অনলাইনে দাওয়াহর মূল উদ্দেশ্য কী?
মূল টার্গেট অডিয়েন্স কারা?
লেখালেখিসহ অন্যান্য কন্টেন্টের কোন উদ্দেশ্য, কাদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হবে?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে চিন্তা করা জরুরী।
আমার মূল উদ্দেশ্য কি-
- নাস্তিক এবং সেক্যুলারদের ইসলামবিরোধী কথাবার্তার জবাব দেয়া? বা তাদের ইসলামের দাওয়াহ দেয়া?
- রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, শিল্প কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সেক্যুলারদের সাথে টেক্কা দেয়া?
- বাঙ্গালি সংস্কৃতির পরিবর্তে একটা ইসলামী বাঙ্গালি সংস্কৃতি কিংবা সেক্যুলার বুদ্ধিজীবি ঘরানার বদলে একটা ইসলামী বুদ্ধিজীবি ঘরানা তৈরি করা?
- অন্য মাসলাক বা ঘরানার মুসলিমদের ভ্রান্ত ধ্যানধারণার খণ্ডন করা?
- নাকি আমার মূল উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট কোন মতাদর্শ দ্বারা চালিত না হওয়া আমজনতাকে আদর্শিক মুসলিম পরিণত করার চেষ্টা করা ?
ওপরের কোন পয়েন্টের ব্যাপারে শারঈভাবে আপত্তি তোলার সুযোগ নেই। একটা করতে হলে বাকি সব বন্ধ রাখতে হবে, এমনটাও না। প্রশ্ন হল মূল উদ্দেশ্য কোনটা হওয়া উচিৎ? কোনটাকে প্রাধান্য দেয়া উচিৎ? আমার সীমিত সামর্থ্যকে কোন দিকে ব্যয় করা বেশি লাভজনক?
আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী অনলাইনের বেশিরভাগ কাজ হয় আদর্শিক সেক্যুলার আর আদর্শিক মুসলিমদের কথা মাথায় রেখে। যদিও সবসময় সচেতনভাবে হয়তো করা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় আমরা নাস্তিকদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি, যুক্তিখন্ডন করছি বা তাদের আদর্শকে অ্যাটাক করছি।
অথবা আমরা এমন সব আলোচনায় ফোকাস করছি যেগুলো ঐসব মুসলিমরা ধরতে পারে যারা মোটামুটি দ্বীন সম্পর্কে জানে এবং মানার চেষ্টা করে। দু ধরণের আলোচনাই আমজনতাকে তেমন একটা আকর্ষন করে না।
আমি কাজগুলোকে অদরকারী বলছি না। বরং এধরণের কাজগুলো করার কিছু মানুষ সবসময়ই থাকা দরকার। কিন্তু স্পেশালাইযড হবার কারণে এধরণের আলোচনা সীমাবদ্ধ থেকে যায় একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই। এই দু’ দিকে ফোকাস করলে শ্রমের তুলনায় প্রাপ্তি তুলনামূলকভাবে কম।
আদর্শিক সেক্যুলাররদের দিকে মূল মনোযোগ দেয়া একেবারেই লাভজনক না। তারা ইসলামের বিরোধিতা না জানার কারণে করে না। ইসলামের মৌলিক দাওয়াহ তাদের কাছে পৌছেছে। বেশিরভাগই ইসলামের বিরোধিতা করে জেনেবুঝে। যারা সরাসরি বিরোধিতা করে না, তারাও বুঝেশুনে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন কামনা করে।
অনলাইন তর্কবিতর্ক আর লেখালেখি দিয়ে এদের সামষ্টিক মনোভাব বদলাবে না, বিরোধিতাও থামবে না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে দাওয়াহর ফলে কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণ করতে পারে, এবং আল্লাহ হিদায়াত দেয়ার মালিক। আদর্শিক সেক্যুলাররা বন্ধ্যা, মৃত মাটির মতো। যাই করা হোক না কেন, এই মাটিতে ফসল ফলবে না।
তবে মুসলিমদের স্বার্থেই অনেক সময় সেক্যুলার-নাস্তিকদের কিছু কিছু কথার জবাব দেয়া জরুরী হয়ে দাড়ায়। তবে এসব ক্ষেত্রেও মূল অডিয়েন্স থাকে মুসলিমরাই। মুসলিমদের মধ্যে বিভ্রান্তি বা সংশয় তৈরি হবার আশঙ্কা মোকাবিলাই থাকে মূল লক্ষ্য।
একইভাবে কালচার প্রোডাকশান কিংবা প্রচলিত অর্থে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতায় মূল মনোযোগ দেয়া অর্থহীন। কারণ সংস্কৃতি এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের ন্যারেটিভ নিয়ন্ত্রনের বিষয়টা শাসনক্ষমতার সাথে জড়িত। যমিনে প্রতিষ্ঠা ছাড়া আদর্শ প্রতিষ্ঠা সাধারণত হয় না। নূহ আলাইহি সালাম এবং নবী ﷺ নিঃসন্দেহে প্রকৃত অর্থে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তাঁদের কওমের বিরোধিতাকারীদের ওপর বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তাঁদের দুর্বল অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন এসেছে অন্য কোন পথে।
অন্যদিকে নিজের ঘরানা কিংবা অন্য ঘরানার মুসলিমদের উদ্দেশ্য করে তৈরি করা কনটেন্ট দিয়ে (বিশেষ করে বিভিন্ন মাসলাকগত বিতর্ক) সহজে সমর্থন আর বাহবা পাওয়া গেলেও, এধরণের আলোচনা একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যায় না। নিজ ঘরানার ভেতর প্রতিধ্বনি এবং পুনরাবৃত্তির কারণে আমাদের চিন্তাভাবনাগুলো আমাদের কানেই অনেক জোরালো শোনায়। কিন্তু বৃহত্তর সমাজের ওপর তেমন কোন প্রভাব পরে না।
ইসলামী বইয়ের কথা চিন্তা করা যেতে পারে। অধিকাংশ বই এমন পাঠকের কথা চিন্তা করে ছাপানো হয় যারা আগে থেকেই ইসলামী বইয়ের ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু ‘প্র্যাকটিস মুসলিম’-দের গণ্ডি ছাড়িয়ে আম জনতাকেও আকর্ষন করতে পারা বইগুলোই সাধারণত সামাজিক প্রভাবের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি সফল হয়।
‘বাঁধা কাস্টোমার’ কথা মাথায় রেখে প্রডাকশানে যাবার নীতি ব্যবসার দিক থেকে সঠিক। কিন্তু দাওয়াহর ক্ষেত্রে এটা যথেষ্ট না। কারণ দাওয়াহর মৌলিক একটা লক্ষ্য হল সম্প্রসারণ, বা নিজ আদর্শের প্রভাব বলয়কে বিস্তৃত করা। বাঁধা কাস্টোমারের কথা চিন্তা করলে এটা করা সম্ভব না। তাছাড়া নিজেদের ঘরানার জন্য কন্টেন্ট তৈরিকে মূল লক্ষ্য বানানো অনেকটা তেলা মাতায় তেল দেয়ার মতো। এই জমিগুলোতে অলরেডি চাষ হচ্ছে। যা পাওয়া যাচ্ছে তার অতিরিক্ত নতুন কিছু আসার সম্ভাবনা কম।
কিন্তু জনতা হল এমন জমি যা এখনো অব্যবহৃত, এবং উর্বর। এখানে আগাছা জমেছে সত্যি। আবর্জনাও জমেছে। কিন্তু এ জমিতেই শ্রম অনুযায়ী ফসল পাবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ভূখণ্ডে দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক পরিবর্তন আনতে হলে দাওয়াহর ক্ষেত্রে আম জনতার ওপর ফোকাস করা আবশ্যক।
তাই অনলাইনসহ যেকোন পাবলিক দাওয়াহ কার্যক্রমের মূল টার্গেট অডিয়েন্স হওয়া উচিৎ আম জনতা। এবং দাওয়াহর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ, তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তায় একটা প্যারাডাইম শিফট আনা। তাদের চিন্তার কেন্দ্র এবং অক্ষকে বদলে দেয়া। নিজেদের যারা মুসলিম বলে পরিচয় দেয়, তাদের সিগনিফিক্যান্ট একটা অংশকে আদর্শিক মুসলিমে পরিণত করা।
সব দিক বিবেচনা করলে, সীমাবদ্ধতাগুলো মাথায় রাখলে এ ভূখণ্ডে মুসলিমদের দুর্বল অবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে যৌক্তিক স্ট্র্যাটিজি। তাই দাওয়াহর ক্ষেত্রে সামষ্টিকভাবে অধিকাংশ সময় ও শ্রম টার্গেট অডিয়েন্স এবং উদ্দেশ্যের পেছনে দেয়া উচিৎ।
টার্গেট শ্রেনী হিসেবে আম জনতাকে গ্রহণ করা হলে দাওয়াহর কিছু প্যারামিটার আপনাআপনি ঠিক হয়ে যায়। যেমন আমার ভাষা আম জনতার কাছে বোধগম্য হতে হবে।
টার্গেট অডিয়েন্স বোধিচিত্ত বা চিন্তা পাঠচক্র টাইপ কেউ হলে, তাদের ভাষা অনুকরণের যৌক্তিকতা হয়তো খুঁজে বের করা যেতে পারে, কিন্তু আমজনতার ক্ষেত্রে এই ভাষা এবং অ্যাপ্রোচ কাজ করবে না।
নাস্তিকদের খন্ডনমূলক আলোচনার অ্যাপ্রোচ আর বাঙ্গালি সংস্কৃতির সাথে ইসলামের সাংঘর্ষিকতা বোঝানোর অ্যাপ্রোচও এক হবে না।
একইভাবে দাওয়াহর ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন মৌলিক আকীদাহর প্রচারে মনোযোগী হওয়া। ঐ ধ্যানধারণাগুলোর মোকাবিলা করা যেগুলো সাধারন মানুষকে সত্যিকার অর্থে ইসলাম পালন করা থেকে বিরত রাখছে।
সহজ নীতি হলেও এর বাস্তবায়ন কেন যেন বেশ কঠিন হয়ে দাড়ায়। এই নীতি অনুযায়ী থেকে ফরহাদ মজহার কিংবা এজাতীয় কারো চিন্তার খন্ডনের চেয়ে জাতীয়তাবাদের মতো মতবাদ কিংবা যিনার স্বাভাবিকীকরণের মতো বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দেয়া জরুরী। যদিও দুটোই জরুরী। কারণ ফরহাদ মজহারদের রিডারশিপ সেক্যুলারদের মধ্যেও একটা এক্সট্রিম মাইনরিটি। কিন্তু জাতীয়তাবাদের প্রভাব সমাজের সব শ্রেনীর মানুষের মধ্যে মোটামুটি সর্বগ্রাসী।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল দাওয়াহ এমনভাবে উপস্থাপন করা যাতে টার্গেট অডিয়েন্সের ওপর সেটা প্রভাব ফেলে। আলোচনা যেন অডিয়েন্স সহজে ধরতে পারে। আম জনতাকে প্রভাবিত করার উপায় একটা না। সবাই একইভাবে কথা বলবে বা লিখবে, এটাও জরুরী না। কিন্তু ব্রড অ্যাপিল তৈরি করার দিকটা– আমার কথা যেন নিজস্ব গণ্ডির বাইরের মানুষের কাছেও যেন বোধগম্য হয়, অ্যাকসেসিবল হয়–এটা মাথায় রাখা দরকার।
এ প্রত্যেকটা বিষয় এবং এমন আরো অনেক বিষয় তখনই নির্ধারিত হয় যাচ্ছে, যখন আমরা একটা নির্দিষ্ট টার্গেট অডিয়েন্স এবং উদ্দেশ্য বাছাই করছি। টার্গেট অডিয়েন্স এবং দাওয়াহর উদ্দেশ্যকে বদলে নিলে, বদলে যাবে অনেকগুলো প্যারামিটারও।
কিন্তু এ দিকগুলো আমাদের দাওয়াহ থেকে অনেকটাই অনুপস্থিত। এর কারণ হল, আম জনতাকে আমাদের টার্গেট অডিয়েন্স মনে করি না। আমাদের টার্গেট অডিয়েন্স নাস্তিকরা, বুদ্ধিজীবিরা বা অন্য ‘প্র্যাকটিসিং মুসলিমরা’। সামষ্টিকভাবে অ্যাপ্রোচটা আমার মতে সঠিক না।
অবশ্যই কিছু লেখক বা বক্তা এমন থাকা প্রয়োজন, যারা এই ধরণের টপিকে কাজ করবেন, এমনকি স্পেশালাইয করবেন। কিন্তু সামষ্টিকভাবে অনলাইনে লেখালেখি বা কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের ৮০% যদি সেক্যুলার বা আদর্শিক মুসলিমদের কথা মাথায় রেখে করা হয়, তাহলে সেটা বড় ধরনের মিসক্যালকুলেইশান। এটাকে সীমিত সামর্থ্যের যথাযথ ব্যবহার বলা যায় না।
আবারো বলি, কোন কাজকে আমি অপ্রয়োজনীয় বলছি না। আমি বলছি না, সবাইকে একই বিষয়ে কাজ করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে কার কোন বিষয়ে কাজ করা উচিৎ, এটা নিয়েও কিছু বলা হচ্ছে না। আমি কেবল বলছি অনলাইনসহ যেকোন পাবলিক দাওয়াহর মূল ফোকাস হওয়া উচিৎ আম জনতা এবং তাদের চিন্তাধারা ও চিন্তার কাঠামো বদলে দেয়া।
যারা কোন না কোনভাবে এমন দাওয়াহর সাথে যুক্ত সামষ্টিকভাবে তাঁদের মূল সক্ষমতা এবং সময়ের সিংহভাগ (ধরুন ৮০%) এই দিকে খরচ করা দরকার।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হল, আমরা আসলে এতো চিন্তাভাবনা করে ফেইসবুক চালাই না। অধিকাংশের জন্য এটা কোন ইস্যু না হলেও, যারা দাওয়াহর সাথে যুক্ত বিষয়গুলো চিন্তা করা তাদের জন্য জরুরী। আল্লাহ এবং দ্বীনের জন্য কিছু করার নিয়্যাত করলে, তা যতো তুচ্ছই হোক, সেটা এলোমেলোভাবে করাকে আসলে জাস্টিফাই করা যায় না। ঈমানের সর্বোচ্চ স্তর ইহসান, এবং সর্বোত্তম ইহসান হল মহান আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের জন্য।