বেশ ক’বছর ধরে অনলাইনে ‘সালাফিব্যাশিং’-এর একটা ইন্ট্রেস্টিং ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে। মুসলিমদের মধ্যে মাসলাকগত দ্বন্দ্বের ব্যাপারটা নতুন না। বিভিন্ন ঘরানার আলিমসহ সাধারণদের একে অপরের সমালোচনা করার প্রবণতাও পুরনো। কিন্তু সালাফি বিরোধিতার নতুন ট্রেন্ডটা ইন্ট্রেস্টিং কারণ এই বিরোধিতাকে এক ধরণের নৈতিক অবস্থান থেকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সালাফি ধারার দাওয়াহকে ঢালাওভাবে ‘দরবারী’ এবং ‘সুবিধাবাদী’ ইসলাম বলা হচ্ছে। যারা বিরোধিতা করছেন তারা ‘দরবারী’ এবং ‘সুবিধাবাদী’ ইসলামের বিরুদ্ধে - অনেকটা এমন আরগুমেন্ট। এছাড়া, সালাফিরা শাসকের পেট্রোডলারে এসি রুমে দাওয়াহ করে। ঢাকার রাস্তায় কিংবা গ্রামের মাসজিদে ঘুরে ঘুরে শবে বরাত পালনের অথেনটিক আনন্দ তারা বোঝে না। তাই বিদআত বলে বিরোধিতা করে, এমন আরগুমেন্টও দেখেছি!

বিভিন্ন মাসলাকের অনুসারীরা নানা কারণে একে অপরের সাথে তর্কবিতর্ক করবে, আমরা যতোই চাই না কেন কেবল সদিচ্ছা দিয়ে এসব দ্বন্দ্ব বন্ধ হবে না। এ বাস্তবতা আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্বীকার করে নিয়েছি। কিন্তু সালাফি বিরোধিতার এই নতুন ট্রেন্ডের ব্যাপারে দুটো কারণে আমার আপত্তি আছে- প্রথমত, সালাফিদের ঢালাওভাবে দরবারী বলা, সঠিক না।

দ্বিতীয়ত, ইলমী কিংবা মাসলাকগত কারণে কেউ যদি সালাফিদের বিরোধিতা করতে চায় তাহলে করতে পারে। চাইলে বিদ্বেষবশতও করতে পারে। এটা তার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু বিরাগপ্রসূত বিরোধিতাকে নৈতিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করা উচিৎ না। ‘দরবারী’ হওয়াটাই যদি মূল আপত্তির কারণ হয় তাহলে এ বাস্তবতা স্বীকার করা উচিৎ যে, দরবারী কার্যক্রমে সালাফিদের কোন ধরণের মনোপলি নেই।.আজকে প্রথম কথাটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। পরের কথাটা অন্য কোন দিন।

সালাফিদের ঢালাওভাবে দরবারী আখ্যা দেয়া জাস্ট প্লেইন রং। সালাফি আন্দোলনের ব্যাপারে নূন্যতম ধারণা থাকা যে কেউ এ কথাটা এক বাক্যে স্বীকার করে নেবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজকালকার অধিকাংশ মানুষ অধিকাংশ বিষয়ে নূন্যতম ধারণা ছাড়াই কথা বলে। কষ্ট করে ‘শোনা কথার’ যথার্থতা যাচাইয়ের চেষ্টা কেউ করে না। ফলে মানুষের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজে একটা ভুল ধারণাকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা যায়। .দরবারী বলতে মূলত ঐ সব আলিমদের বোঝানো হয় যারা শাসকগোষ্ঠীর কুফর, ফিসক এবং যুলুমের সাফাই গায়। শরীয়াহর অপব্যাখ্যা করে শাসকগোষ্ঠীর এসব কাজকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে, এবং শাসকদের যেকোন ধরণের বিরোধিতাকে অবৈধ এবং অন্যায় সাব্যস্ত করার চেষ্টা করে। ব্যক্তি এবং প্রেক্ষাপট অনু্যায়ী এখানে ছোটখাটো সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে, তবে মোটাদাগে এগুলো হল ‘দরবারী’ হবার বৈশিষ্ট্য।

নিঃসন্দেহে সালাফিদের মধ্যে একটা ধারা আছে যারা অনেক আগ্রহ এবং উৎসাহের সাথে এই কাজটা করে। এরা জামী-মাদখালী নামে পরিচিত। এই ধারার ইতিহাস এবং বিবর্তন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই, সংক্ষেপে কিছু কথা বলছি। জামী-মাদখালীদের জন্ম নব্বইয়ের দশকে সাউদি আরবে। উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। সাউদি শাসকগোষ্ঠী এ সময় আরব উপদ্বীপে মার্কিন সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রন জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বিভিন্ন জনপ্রিয় বক্তা এবং আলিম এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। এসময় সাউদিতে বেশ শক্তিশালী একটি আন্দোলন তৈরি হয় যাকে ‘সাহওয়াহ আন্দোলন’ বলা হয়। সাফার আল হাওয়ালি এবং সালমান আল আউদাহ ছিলেন এই আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিদের অন্যতম।

এই আন্দোলনের কাউন্টার ব্যালেন্স হিসেবে উত্থান ঘটে জামী-মাদখালী ধারার। এই ধারার অনুসারীরা শাসকের প্রতি আনুগত্যকে; বিশেষ করে আলে সাউদের প্রতি আনুগত্যকে মৌলিক আকীদাহর বিষয় মনে করে। শাসকের বিরুদ্ধে যেকোন ধরণের বক্তব্য বা কাজকে খারেজি-তাকফিরি হবার বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করে, এবং নিজেদের বাইরে অন্য সব ধারাকে (সালাফি এবং নন-সালাফি) বিদআতি মনে করে। .স্বাভাবিকভাবেই এই ধারার চিন্তাভাবনা সরকারদের অনেক পছন্দ হয়, এবং ধীরে ধীরে তা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক এ ধারার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন ও আছেন। অনেকে বলে থাকেন এই ধারার উত্থানের পেছনে ইন্টিলেজেন্স এজেন্সির ভূমিকা ছিল। এছাড়া এই ধারা শাসকদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু থেকেই পেয়ে আসছে। বর্তমানে সাউদি, লিবিয়া, মিশরসহ বিভিন্ন দেশে এদের অবস্থা বেশ শক্তিশালী। ইংল্যান্ডেও এদের একটা সক্রিয় অবস্থান আছে।

ওপরে যা বললাম, তা বেশ লম্বা এবং জটিল ইতিহাসের সরলীকরণ। তবে আমাদের আলোচনার জন্য এটুকু যথেষ্ট। লক্ষ্যনীয় বিষয় হল জামী-মাদখালীরা বৃহত্তর সালাফি আন্দোলনের মধ্যে একটা ধারা মাত্র। তারা সালাফিয়্যাহর একক প্রতিনিধিত্বকারী না। সালাফি আন্দোলন মনোলিথিক না। কাফের-মুসলিম, সবাই একথা স্বীকার করে। .মার্কিন সরকারের লোক এবং কাউন্টার টেরোরিসম অ্যানালিস্ট কুইনটন উইকটরোউইটযের মধ্যে সালাফিদের মধ্যে মূল ধারা তিনটি – পিউরিস্ট, অ্যাকটিভিস্ট এবং জিহাদি সালাফি। অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক ‘কোয়াটিস্ট’ (Quietist) নামে চতুর্থ একটি ধারার কথা বলে। অন্যদিকে ড. তারেক আব্দুল হালিমের মতো মুসলিম বিশ্লেষকদের মতে সালাফিদের মধ্যে মোট ধারা ৮টি বা ৯টি। এভাবে বিভিন্ন ধরণের বিশ্লেষক সালাফিদের বিভিন্নভাবে ভাগ করেছেন।

এসবগুলো বিশ্লেষণ যে সঠিক, তা না। কিন্তু সবাই এব্যাপারে একমত যে সালাফি আন্দোলনের মধ্যে বিভিন্ন ধারা আছে। অন্যান্য সালাফি ধারাগুলো জামী-মাদখালীদের মূলনীতি এবং অবস্থানগুলো অনুসরণ করে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান জামী-মাদখালীদের বিপরীত। ইন ফ্যাক্ট যাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে জামী-মাদখালীদের উত্থান সেই সাহওয়াহ-ও একটি সালাফি ধারা। মাদখালীরা দিনরাত যাদেরকে খাওয়ারিজ এবং তাকফিরি বলে তারাও সালাফি। এই পার্থক্যগুলোর উপস্থিতি বোঝা এবং স্বীকার করা আবশ্যিক। এবং এসব কারণে সালাফি ধারাকে ঢালাওভাবে ‘দরবারী’ বলা বাস্তবতার নিরিখে ভুল।

সালাফি আন্দোলনের মূল ধারা দরবারী – এ কথা বলাও আমার মতে সঠিক না। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে সালাফি আন্দোলনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে ধরা হয় শাইখ বিন বায, শাইখ ইবনু উসাইমীন এবং শাইখ আল-আলবানীকে রাহিমাহুমুল্লাহ।

একথা সত্য যে প্রথম দু’জন সাউদি শাসকগোষ্ঠীর নৈকট্যপ্রাপ্ত ছিলেন। রাষ্ট্রীয় এস্টাবলিশমেন্টের অংশ ছিলেন। সময়ে সময়ে হয়তো শাসকের মনমতো ফাতাওয়াও দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের অবস্থানের সাথে জামী-মাদখালীদের অবস্থানকে মেলানো যায় না। তাঁরা বিভিন্ন দেশে মুসলিম আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠীর সবধরণের বিরোধিতাকে তাঁরা অবৈধ সাব্যস্ত করেননি, ভিন্নমতের সকলকে বিদআতি আখ্যা দেন নি, ইমান-কুফরের সংজ্ঞায় ইরজায় আক্রান্ত হননি। এরকম অনেক ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। অন্যদিকে শাইখ আল-আলবানী কখনোই শাসকগোষ্ঠীর কাছাকাছি অবস্থান করেননি, বরং তিনিও উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সাউদি সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন।.তারপরও এক অর্থে শাইখ বিন বায এবং শাইখ ইবনু উসাইমিনদের দরবারী বলা যেতে পারে। কিন্তু আমি যতোটুক বুঝি সেই বিস্তৃত সংজ্ঞাকে সাধারণত গ্রহণ করা হয় না। সেই সংজ্ঞা গ্রহণ করা হলে পাকিস্তানের আদালতে কাজ করা কিংবা হোসনি মোবারক বা সিসির পক্ষে দেয়া বক্তব্য ও ফাতাওয়ার সুবাদে ঢালাও ভাবে দেওবন্দী এবং আজহারী আলিমদের মূলধারাকেও দরবারী বলা যায়। সৌদি শাসকের হয়ে কাজ করলে, তাদের অপরাধের বৈধতা দিলে দরবারী কিন্তু পাকিস্তানী অথবা মিশরীয় শাসকের জন্য কাজ করলে হকপন্থী, এমন বিভাজন নিশ্চয় সঠিক হতে পারে না, তাই না? তবে যাই হোক, আমি যে ট্রেন্ডের কথা বলছি সেখানে ‘দরবারী আলিমের’ এই বিস্তৃত সংজ্ঞা গ্রহণ করা হয় না। কাজেই সালাফিদের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে এটার প্রয়োগ করা ইনসাফ না। আর কেউ যদি এই বিস্তৃত সংজ্ঞা সব মাসলাকের ক্ষেত্রে গ্রহণ করে, তাহলে সেটা ভিন্ন আলাপ।

এছাড়া যে গত ছয় দশকে পশ্চিম সমর্থিত শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এবং সরাসরি পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যেখানেই প্রতিরোধ ও বিপ্লব হয়েছে সেখানে সালাফিদের শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল এবং আছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। আজ সাউদি আরবের জেলে শত শত সালাফি আলিম বন্দী, এটাও বাস্তবতা। তাঁদের মধ্যে শাইখ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ এবং আব্দুল আযীয আত-তারিফীর মতো নিরেট ইলমী মানুষ আছেন। সাফার আল হাওয়ালি এবং সালমান আল-আউদাহর মতো ব্যক্তিত্ব আছেন, যারা একসময় সাউদি সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অ্যাকটিভিসম করেছেন। পরে জেলে গেছেন। জেল থেকে বের হয়ে সরকারের ব্যাপারে অবস্থান নরম করেছেন, একধরণের বোঝাপড়ায় গেছেন। তারপর আবার গতো কয়েক বছর আগে গ্রেফতার হয়েছেন। আবার এদের মধ্যে শাইখ ওয়ালিদ আস-সিনানী, সুলাইমান আল-উলওয়ানের মতো ব্যক্তিরা আছেন যারা একেকজন ২৫, ২০, বছর ধরে বন্দী থাকা সত্ত্বেও সাউদি সরকারের সাথে আপোষ করেননি। নিজেদের নীতি থেকে এক চুল নড়েননি। এর আগে শাইখ হামুদ বিন উকলা আশ-শুআইবির রাহিমাহুল্লাহ মতো ব্যক্তি বন্দী ছিলেন যারা সরাসরি সাউদির শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ফাতাওয়া দিয়েছেন। হাওয়ালি বা আউদাহর মতো তাঁদের নিয়ে মিডিয়াতে তেমন মাতামাতি না থাকলেও, এসব ব্যক্তির আপসহীন অবস্থানকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

এই আলিমরা সবাই সালাফি। তারা নিঃসন্দেহে দরবারী না। কারণ শাসকগোষ্ঠীই তাঁদেরকে বন্দী করে রেখেছে। তাঁরা পেট্রোডলার পান না, বরং পেট্রোডলার তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। এবং তাঁরা যদি শবে বরাত বা অন্য কোন কিছুর বিরোধিতা করেন সেটা এসি রুমে বসে করেন না, জেলের মাটিতে বসে করেন। আরাম কিংবা সুবিধার কারণে করেন না, শরীয়াহর দলীলের ভিত্তিতে করেন। যারা তাঁদের অনুসরণ করেন তারাও টাকা কিংবা এসির বাতাসের জন্য সেটা করেন না। এই সব কিছু উপেক্ষা করে সালাফিদের ঢালাও ভাবে ‘দরবারী’ জাতীয় কিছু সাব্যস্ত করা ভুল, এবং না-ইনসাফী। এ কথাটা বোঝা খুব কঠিন কিছু না। নিজের সাথে সৎ হলে যে কোন সালাফি-বিরোধীও এটা স্বীকার করতে পারবে।

সালাফি দাওয়াহর ব্যাপারে মানুষের ইলমী আপত্তি থাকতে পারে। কেউ দলীলের ভিত্তিতে তাঁদের অবস্থানের বিরোধিতা করতে পারেন। কারো মধ্যে ক্ষোভ থাকতে পারে। কেউ মাসলাকগত আনুগত্য কিংবা বিদ্বেষের বশেও বিরোধিতা করতে পারেন। মানুষকে জনে জনে থামানো তো সম্ভব না। কিন্তু বিরোধিতা করলে সেটার কারণ সরাসরি বলা ও স্বীকার করা উচিৎ। যার আপত্তি ইলমী জায়গা থেকে সে কখনো তার বিরোধিতাকে বৈধতা দেয়ার জন্য অজুহাত টানবে না। সে শারঈ দলীলের ভিত্তিতে বিরোধিতা করবে। কিন্তু গতো কয়েক বছর ধরে অনলাইনের সালাফি ব্যাশিং এর ক্ষেত্রে ‘দরবারী’ হবার অভিযোগ তুলে মূলত সালাফি বিদ্বেষকে একটা গ্রহণযোগ্য চেহারা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু একটা মিথ্যা অভিযোগ প্রচার করে সেটার আড়ালে নিজের বিদ্বেষকে নৈতিকতার পোষাক পরানোর এই কৌশল দীর্ঘমেয়াদে খুব একটা কার্যকরী না। সব মানুষকে কোন না কোন সময় বোকা বানানো যায়। কিছু মানুষকে সবসময় বোকা বানানো যায়। কিন্তু সবাইকে সবসময় বোকা বানানো যায় না।