে থাকা—এটা সর্বসম্মতিক্রমে অতি রক্ষণশীল মনোভাব হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের সমাজের বিশাল একটা অংশের কাছে এগুলো ‘বাড়াবাড়ি’, ‘লোক-দেখানো ধার্মিকতা’, ‘পশ্চাৎপদতা’। এগুলো ‘হুজুরদের’ জন্য; মানুষদের জন্য নয়। নিয়মিত আমরা এগুলোকে আরবীয় সংস্কৃতির অনুসরণ বলে হালকা করার চেষ্টা করি। কিন্তু দুশো বছর ধরে যারা আমাদের দাস বানিয়ে রেখেছিল, তাদের অনুকরণে প্যান্টের মধ্যে শার্ট গুঁজে দেয়া, কাঠফাটা রোদ মাথায় কোট-টাই পরে ঘোরা আমাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়। সেটাকে কখনও গোলামির মনোভাব কিংবা ধর্ষিতা নেটিভের জারজ সন্তান কর্তৃক ঔপনিবেশিক পিতার আনুগত্য মনে হয় না; এ রকম উদাহরণ অসংখ্য।  

‘৯০% মুসলিমের’ এই দেশের বাস্তবতা হলো, আমরা নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো ‘গ্রহণযোগ্য ইসলাম’ আর ‘অগ্রহণযোগ্য ইসলাম’-এর সীমারেখা ঠিক করে নিয়েছি। যেটা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য সেটা আমরা পালন করি, সেটা যদি শারিয়াহর দৃষ্টিকোণ থেকে ভুলও হয়। আর সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে যা কিছু আছে সেগুলোকে মধ্যযুগীয়, কট্টরতা, অতিরক্ষণশীলতা, বর্তমান যুগে অচল, ইত্যাদি নাম দিয়ে বাদ দিই। ইসলামের বিধানগুলো আমাদের কাছে ব্যুফের মতো। যেটা পছন্দ প্লেটে তুলে নিই, যেটা অপছন্দ সেটা ফেলে রাখি। আর এভাবে আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল্লা এর কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের বদলে ইসলাম আমাদের কাছে নিছক কিছু আচার-অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্যের বদলে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এক অদ্ভুত ফ্রি-স্টাইল ইসলাম আমরা পালন করি। স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে কিতাবের কিছু অংশ গ্রহণ আর কিছু অংশ বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিই। আর তাই ইসলামের মধ্যে আমরা আত্মপরিচয় খুঁজে পাই না। ইসলাম আমাদের জন্য শুধুই ধর্মীয় পরিচয় হয়ে থাকে।

ইসলাম নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, হীনম্মন্যতা আর আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে ভোগা এই সমাজের একজন মানুষের সামনে যখন প্রগতি, মুক্তচিন্তা, বাক্‌স্বাধীনতা আর আধুনিকতায় মোড়ানো ইসলামবিদ্বেষ উপস্থিত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেটার মোকাবেলা করার প্রস্তুতি বা সাহস কোনোটাই তার থাকে না। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে অজ্ঞতার কারণে আধুনিক পশ্চিমা দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংঘর্ষিক বিধিবিধানগুলোকে যখন ইসলামবিদ্বেষীরা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানায়, তখন কীভাবে তার জবাব দিতে হবে, সেটা সে বুঝে উঠতে পারে না। কেউ চোখ বুজে, মুখ বুজে, এই বিতর্ক এড়িয়ে যেতে চায়। কেউ সংশয়ে পড়ে যায়। আবার কেউ নতুনভাবে ইসলামকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, যাতে করে পশ্চিমা মাপকাঠি অনুযায়ী ইসলামকে ‘সভ্য’, ‘আধুনিক’, ‘মানবিক’, ‘প্রগতিশীল’ ইত্যাদি প্রমাণ করা যায়। এভাবে আমাদের পরাজিত মানসিকতার কারণে হয় আমরা এই বাস্তব সমস্যাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি অথবা পশ্চিমা বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গিকে (worldview) পরম সত্য, ধ্রুব ধরে নিয়ে শারিয়াহকে আমরা ভ্যারিয়েবলে পরিণত করি।

দীর্ঘদিনের সুপ্ত ইসলামবিদ্বেষের যে বিস্ফোরণ ২০১৩ থেকে আমরা দেখছি, ইসলাম ও চরমপন্থী ধর্মনিরপেক্ষতাকে (militant secularism) কেন্দ্র করে যে বিভাজন আমরা দেখছি, তার জন্য সংঘবদ্ধ ইসলামবিদ্বেষের পাশাপাশি বাংলাদেশের মুসলিমসমাজের কাঠামোগত এই দুর্বলতাও দায়ী। ইসলামবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে যতোই কঠিন ভাষায় বক্তব্য দেয়া হোক না কেন, অভ্যন্তরীণ এ দুর্বলতা কাটিয়ে না উঠলে বাহ্যিক শত্রুর মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। একই সাথে এও সত্য, আমরা চোখ-কান বন্ধ করে থাকলে এ সমস্যা দূর হয়ে যাবে না— আমরা এ তিক্ত সত্য স্বীকার করি বা না করি। যদি আমরা আসলেই মুসলিম হিসেবে এ সমস্যার সমাধান চাই তাহলে একদিকে যেমন ইসলামবিদ্বেষীদের মোকাবেলা করতে হবে তেমনিভাবে অন্যদিকে বাংলাদেশের মুসলিমসমাজকে এই আত্মপরিচয়ের সঙ্কট থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। এ আত্মপরিচয়ের সঙ্কটকে জিইয়ে রেখে কেবল নাস্তিকদের যুক্তিখণ্ডন কিংবা ইসলামবিদ্বেষীদের অভিযোগের অপনোদন করে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব নয়।