দায় স্বীকার…

বান্দার জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হল নিজের সমস্যাগুলোর পেছনে নিজের ভূমিকা খুজে বের করার চেষ্টা করা। সমস্যাগুলোর জন্য অন্যদের দায়ী করার আগে নিজের দোষত্রুটিগুলোর দিকে তাকানো।

যেমন কেউ তার প্রতি অন্যায় করলে সে ভাবে –

এগুলো আমার গুনাহর ফল। আমার গুনাহর কারণে আল্লাহ তাকে আমার বিরুদ্ধে প্রবল করেছেন।

স্ত্রী তাঁর অবাধ্য হলে সে ভাবে –

হয়তো কোন মুতাবাররিজার (নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শন করা নারী) দিকে আমি তাকিয়েছিলাম। অফিসে কিংবা ক্লাসে হয়তো কোন নারীর সাথে হাসিঠাট্টা করেছিলাম। এটা তার শাস্তি। আমি নিজের অন্তরকে আমোদিত করতে চেয়েছিলাম হারামের মাধ্যমে, তাই আমার অন্তরকে বঞ্চিত করা হয়েছে যা আমার জন্য হালাল তা থেকে। হারাম থেকে বিরত থাকলে আমি স্ত্রীর কাছ থেকে আনুগত্য ও ভালবাসা পেতাম।

লোকেরা তাঁর প্রতি অন্যায় করলে কিংবা তাঁর প্রতি নাইনসাফী করা হলে, সে ভাবে –

হয়তো কেউ আমার প্রশংসায় অতিরঞ্জন করেছিল, হয়তো আমার অসত্য প্রশংসা করা হয়েছিল। কিন্তু কথাগুলো পছন্দ হওয়ায় আমি চুপ ছিলাম। আমি ভুলগুলো শুধরে দেইনি। এটা তার শাস্তি। কিংবা আমি হয়তো কারো প্রতি নাইনসাফী করেছিলাম। তাই আল্লাহ অন্য কোন ব্যক্তিকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষমতা দিয়েছেন, এবং সেই ব্যক্তি আমার প্রতি নাইনসাফী করছে।

মানুষ যখন তার সঠিক কথার ভুল অর্থ বের করে তাঁকে কষ্ট দেয়, এবং সে তাঁর অন্তরের বিদ্বেষের অস্তিত্ব অনুভব করে, তখন সে ভাবে –

হয়তো আমি কিয়ামে দাঁড়িয়ে (তাহাজ্জুদে) আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার ব্যাপার গাফেল ছিলাম। তাই তিনি আজ আমাকে কেবল নিজের ওপর ভরসা করার অবস্থায় এনেছেন যাতে আমি অনুধাবন করতে পারি যে,

  • আমার রবের সাহায্য ছাড়া এই আমি কতোটা ক্ষুদ্র, কতোটা তুচ্ছ
  • আমার কথা যতো সুন্দর, যতো গভীরতাসম্পন্ন হোক না কেন, আল্লাহ কবুল না করলে তা বিস্মৃত হবে, এবং মানুষের মাঝে এর কোন প্রভাব থাকবে না।

ড. ইয়াদ কুনাইবি এর লেখা থেকে

একই ধরণের কথা সালাফদের একজনের কাছ থেকেও পাওয়া যায়। কথাটা হুবহু মনে নেই, স্মৃতি থেকে লিখছি। সালাফদের একজন বলেছিলেন, যখন আমার বাহন (ঘোড়া, উট ইত্যাদি) কিংবা আমার বাড়ির লোকেরা আমার অবাধ্য হয়, তখন আমি বুঝতে পারি যে আমি আমার রবের অবাধ্য হয়েছি।

আমাদের একটা বড় সমস্যা হল আরেকজনকে বিচার করার সময় আমরা নিজের অবস্থা থেকে চিন্তা করি। ঐ ব্যক্তির অবস্থান, প্রেক্ষাপট, পরিস্থিতি বিবেচনা করা চেষ্টা করি না। নিজের পারিপার্শ্বিকতা, নিজের বাস্তবতা তার ওপর চাপিয়ে দেই। হয়তো অনিচ্ছাকৃত, অবচেতনভাবেই। আবার যখন নিজের সমস্যাগুলোর কথা চিন্তা করি, তখন নিজেকে দেখি চিরন্তন ভিকটিম হিসাবে। ‘কেন আমার সাথেই এমন হয়’ – ‘কেন অমুক এমন বললো, আমি এখন তাকে পাল্টা আরেকটা কথা বলি’, – ‘অমুক যেহেতু আমার সাথে এমন করেছে এখন আমি তার সাথে তেমন করবো’ - ইত্যাদি বিভিন্ন চিন্তা আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। মানুষের দেবত্ব আরোপ করা পশ্চিমা দর্শনের জায়গা থেকে এমনটা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি যেহেতু ভালোমন্দের নির্ধারক, তাই ব্যাক্তি তার লাভক্ষতির জায়গা থেকেই সব চিন্তা করবে। আমি- এর বাইরে সে যেতে পারবে না। সব কিছু আবর্তিত হবে, নির্ধারিত হবে এই ‘আমি’-কে কেন্দ্র করে।

কিন্তু ইসলাম আমাদের সুযোগ দেয় আত্মকেন্দ্রিকতার এই বুদবুদ থেকে বের হয়ে আসার। মানুষের সাথে নিজের বোঝাপড়ার হিসেবেনিকেশের ওপরে উঠে, আল্লাহর কাছে নিজের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে বিষয়গুলো মূল্যায়ন করার। যদি বান্দা আল্লাহর হক্ব আদায়ে সচেষ্ট হয় এবং সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা মেনে চলে তাহলে মানুষ যাই বলুক না কেন, ইন শা আল্লাহ সে উত্তম অবস্থায় আছে। আর যদি সে আল্লাহর হক্বের ব্যাপারে উদাসীন হয়, আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে, তাহলে মানুষ যাই বলুক না কেন সে ক্ষতিগ্রস্থ।

দিন শেষে আরেকজনকে দোষারোপ করে বান্দার ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ হয় না। কিন্তু নিজের জবাবদিহি নেয়া ইন শা আল্লাহ তাঁর জন্য উপকারী হয়। এভাবে তাওহিদ আমাদের শেখায় প্রতিটি বিরোধিতা, আঘাত, আক্রমন কিংবা অভিযোগকে আত্মসমালোচনা এবং আত্মশুদ্ধির উপলক্ষ বানানোর। তাওহিদের শিক্ষা, ভিকটিম মেন্টালিটি থেকে বের হয়ে এসে আমাদের শেখায় দায়িত্ব নিতে।

আল্লাহ আমাদের সকলে বোঝার এবং আমল করার তাউফিক দান করুন।