‘ভুল প্রশ্নের ভুল উত্তর’ বইটা নিয়ে পোস্ট করার পর বিভিন্ন সূত্রে বেশ কিছু প্রশ্ন পেয়েছি। ইন্ডিভিযুয়ালি সবাইকে উত্তর দেয়া একটু সময়সাপেক্ষ হয়ে যায়, বিভিন্ন জটিলতাও থাকে। তাই এ পোস্টে উত্তরগুলো একসাথে দেয়ার চেষ্টা করছি।

১) বই কখন বের হবে? বই বের হলে কিভাবে জানতে পারবো? বই কিভাবে পাবো?

  • ২৫ শে ফেব্রুয়ারির দিকে ইন শা আল্লাহ। প্রকাশনীর পেইজে নিশ্চয় জানিয়ে দেয়া হবে। আমিও ইন শা আল্লাহ জানাবো। বই পাবার জন্য বিভিন্ন অনলাইন বুক শপে বইয়ের জন্য বলে রাখতে পারেন।

২) ইসলামী ব্যাংকিং এবং ফাইন্যান্স নিয়ে পড়ছেন এবং গবেষণা করছেন এমন কয়েকজন জানতে চেয়েছেন এ ব্যাপারে হেল্পফুল অন্য কোন ম্যাটেরিয়াল আছে কি না?

  • নিচের কিছু লিঙ্ক দেখতে পারেন,

ক) তারেক আল-দিওয়ানির সাইট – Islamic-finance.com
বেশ কিছু ভালো প্রবন্ধ পাবেন ‘editorial’ সেকশানে। এছাড়া একটা ফ্রি কোর্সও আছে।

খ) ড. মুহাম্মাদ যাহিদ সিদ্দিকী মুঘল (বইয়ের লেখক) এর পিএইচডি থিসিস দেখতে পারেন, Convergence Between Theory And Practice Of Islamic Banking: An Empirical Analysis - http://prr.hec.gov.pk/jspui/handle/123456789/8152

আরো দেখতে পারেন –
গ) A Framework For Evaluating Islamic Banking From ‘Within’, by Dr. Zahid Siddiqui & Dr. Mazhar Iqbal - https://bit.ly/2tk3Jxz

ঘ) Theory of Islamic Banking: FROM GENESIS TO DEGENERATION, by Dr. Muhammad Zahid Siddique & Dr. Mazhar Iqbal - https://bit.ly/2GCXxsj

ঙ) Islamic Economics: A Plea for Islamic Capitalism, Dr. Muhammad Zahid Siddiqui - https://bit.ly/2MZBhde

৩) ব্যাংক আজকের একটা বাস্তবতা। আপনি এটার কী বিকল্প দিয়েছেন? বিকল্প না দিয়ে কেন সমালোচনা করছেন?

আচ্ছা ব্যাংক কী কী কাজ করে বলুন তো? ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পয়সা লেনদেন হয়, নিরাপদে সংরক্ষনের জন্য ব্যাংকে টাকা রাখা, এবং ব্যাংক লোন দেয়। ইসলামী ব্যাংকিং এর বিরুদ্ধে কিছু বলা হলেই ব্যাংক কতোটা সর্বব্যাপী প্রতিষ্ঠান সেটা সবাই বোঝাতে চলে আসেন। ব্যাংক না থাকলে যেন বাঁচাই যাবে না, এমন একটা অবস্থা। এবং এটা বোঝানোর সময় ব্যাংকের সেইফ কিপিং এবং মানি ট্র্যান্স্যাকশানের ফাংশানগুলো দিয়ে উদাহরণ দেয়া হয়। কিন্তু সেক্যুলার বলেন কিংবা ইসলামী, ব্যাংকিং এর ব্যাপারে সমালোচনাটা তার লোন দেয়ার ফাংশানটা নিয়ে করা হয়।

মানি ট্র্যান্সফারের জন্য তো বিভিন্ন মেথড আছে। হুন্ডি, হাওয়ালা ইউয করে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়। বিভিন্ন মানি ট্র্যান্সফার সার্ভিস ও আছে। আর যারা ইসলামী ব্যাংকের পক্ষে এতো প্রচারনা করেন তারাও অনেক সময় টাকা ট্র্যান্সফারের জন্য প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবহার করেন। কাজেই মানি ট্র্যান্সফারটা এখানে ইস্যু না।

টাকার সেইফকিপিং এর জন্যও যে ৩৫/৪০ বছর ইসলামী ব্যাংকিং এর পেছনে দৌড়ানো হয়েছে সে সময়ে অন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যেতো। টাকা নিজের কাছেও রাখা যায়, আমি এমন ব্যারিস্টারকে চিনি যার মাসে লাখ লাখ টাকা ইনকাম, কিন্তু ১ টাকাও ব্যাংকে রাখে না। এছাড়া যদি আপনি বাধ্য হন, যদি আপনার স্যালারি ডিরেক্ট ব্যাংকে যায়, বা অন্য কোন বাধ্যবাধকতা থাকে তাহলে আপনি জাস্ট টাকা জমা রাখার অ্যাকাউন্ট করুন। এখানে ‘ইসলামী’ ব্যাংক আর অন্য ব্যাংকের তফাত কী? একটা কথা বলা হয় যে, ‘সুদি ব্যাংকে টাকা রাখলে ব্যাংক আপনার টাকা দিয়ে সুদ খাবে, আপনি অন্যায় কাজের সহযোগী হবেন’। এটা ভুল কথা। অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং নিয়ে না জানা এবং ভুল জানা লোকেরা সাধারণত এসব বলে থাকে। ব্যাংক আপনার টাকা দিয়ে কাউকে লোন দেয় না। এটা প্রমাণিত বিষয়। (বিস্তারিত জানতে দেখুন - https://bit.ly/2SMOmvK)

ব্যাংক – সেটা সো কলড ‘ইসলামী’ ব্যাংক বলুন আর প্রচলিত ব্যাংক বলুন, টাকার সেইফকিপিং আর লেনদেনের জন্য আপনার কাছে আসে না। সে চায় আপনি তার কাছ থেকে লোন নেবেন। আর যখন সমালোচনা করা হয় তখনও ব্যাংকিং এর এ ফাংশানটা নিয়েই করা হয়।

এখন বোঝান তো কিভাবে ব্যাংক লোন নেয়া জীবনের একটা আবশ্যিক বিষয় যেটা না থাকলে জীবনযাত্রা থমকে যাবে? কতো শতাংশ মানুষ ব্যাংক লোন পায়, আর কতো শতাংশ আসলেই বাধ্য হয়ে লোন নেয়? আমি কিছু ডেইটা দেই, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে।

মোবাইল ব্যাংকিং এর প্রসার, কৃষকদের জন্য ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, স্কুল লোন, মাইক্রো ফাইন্যান্স এসব কিছুর পর বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্কদের ৩৭% এর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি (Financial Inclusion) আছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি (Financial Inclusion) মানে হল অর্থাৎ মোবাইল ব্যাংকিং, ‘১০ টাকার অ্যাকাউন্ট’, স্কুল ব্যাংকিং, সাধারণ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি সব মিলিয়ে কমপক্ষে ১টি অ্যাকাউন্ট আছে প্রাপ্তবয়স্কদের মোট ৩৭% এর।

সূত্র – InterMedia, 2017। লিংক : http://finclusion.org/country/asia/bangladesh.html…।

আর রেজিস্টার্ড ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে প্রাপ্তবয়স্কদের ২০% এর। এবং এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মধ্যে ‘১০ টাকার অ্যাকাউন্ট’ জাতীয় অনেক কিছু আছে, যেগুলো সরকার, এনজিও ইত্যাদির পক্ষ থেকে একরকম জোর করে খুলে দেয়া হয়েছে। মানুষ ইচ্ছে করে খোলেনি।

জাতিসংঘের হিসেবে অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ১৬.৭৩ কোটি। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যার ৬৫.৩৭%-কে প্রাপ্তবয়স্ক ধরে হিসেব করলে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩.০৮% এর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। এই ১৩% কিন্তু সবাই লোন নেয় না। বরং বেশিরভাগ মানুষ জাস্ট টাকা জমা রাখার জন্য ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট খোলে।কাজেই ব্যাংকিং ছাড়া জীবন অচল, এটা ইন্ডিভিযুয়াল লেভেলে সত্য না, বরং একটা মিথ।

তাহলে এটা কিভাবে এমন বিষয় হয় যা থেকে কোনভাবেই বের হওয়া সম্ভব না? যদি বাধ্য হন, যদি আসলে লোন নেয়া ছাড়া আপনার আর কোন উপায় না থাকে, যদি জীবন কিংবা অঙ্গহানির আশংকা থাকে তাহলে তো আপনি প্রচলিত ব্যাংক থেকেও লোন নিতে পারবেন। যে দলিল দিয়ে ‘ইসলামী’ ব্যাংকিংকে জায়েজ করার চেষ্টা করা হয়, সেই দলিল অনুযায়ীই। এখানে একমাত্র পার্থক্য হল, আপনি বাধ্য না হয়েও লোন নিতে চান, অথবা ব্যাংকে চাকরি করতে চান, অথবা সামহাও ব্যাংকের সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চান আবার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে অনুশোচনা ও অপরাধবোধ থেকেও মুক্ত থাকতে চান, তাই বিভিন্ন যুক্তি দিচ্ছেন।

দ্বিতীয়ত, ‘ইসলামী’ ব্যাংকিং যদি শরীয়াহর শর্ত অনুযায়ী হারাম সাব্যস্ত হয় তাহলে সেটাকে হারাম বলার আগে, অথবা সমালোচনা করার আগে বিকল্প দিতেই হবে – এ মূলনীতি কোন জায়গায় আছে? ভুলকে ভুল বলা যাবে না? হারামের বিকল্প দেয়ার দায়িত্ব ইসলাম কখন নিয়েছে?

লেখক যাহিদ সিদ্দিকী খুব সুন্দর বলেছেন,

“এখন প্রশ্ন হলো সমাজের এই ক্ষুদ্রসংখ্যক মানুষের প্রয়োজনকে কি ‘পুরো রাষ্ট্রের প্রয়োজন’ বলে স্বীকৃতি দেয়া যায়? সমাজের অধিকাংশ মানুষ, যারা ব্যাংক, স্টক এক্সেইঞ্জ এবং বীমা কোম্পানির সাথে জড়িত না, তারা কি জীবনের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত? আর ইসলামী ব্যাংকগুলো সমাজের অধিকাংশ মানুষের পরিবর্তে নির্দিষ্ট শ্রেণির স্বল্পসংখ্যক মানুষের সমস্যা সমাধান নিয়ে এত চিন্তিত কেন? ”

৪) এটা ইজতিহাদি বিষয়, নিজের মত চাপিয়ে দেন কেন?

ভালো কথা। মানলাম ইজতিহাদি বিষয়। ইজতিহাদ করে কেউ কেউ হালাল বলেছেন, সেটা আপনি প্রচার করছেন। ইজতিহাদ করে কেউ কেউ হারাম বলেছেন, সেটা আমি প্রচার করছি। আপনি কেন এটা মানতে পারছেন না? কেন আপনি মূল বক্তব্য না শুনে, বোঝার চেষ্টা না করে, অনর্থক তর্ক করছেন?

যদি ইজতিহাদি বিষয়ই হয় তাহলে ভিন্ন মত প্রকাশ করলে আপনি সেটা ব্যাক্তিগতভাবে কেন নিচ্ছেন?

পাকিস্তানের অনেক আলিম ফতোয়া দিয়ে বলেছেন ‘ইসলামী ব্যাংকিং হারাম এবং এটাই জমহুরের মত’। যাদের মধ্যে মাওলানা তাকী উসমানীর সরাসরি উস্তাদ মাওলানা সলিমুল্লাহ খান রাহিমাহুল্লাহও আছেন। বাংলাদেশের আলিমদের অনেকেও বলেছেন। অথচ যখন ইসলামী ব্যাংকিং এর প্রচার করা হচ্ছে তখন বলা হচ্ছে জমহুরের মত হল এটা হালাল। প্রচারের সময় ‘ইজতিহাদি বিষয়’ বলে স্বীকার করা হবে না। কেউ সমালোচনা করলে সেটা ইজতিহাদি বিষয় হয়ে যাবে। অদ্ভুত দ্বিমুখীতা!

৫) ইসলামী ব্যাংকিং এর পক্ষে লোকেরা তো তাও চেষ্টা করছে। আপনারা কেন তাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন?

  • ‘ইজতিহাদি বিষয়ে’ ভিন্ন ইজতিহাদ তুলে ধরা কিভাবে দূরে সরানো হয়? আপনার কাজকে ভুল বলে বিশ্বাস করলেও ভুল বলা যাবে না? এটা একটা অদ্ভূত বিষয় যে সমালোচনা করা হলে প্রথমে বলা হবে 'এরা এ বিষয় নিয়ে জানে না। বা এদের বক্তব্য ক্লিয়ার না'। আবার যখন বিস্তারিত ভাবে আপত্তি প্রকাশ করা হয় তখন ‘কেন বিরোধিতা করছেন’ এধরণের কথা বলা হয়। আর যদি সমালোচনার কোন জবাব দেয়া সম্ভব না হয় তখন ‘আপনি কোন বিকল্প দিয়েছেন?’ এ প্রশ্ন করা হয়।

সমালোচনা করা উচিৎ, প্রশ্নও করা উচিৎ। কিন্তু তার আগে যে বিষয়ের সমালোচনা করছেন সেটা তো আপনার দেখতে হবে। কেন বিরোধিতা করা হচ্ছে, কোন কোন বাস্তবতা ও দলিলের আলোকে করা হচ্ছে সেটা দেখুন। আপত্তিগুলো অ্যাড্রেস করুন। সেটা না করে জাস্ট মুখস্থ ধরাবাঁধা কিছু কথা আওড়ে যাওয়া হবে, আবার ইজতিহাদের দাবিও করা হবে, এধরণের কথা তো সিরিয়াসলি নেয়া সম্ভব না।

একদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের দাবি করবেন আরেকদিকে ভিন্নমত দেখলেই মুখস্থ বিরোধিতা শুরু করে দেবেন সেটা তো হবে না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনকে সহনশীলতার যেসব সবক দিয়েছেন সেগুলো নিজেরাও নিজেদের জীবনে একটু প্রয়োগের চেষ্টা করুন নাহয়। চক্ষুলজ্জার কারণে হলেও করা উচিৎ। নাহলে তো প্লেইন হিপোক্রিসি হয়ে যায়। বইটা পড়ুন। তারপর যা ভুল মনে হয় যতোটুকু ভুল মনে হয় রেটোরিকাল এবং পলেমিকাল কথা বাদ দিয়ে সেটা নিয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনা করুন।