মডারেট মুসলিমের বৈশিষ্ট্য
আলোচনা করছিলাম, ‘মডারেট ইসলাম’ নিয়ে র্যান্ডের প্রথম প্রতিবেদন নিয়ে। গত পর্বে কথা বলেছিলাম, ‘মডারেট ইসলাম’ কিংবা ‘সিভিল ডেমোক্রেটিক ইসলাম’ তৈরির কারণ নিয়ে। সেই সাথে আমরা আলোচনা করেছিলাম র্যান্ড কর্পোরেইশানের দেয়া ‘উগ্র মৌলবাদ’-এর সংজ্ঞায়ন নিয়ে।
আজ আলোচনা করবো অ্যামেরিকা কোন ধরণের ইসলাম ও মুসলিম তৈরি করতে চায়, তা নিয়ে। একজন মডারেট মুসলিমের বৈশিষ্ট্য কী কী হবে, সেটা র্যান্ডের প্রতিবেদনে রীতিমতো ছক টেনে দেখানো হয়েছে। আজ আমরা সেই অংশের দিকে মনোযোগ দেবো। র্যান্ডের এই প্রতিবেদনে ১১ টি ইস্যু চিহ্নিত করা হয়েছে। র্যান্ডের ভাষ্যমতে এই ইস্যুগুলোতে কে কোন অবস্থান গ্রহণ করছে তা থেকে তার আদর্শিক কাঠামো এবং ঝোঁকটা বোঝা যায়। আর একবার এই দুটো ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেলে, তাদের কাজে লাগানো যাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেয়া অ্যামেরিকার জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই এ ১১টা ইস্যু হল র্যান্ডের মতে মার্কার ইস্যু।
এমন ইস্যু ১১টার মধ্যে সীমাবদ্ধ না। সংখ্যাটা ১১ এর চেয়ে কমবেশি হতে পারতো। তবে র্যান্ড মনে করে, ইস্যুগুলোর দিকে তাকানো মুসলিমদের মূল্যায়নের জন্য পর্যাপ্ত হবে।
এই ১১টা মার্কার ইস্যু হল –
১) গণতন্ত্র,
***২) মানবাধিকার ও ব্যাক্তিস্বাধীনতা, ***
***৩) বহুবিবাহ, ***
***৪) হুদুদ, ***
***৫) হিজাব, ***
৬) প্রয়োজনে স্ত্রী-কে আঘাত করার বিধান,
***৭) কাফিরদের অবস্থান, ***
***৮) ইসলামী রাষ্ট্র, ***
***৯) পাবলিক অঙ্গনে নারীদের অংশগ্রহণ, ***
***১০) [জি]হাদ, ***
১১) চিন্তাধারার উৎস
পুরো মুসলিম বিশ্বকে র্যান্ডের এই রিপোর্টে মোটা দাগে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে – উগ্র মৌলবাদী, ট্র্যাডিশানালিস্টস বা রক্ষণশীল, মডার্নিস্ট, এবং সেক্যুলার। প্রত্যেক ইস্যুতে কোন মুসলিমদের কেমন অবস্থান সেটা র্যান্ডের প্রতিবেদনে টেবিল আকারে দেখানো হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, র্যান্ডের পুরো আলোচনার কাঠামো গড়ে উঠেছে ‘উগ্র মৌলবাদ’ দমন ও এর সংজ্ঞার ওপর। অ্যামেরিকার কাছে সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য মুসলিম হল ‘উগ্র মৌলবাদীরা’। অন্যদিকে অ্যামেরিকার কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হল মডার্নিস্ট এবং সেক্যুলারিস্টরা। র্যান্ডের ভাষ্যমতে –
‘মডার্নিস্ট এবং সেক্যুলারিস্টরা মূল্যবোধ এবং পলিসির দিক থেকে পশ্চিমের সবচেয়ে কাছাকাছি।’
অর্থাৎ অ্যামেরিকার কাছে ‘খারাপ ইসলাম’ হল উগ্র মৌলবাদীদেরটা। আর ‘ভালো ইসলাম’ হল মডার্নিস্টদেরটা।
আমরা এখানে প্রতিটি ইস্যুর ক্ষেত্রে এই দুই অবস্থান তুলে ধরবো। আমরা দেখবো এই ১২টি ইস্যুর ক্ষেত্রে কোন অবস্থান অ্যামেরিকার কাছে ‘উগ্র মৌলবাদী’ অবস্থান হিসেবে বিবেচিত আর কোন অবস্থান ‘গ্রহণযোগ্য’।
[১] গণতন্ত্র
‘উগ্র মৌলবাদী’ অবস্থান - গণতন্ত্র ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, আল্লাহ্র আইন দিয়ে শাসন করা আবশ্যিক, আল্লাহ্র আইনকে বাতিল করে তার বিপরীতে মানুষ আইন প্রণয়ন করতে পারবে না, বিধান প্রণয়নের অধিকার এক আল্লাহ্র।
অ্যামেরিকা কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থান - গণতন্ত্রকে মেনে নিতে হবে। বরং ইসলামের ভেতরেই গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা আছে। সেগুলোকে সামনে নিয়ে আসতে হবে।
তবে, ‘গণতন্ত্র মানে শূরা’, ‘ইসলামী গণতন্ত্র’, ইত্যাদি দুই কূল রাখা অবস্থান গ্রহণযোগ্য না। র্যান্ড পুরো প্রতিবেদনে পরিষ্কার করে দিয়েছে যে গণতন্ত্রকে হতে হবে পশ্চিমের দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী আদি ও অকৃত্রিম গণতন্ত্র। অর্থাৎ ইখওয়ানুল মুসলিমীন কিংবা অর্থোডক্স জামাআতে ইসলামী-র মতো হলে হবে না। কমসেকম আন-নাহদা, জনআকাঙ্ক্ষা এবং/অথবা সংস্কারপন্থী জামাআত, কিংবা একেপার্টির মতো হতে হবে, এবং সেটাও হয়তো সবসময় যথেষ্ট হবে না।।
[২] হুদুদ (ইসলামী দন্ডবিধি)
‘উগ্র মৌলবাদী’ অবস্থান - শরীয়াহর অপরিবর্তনীয়, আবশ্যকীয় এবং অলঙ্ঘনীয় অংশ। ন্যায়বিচার, ইনসাফ এবং সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য মহান আল্লাহ্ যে শরীয়াহ নাযিল করেছেন তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
অ্যামেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থান –এই শাস্তিগুলো সেকেলে, অথবা ১৪০০ বছর আগের সমাজ আর প্রেক্ষাপটের জন্য উপযুক্ত, অথবা এগুলোকে শুরু থেকেই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আজকের পৃথিবীতে হুদুদ বাস্তবায়ন করা উচিৎ না।
**[৩] মানবাধিকার এবং ব্যাক্তিস্বাধীনতা**
‘উগ্র মৌলবাদী’ অবস্থান - এই ধারণাগুলো ভুল এবং ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। বস্তুবাদী এবং অনেকে ক্ষেত্রে নাস্তিক্যবাদী কিংবা সংশয়বাদী দর্শনের জায়গা থেকে তৈরি করা, তাই পরিত্যাজ্য। ব্যক্তি এবং সমাজের কল্যাণের জন্য, সঠিক এবং পরিপূর্ণভাবে শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত হওয়া যথেষ্ট।
অ্যামেরিকা কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থান - পশ্চিমা বিশ্ব যে মানবাধিকার এবং ব্যাক্তি স্বাধীনতার কথা বলে, সেগুলোর প্রাথমিক কনসেপ্ট ইসলামের আছে। তাই পশ্চিমা অর্থে মানবাধিকার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা মেনে নিতে কোন সমস্যা নেই। বরং এটাই ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসলাম ব্যাক্তিকে গুনাহ করার স্বাধীনতাও দেয়।
[৪] ইসলামী রাষ্ট্র
‘উগ্র মৌলবাদী’ অবস্থান - আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র হবে বৈশ্বিক এবং গত শতাব্দীতে তৈরি করা জাতীয়তাবাদী সীমান্তের সীমানা থেকে মুক্ত। ইসলামী রাষ্ট্র রাষ্ট্র ও সমাজে শরীয়াহর বিধান প্রতিষ্ঠা করবে। যেসব বিষয়ে ব্যাপারে শরীয়াহর স্পষ্ট বক্তব্য নেই, সেগুলোর ব্যাপারে আলিমগণের পরামর্শের সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
অ্যামেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থান – ইসলাম রাষ্ট্র হিসেবে আসেনি। ইসলামী রাষ্ট্রের কোন কনসেপ্ট নেই। ইসলাম কোন জীবনযাপনের কিছু মূলনীতি এবং দর্শন। ব্যক্তি তার ইচ্ছে মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখে। আর এর তার সিদ্ধান্ত আর কাজের দায়ভারও তার।
**[৫] বহুবিবাহ**
‘উগ্র মৌলবাদী’ অবস্থান – জায়েজ। এই বিধানে কোন সমস্যা নেই, আল্লাহর নাযিলকৃত শরীয়াহর অন্য সব অংশের মতো এই বিধানও নিখুত। একই সাথে এই বিধান পশ্চিমা অনৈতিকতা, বহুগামীতা এবং সিরিয়াল ডিভোর্সের সমাধান।
অ্যামেরিকা কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থান – বহুবিবাহ জায়েজ না। সেকেলে, পশ্চাৎপদ প্রথা, যেমনটা অন্যান্য ধর্মে দেখা যায়। এমনকি নববী যুগেও বহুবিবাহকে আদর্শ অবস্থান মনে করা হতো না। প্রয়োজনের খাতিরে মেনে নেয়া হয়েছিল। এমনকি রাসূলুল্লাহ ﷺ এই প্রথা রহিত করার চেষ্টা করছিলেন, এমন প্রমাণও আছে।
**[৬] পাবলিক অঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণ**
‘উগ্র মৌলবাদী’ অবস্থান – ঘরের বাইরে নারী ও পুরুষের মেলামেশার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রায় পৃথকীকরণ বজায় রাখতে হবে। নারীর মূল অবস্থান ও ভূমিকা তার ঘরে। তাকে পাবলিক ডোমেইন থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। নারী নেতৃত্ব জায়েজ না।
অ্যামেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থান – সব পেশায়, সব ভূমি এবং সব ধরণের অবস্থানে নারী অংশগ্রহণ করতে পারবে। 'নববী যুগে এমনই হয়েছিল'।
**[৭] হিজাব**
‘উগ্র মৌলবাদী’ অবস্থান – মেয়েদের জন্য পর্দা করা ফরয। নারীরা যেন এই বিধান মেনে চলে সেই চেতনা তাদের মধ্যে তৈরি করা এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়া সমাজের দায়িত্ব। এই বিধান পাবলিক প্লেইসে পালিত হচ্ছে কি না, সেটা নিশ্চিত করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
অ্যামেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থান – ইসলাম নারীদের জন্য কোন ধরণের পর্দা করার বা মাথা ঢেকে রাখার বিধান দেয় না। এই জাতীয় বিধানের পক্ষে কোন দালীলিক প্রমাণ নেই। কে কী পড়বে না পড়বে, সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। তার ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপার। পুরুষরা যদি নারীদের দিকে ঐভাবে তাকায় তাহলে সেটা নারীর দোষ না। বরং কুরআনে পুরুষকে ‘দৃষ্টি অবনত রাখতে’ বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য এটা র্যান্ডের ২০০৩ সালে প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদনের অবস্থান। পরের ১৭ বছরে এই অবস্থানে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন মনে করা হয়, যদি কোন নারী তার ‘মুসলিম পরিচয়’ বা আইন্ডেন্টিটিকে আকড়ে ধরার জন্য, কিংবা (শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের বিরুদ্ধে) কোন রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের জন্য, কিংবা নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে স্বেচ্ছায় মাথায় স্কার্ফ (‘হিজাব’) পড়ে, তাহলে সেটা ঠিক আছে। অর্থাৎ সে ব্যক্তি স্বাধীনতার অনুশীলন হিসেবে মাথায় স্কার্ফ পড়তে পারে। তবে তাকে জোর করার অধিকার কারো নেই (বাবা, ভাই, স্বামী, সমাজ, রাষ্ট্র)। হিজাব ‘চয়েস’ হিসেবে গ্রহণ করলে ঠিক আছে। আল্লাহ্র হুকুম হিসেবে পালন করা যাবে না।
**[৮] [জি]হাদ**
‘উগ্র মৌলবাদী’ অবস্থান – [জি]হাদের বিভিন্ন স্তর আছে। কিন্তু আগ্রাসী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী চলা লড়াইয়ে সাধ্যমত অংশগ্রহণ করা আবশ্যক। এই লড়াইয়ের পদ্ধতি হতে পারে ক্লাসিকাল ওয়ারফেয়ার (প্রচলিত যুদ্ধ), ইনসার্জেন্সি (গেরিলা যুদ্ধ) কিংবা টেরোরিসম (ট্যাকটিকাল বা রণকৌশলগত অর্থে/অ্যাসিমেট্রিক ওয়ারফেয়ার)।
অ্যামেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থান – [জি]হাদ একটি রূপক শব্দ। এর দ্বারা আধ্যাত্মিক সাধনা ও উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টাকে বোঝানো হয়।
[৯] প্রয়োজনে স্ত্রীকে আঘাত করা
‘উগ্র মৌলবাদী’ অবস্থান – জায়েজ। পরিবারের ব্যাপারে আল্লাহ্ যে বিধানগুলো দিয়েছেন তার অন্তর্ভুক্ত।
অ্যামেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থান – জায়েজ না। এটা স্পটতই ইসলামের স্পিরিটের সাথে সাংঘর্ষিক। এবং যারা এটাকে জায়েজ বলেছে তারা আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করেছে।
**[১০] কাফিরদের অবস্থান**
‘উগ্র মৌলবাদী’ অবস্থান – ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের অবস্থান মেনে নেয়া হবে। তবে তারা প্রকাশ্যে তাদের ধর্ম প্রচার করতে পারবে না। ঈমান ও কুফর সমান না। তাই মুসলিম ও কাফিরদের ব্যাপারে আইন, শরীয়াহর বক্তব্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলাদা হবে।
অ্যামেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থান – মুসলিমদের সমান হিসেবে গণ্য করতে হবে।
**[১১] চিন্তাধারার উৎস**
‘উগ্র মৌলবাদী’ অবস্থান - কুরআন, সুন্নাহ, 'উগ্রবাদী লেখক ও ক্যারিশম্যাটিক নেতাদের 'অবস্থান। খুঁটিনাটি সব বিষয় ইসলামী শরীয়াহর অধীনে পরিচালিত সমাজ গঠনের যে চিন্তা তার সাথে মিলিয়ে সমাধান করা।
অ্যামেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থান – কুরআন, সুন্নাহ, ঐতিহাসিক এবং বর্তমান সময়ের দর্শন। আধুনিক আইন, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ।
এই হল অ্যামেরিকার মতে ‘উগ্র মৌলবাদী' মুসলিম আর অ্যামেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য ‘মডারেট মুসলিম’ এর বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি ইস্যুতে ঐ অবস্থানকে ‘উগ্র মৌলবাদী’ বলা হচ্ছে যার ভিত্তি হল কুরআন সুন্নাহ, প্রথম তিন প্রজন্মের দৃষ্টান্ত এবং প্রথম ১৩০০ বছরের উলামায়ে কেরাম এর অবস্থান। যাদেরকে ‘উগ্র মৌলবাদী’ বলা হচ্ছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করার জন্য র্যান্ড এও বলেছে যে তাদের চিন্তার ভিত্তি হল বিভিন্ন ‘উগ্রবাদী লেখক ও ক্যারিশম্যাটিক নেতাদের অবস্থান’। কিন্তু ওপরের অন্যান্য পয়েন্টগুলো থেকে যে কেউ স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন যে বহুবিবাহ, হিজাব, হুদুদ, ইসলামী রাষ্ট্র, [জি]হাদ, আল্লাহর আইন ব্যাতীত অন্য আইন দ্বারা শাসন, কোন ক্ষেত্রেই ‘উগ্র মৌলবাদী’দের অবস্থানের সাথে ক্লাসিকাল অবস্থানের কোন পার্থক্য নেই।
উল্লেখ্য, র্যান্ডের দেয়া এই মাপকাঠিকে চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করা সঠিক হবে না। আলোচনাটা দুয়েক লাইনে নামিয়ে আনার চেষ্টা সবসময়ই কাউন্টার প্রোডাক্টিভ। কারো মধ্যে কোন একটি বিষয়ে এক বা দুটি মডার্নিস্ট অবস্থান পেলে তাকে মডারেট বলে দেয়া ভুল। একইভাবে এক দুটো পয়েন্ট কেউ র্যান্ডের ভাষ্য অনুযায়ী 'উগ্রবাদী' অবস্থান গ্রহণ করলে সে 'মডারেট ইসলাম' অনুসরণ বা প্রচার করে না, এমন উপসংহার টানাও ভুল। এর ভালো দুটো উদাহরণ হল বহুবিবাহ এবং হিজাব। বর্তমান পৃথিবীতে যারা মডারেট ইসলাম প্রচারের রথী-মহারথী তাদের বেশির ভাগ এই দুটো অবস্থানে 'উগ্র মৌলবাদী'। আমরা এখানে আপাতত শুধু র্যান্ডের দেয়া শ্রেনীবিভাগ আর মাপকাঠি তুলে ধরলাম। মুসলিম হিসেবে আমরা কিভাবে যাচাইবাছাই করবো সেই আলোচনা ইন শা আল্লাহ্ পরের পর্বগুলোতে আসবে।
মজার ব্যাপারটা হল এই ১১টা ইসুর সবগুলো কিন্তু র্যান্ডের ভাষায় ‘রাজনৈতিক কিংবা আদর্শিক’ ইস্যু না। বরং এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ইস্যু হল ব্যক্তিগত জীবনাচার, বিশ্বাস কিংবা বিধানের সাথে যুক্ত। [জি]হাদ, গণতন্ত্র, ইসলামী রাষ্ট্র – এগুলো নিয়ে অ্যামেরিকা এবং পশ্চিমা লিবারেল ক্রুসেইডারদের যে সমস্যা আছে তা তো জানা কথা। কিন্তু, বহুবিবাহ, হিজাব, ইসলামের উৎস, মানবাধিকার, ব্যাক্তিস্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে অ্যামেরিকার কী সমস্যা? এগুলোকে মার্কার ইস্যু হিসেবে আনার কারণ কী?
এই প্রশ্নের দুটো উত্তর আছে। একটা উত্তর র্যান্ডের প্রতিবেদনে সরাসরি বলে দেয়া আছে, অন্য উত্তরটা সরাসরি বলা হয়নি। আমরা আগে র্যান্ডের দেয়া উত্তরটা দেখি।
র্যান্ডের মতে, অনেক সময় বিশ্বরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কিংবা আঞ্চলিক চাপের কারণে অনেক মুসলিম শক্তির ব্যাবহার বা সশস্ত্র পন্থার ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান গোপন করে। অথবা এসব ব্যাপারে অস্পষ্ট, দ্ব্যর্থক কথাবার্তা বলে। কিন্তু এখানে যেসব ‘লাইফস্টাইল’ কিংবা ‘বিশ্বাসগত’ (ডকট্রিনাল) ইস্যু আনা হয়েছে (বহুবিবাহ, হিজাব, চিন্তাধারার উৎস, মানবাধিকার ইত্যাদি) সেগুলোর ক্ষেত্রে নিজেদের প্রকৃত অবস্থান গোপন করা তাদের পক্ষে সম্ভব না। কারণ এবিষয়গুলো তাদের পরিচয়, আদর্শের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই এই ধরণের বিষয়গুলোকে মার্কার হিসেবে নিয়ে আসা দরকার। এগুলো ফিল্টার হিসেবে কার্যকরী।
এবার অন্য কারণটা বলি, যেটা র্যান্ড সরাসরি বলেনি। ইসলামকে পশ্চিমা বিশ্ব শুধু একটা রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে দেখে না। ইসলামকে তারা এক আদর্শিক এবং সভ্যতাগত শত্রু মনে করে। তারা মনে করে ইসলাম তাদের গড়া লিবারেল-সেক্যুলার বিশ্বব্যবস্থার জন্য হুমকি। ইসলাম শুধু তাদের রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক আগ্রাসনকে প্রত্যাখ্যান করে না, বরং ইসলাম তাদের সভ্যতার মৌলিক দর্শনকে অস্বীকার করে। ইসলাম তাদের এনলাইটেনমেন্ট এবং মডার্নিটির দর্শনের বিরুদ্ধে।
‘উগ্রবাদ’ হল এমন সবকিছু যা আধুনিক গণতন্ত্র, লিবারেল সেক্যুলার মূল্যবোধ, এবং অ্যামেরিকার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। তাই তারা ইসলামের এমন কিছু বিষয় এই লিস্টে নিয়ে এসেছে যেগুলো লিবারেল অবস্থানের সাংঘর্ষিক। যতোক্ষণ কোন মুসলিম এসব বিষয়ে ইসলামের অবস্থান আকড়ে থাকবে ততক্ষণ সে পাশমার্ক পাবে না। [জি]হাদ, ইসলামী রাষ্ট্র, গণতন্ত্রের মতো ইস্যুগুলোতে অ্যামেরিকার পছন্দের অবস্থান গ্রহণ করলে, কিংবা চুপ থাকলে হয়তো তাদেরকে সীমিত সময়ের জন্য সহ্য করা হবে। কিন্ত ইসলামের সাথে পশ্চিমা সভ্যতার যেখানে যেখানে সংঘর্ষ, সেখানে ইসলামের মূলনীতি ছেড়ে না দিলে হবে না। ইসলামকে লিবারেল-সেক্যুলার ফ্রেইমওয়ার্ক অনুযায়ী নতুন করে ব্যাখ্যা না করলে তারা অ্যামেরিকা এবং পশ্চিমের কাছে কখনো পুরোপুরিভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না।
দিনশেষে আদি ও অকৃত্রিম ইসলামী হল অ্যামেরিকা ও পশ্চিমের কাছে ‘উগ্র মৌলবাদ’। আর যে চিন্তাধারা, যে সব ফতোয়া, যেসব পদ্ধতি লিবারেল-সেক্যুলার কাঠামোর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়, এবং এই কাঠামোর অনেক প্রস্তাব ও অবস্থানকে মেনে নিয়ে সেগুলোর আলোকে ইসলামকে নতুন করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, সেটাই অ্যামেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য।