![](https://cms.chintaporadh.com/wp-content/uploads/2020/06/95286954_2577950522509430_5001795157733933056_n.jpg)
![](https://i0.wp.com/cms.chintaporadh.com/wp-content/uploads/2020/06/95732116_2577950582509424_381490484268236800_o.jpg?fit=580%2C967&ssl=1)
র্যান্ড, মডারেট ইসলাম, মডার্নিস্ট মুভমেন্ট– ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন সময় কথাবার্তা ওঠে। পক্ষেবিপক্ষে অনেক তর্ক হয়। তবে আফসোসের ব্যাপারে হল অনেকেই বিষয়গুলো সম্পর্কে ভাসাভাসা ধারণা নিয়ে কিংবা একেবারে না জেনে কথা বলেন। যার ফলে নিতান্ত আবেগপ্রসূত, ডিফেন্সিভ, কিংবা প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ কথাবার্তা দেখা যায়। আমি ঠিক করেছি, ইন শা আল্লাহ্ এই বিষয়টা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কিছু ম্যাটেরিয়াল তুলে ধরবো। যাতে করে যারা এ ব্যাপারগুলো নিয়ে জানতে আগ্রহী তারা জানার সুযোগ পান। তারপর নিরেট তথ্য আর কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনার ভিত্তিতে যে যার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
লেখাগুলো কিছুটা এলেমেলো হবে। আমি খুঁতখুঁতে মানুষ, মনমতো গুছিয়ে লিখতে গেলে দেখা যাবে কাজটা হয়তো আর করাই হয়ে উঠবে না। আশা করি লেখার এলেমেলোভাবে পাঠক ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
তাহলে শুরু করা যাক। আমরা শুরুটা একটু পেছন থেকে করি। ইসলাম এবং মুসলিমদের চিন্তা বদলানো পশ্চিমা প্রজেক্ট কতো আগে থেকে চলছে তা একটু দেখে নেয়া যাক।
ব্রিটিশরা মিশরে ঢুকেছিল তৎকালীন শাসক ইসমাইল পাশাকে তার আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে সাহায্য করার অজুহাতে। কিন্তু খুব দ্রুত এই ‘সাহায্য’ পরিণত হয়েছিল ঔপনিবেশিক দখলদারিত্বে। মিশরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সাথেসাথে ব্রিটিশরা এক সুদূরপ্রসারী ‘সংস্কার’ প্রক্রিয়া হাতে নেয়, যার প্রভাব আমরা আজও অনুভব করছি। সহজ ভাষায়, মিশরীয় সমাজ, শিক্ষা, চিন্তা এবং প্রশাসনকে নিজেদের আদলে গড়ে তোলার এক বিস্তৃত প্রজেক্ট চালু করে ব্রিটিশরা - মিশরকে ‘আধুনিক’ বানানোর প্রজেক্ট। ১৮৭৭-১৯০৭ পর্যন্ত মিশরের ব্রিটিশ দখলদারিত্বের নেতৃত্বে ছিল এভারলিন বেরিং ওরফে ‘লর্ড ক্রোমার’। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত ‘মডার্ন ইজিপ্ট’ বইতে মিশরের পশ্চিমাকরণের এ প্রক্রিয়া নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করে ক্রোমার।
‘লর্ড’ ক্রোমার তার বইতে কী বলেছিল দেখা যাক। র্যান্ড প্রজেক্টের আলোচনায় কথাগুলো কেন গুরুত্বপূর্ণ তা সম্ভবত পাঠক নিজেই ধরতে পারবেন।
১. পশ্চিমারা কখনো ইসলামী শাসন ও সরকার মেনে নেবে না।
ক্রোমারের ভাষায় – ‘কেবল মোহাম্মাদান নীতিমালা আর প্রাচ্যীয় ধ্যানধারণার ভিত্তিতে গড়া সরকারকে ইউরোপ মেনে এমন ধারণা করাই হাস্যকর। অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ এর সাথে জড়িয়ে আছে, (তাই এমন কিছু মেনে নেয়া সম্ভব না)’
২. মুসলিমদের অবশ্যই পশ্চিমা ধ্যানধারণা ও মূল্যবোধ গ্রহণ করতে হবে।
ক্রোমারের ভাষায় – ‘…নতুন প্রজন্মের মিশরীয়দেরকে বুঝিয়েসুঝিয়ে কিংবা প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে পশ্চিমা সভ্যতার মূল স্পিরিট ধারণ করাতে হবে।’
৩. মুসলিম সমাজে পশ্চিমাকরণ করতে হবে। আর এই প্রক্রিয়া শুরু করার অন্যতম মূল হাতিয়ার হল ‘নারী অধিকার’।
ক্রোমারের মতে - মুসলিম দেশগুলোতে ‘নারীর সামাজিক অবস্থান’ হল ইউরোপীয় ধ্যনধারণা আমদানির ক্ষেত্রে ‘মারাত্মক প্রতিবন্ধক’ হিসেবে কাজ করে।
৪. এক দল তরুণ সেক্যুলার মুসলিম তৈরি করতে হবে, যাদের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে
ক্রোমারের ভাষায় – ‘বাস্তবতা হল ইউরোপীয় শিক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবার পর একজন তরুণ মিশরীয় মুসলিমের ‘ইসলামিসম’ হারিয়ে যায়’।
৫. পশ্চিমকে অবশ্যই ইসলামের সংস্কার করতে হবে। এই সংস্কারের ফলে যে ‘ইসলাম’ পাওয়া যায় তা আর ইসলাম থাকে না। নামে ইসলাম, বাস্তবে অন্য কিছু।
ক্রোমারের ভাষায় – ‘…এটা কখনও ভোলা যাবে না যে, ইসলামের সংস্কার সম্ভব না। অর্থাৎ সংস্কাকৃত ইসলাম সত্যিকার অর্থে আর ইসলাম থাকে না। অন্য কিছুতে পরিণত হয়’।
৬. সংস্কার, আধুনিকায়ন কিংবা পশ্চিমাকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যারা তৈরি হয় তারা ‘ডি-মুসলিমাইযড’। তারা না মুসলিম হতে পারে, আর না পুরোপুরি ইউরোপিয়ান হিসেবে গণ্য হয়।
ক্রোমারের ভাষায় – ‘বর্তমানে মিশরীয় সমাজ নিরন্তর পরিবর্তনের যে প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে তার ফলে এমন এক দল মানুষ তৈরি হয়েছে যারা একই সাথে ডি-মুসলিমাইড মুসলিম এবং মেরুদন্ডহীন ইউরোপিয়ান’।
৭. ইসলামের ব্যাপারে মুসলিমদের চিন্তাকে প্রভাবিত করার ঐসব ব্যক্তিদের প্রমোট করতে হবে যারা ‘সংস্কারপন্থী’, যারা ‘আধুনিকায়ন’ চায়। মুসলিম বিশ্বে মডার্নিস্ট আন্দোলনের জনক মুহাম্মাদ আবদুহ ছিল ক্রোমারের পছন্দের ব্যক্তি। মিশরের গ্র্যান্ড মুফতি পদে আব্দুহকে বসানো এবং টিকিয়ে রাখার পেছনে ক্রোমার এবং ব্রিটিশদের অবদান ছিল।
ক্রোমারের ভাষায় – ‘ওরা (আব্দুহ-র মতো লোকেরা) ইউরোপীয় সংস্কারকদের সহজাত মিত্র…’
‘বহু বছর ধরে আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী সকলভাবে উৎসাহ দিয়েছি। তবে কাজটা সহজ ছিল না। একদিকে রক্ষণশীল মুসলিমদের দিক থেকে তার প্রতি ব্যাপক বিরোধিতা ছিল। অন্যদিকে, দুঃখজনকভাবে খেদিভের (শাসক) সাথে তার সম্পর্ক খুবই খারাপ ছিল। কেবল মাত্র শক্তিশালী ব্রিটিশ সমর্থনের কারণে আব্দুহ গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে তার অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল’।
দেখতেই পাচ্ছেন আজ থেকে ১০০ বছর আগে ‘আধুনিকায়ন’ প্রজেক্টের ব্যাপারে বলা কথাগুলো আজকের ‘র্যান্ড ইসলাম’ প্রজেক্টের সাথে প্রায় হুবহু মিলে যায়। আজকের ‘সিভিল ডেমোক্রেটিক মডারেট ইসলাম’ তৈরি প্রজেক্টে যেন সেই ‘ঔপনিবেশিক সংস্কার’ প্রজেক্টের উত্তরসূরী।
যেকোন জনগোষ্ঠীকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তাদের মধ্য থেকে ঐ আদর্শ মুছে দিতে হয় যা তাদেরকে দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বিপ্লবে উদ্ভূত করবে। পশ্চিমারা তাদের দীর্ঘ ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার আলোকে এটা জানতো। আর মুসলিমদের জন্য এই আদর্শ হল ইসলাম। ইসলামী শরীয়াহ এবং শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী সভ্যতা গড়ার আকাঙ্ক্ষা। ক্রোমারের ভাষায় ‘ইসলামিসম’। এই আদর্শকে নষ্ট করার উপায় হল ভেতর থেকে একে কলুষিত করা। কাজটা সহজ না। এর বিভিন্ন দিক আছে। পশ্চিমারা এমনভাবে শিক্ষাব্যবস্থা এবং প্রশাসনকে সাজাতে পারে যাতে করে এই ব্যবস্থাগুলোর মধ্য থেকে ‘ডি-মুসলিমাইযড’, মেরুদন্ডহীন, বাদামি চামড়ার সাহেব তৈরি হয়। এটা তারা করেছে। মধ্য প্রাচ্যে করেছে, উপমহাদেশেও করেছে।
কিন্তু এটুকু যথেষ্ট না। ইসলামের আদর্শকে নষ্ট করতে হলে যারা ইসলামী জ্ঞান এবং চিন্তাকে কলুষিত করতে হবে। পশ্চিমারা এটা সরাসরি করতে পারবে না। এটা এমন কিছু মানুষ করতে হবে যারা নামে মুসলিম, হয়তো বিশ্বাসেও মুসলিম, কিন্তু পশ্চিমা দর্শন ও সভ্যতা দ্বারা এতোটাই প্রভাবিত যে তারা পশ্চিমের আদলে ইসলামকে বদলে নিতে চায়। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় তারা ঐ ‘ইসলাম’টাই প্রচার করে যেটা পশ্চিমারা চায়। এরা হল সেই সংস্কারবাদী, মডার্নিস্ট কিংবা হাল আমলের ‘মডারেট’। আগ্রাসী পশ্চিমের ইসলাম সংস্কার প্রজেক্টের সহজাত মিত্র। পশ্চিমারা খুশিমনে এই সংস্কারবাদী কিংবা মডারেট ইসলাম প্রচারকদের সাহায্য করে। সমর্থন দিয়ে যায়। যেমন মুহাম্মাদ আব্দুহকে ক্রোমার সাহায্য করেছিল। গ্র্যান্ড মুফতির আসনে বসিয়েছিল।
এখানে আরো একটা প্রশ্ন এসে যায়, মুহাম্মাদ আব্দুহরা কি পশ্চিমের টাকা খায়?
উত্তর হল, টাকা খাওয়া না খাওয়ার বিষয়টা অপ্রাসঙ্গিক। কারণ তাদের বিরুদ্ধে আপত্তিটা টাকা খাওয়া নিয়ে না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হল তারা পশ্চিমের এজেন্ডা অনুযায়ী ইসলামকে পরিবর্তনের চেষ্টা করে। আর এই অভিযোগ যে সত্য, সেটা সাক্ষ্য খোদ পশ্চিমারাই দেয়। কখনো এই সাক্ষ্য ক্রোমারের বইয়ের মাধ্যমে আসে, কখনো র্যান্ডের রিপোর্টের মাধ্যমে আসে, কখনো হয়তো আসে উইকিলিক্সের মাধ্যমে। কাজেই তারা টাকা না খাওয়া না খাওয়াতে কিছু যায় আসে না। তারা যদি টাকা খাওয়ার পরও প্রকৃত ইসলাম প্রচার করে তাহলে আর অভিযোগের কিছু নেই। আর টাকা না খেয়েও যদি ‘পশ্চিমের ঠিক করে দেয়া ইসলাম’ প্রচার করে তাহলে টাকা না খেলেও তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোন পরিবর্তন হয় না। কাজেই এই প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক, এবং যারা এই প্রশ্নে আটকে যান তারা হয়তো মূল আলোচনায় বিষয়বস্তুই এখনো ধরতে পারেননি।
ইসলামকে পরিবর্তন করার জন্য পশ্চিমারা যে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এটা ঐতিহাসিক সত্য। এটা কোন কন্সপিরেসি থিওরি না। বিদ্বেষপ্রসূত বানোয়াট অভিযোগ না। একথা পশ্চিমারা খোলাখুলি স্বীকার করেছে। আজও করছে। ‘লর্ড ক্রোমার’ পরিকল্পনার ফসল হিসেবে যুলমাই খালিলযাদের মতো লোকেরা জন্ম নিয়েছে, যারা ক্রোমারদের কাজ করে যাচ্ছে। ‘সংস্কার’, ‘আধুনিকায়ন’ আর ‘পশ্চিমাকরণ’ এর জায়গায় এসেছে ‘মডারেট ইসলাম’, ‘ইসলামী জ্ঞান নিয়ে পুনঃভাবনা’ কিংবা ‘ইসলামকে বোঝার জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো পরিবর্তন’ এর কথা। কিন্তু মৌলিকভাবে এজেন্ডা সেই একই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা, মুসলিমরা – এই ব্যাপারে জানতে আগ্রহী না। আমরা নিজে থেকে এ ব্যাপারে জানার চেষ্টা তো করি না-ই, যখন কেউ এ বিস্ময়গুলো নিয়ে কথা বলে তখন আমরা ব্যক্তিমুগ্ধতা কিংবা দলবাজীর ওপরে উঠে কথাগুলো বিশ্লেষণও করি না।
ক্রোমারের বইয়ের লিংক - https://tinyurl.com/y7fgr3q2