এক সময় ‘বিখ্যাতদের শেষ কথা’ জাতীয় আর্টিকেল খুব জনপ্রিয় ছিল। মৃত্যুর আগে বিখ্যাত লোকেরা কে কী বলেছে, তা নিয়ে সাজানো লেখা। মৃত্যুশয্যায় মানুষের মুখোশগুলো খুলে যায়। সব কৃত্রিমতা আর ভনিতার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে মানুষের আসল চেহারা। এক অর্থে মৃত্যু মানুষের জীবনকে সিম্বোলাইয করে। মানুষ যেভাবে বাঁচে, সাধারণত তার মৃত্যু তেমনই হয়। জীবনের কেন্দ্র মৃত্যুর সময় বদলায় না।
অ্যালডাস হাক্সলির কথাই ধরুন। বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক এবং দার্শনিক হাক্সলি মনে করতো এলএসডি এবং মেসকালিনের মতো সাইকোট্রপিক ড্রাগসগুলো মানুষের চেতনা, অনুভূতি আর বিশ্বাসের জগতে নতুন অনেক দরজা খুলে দিতে পারে। তার বিভিন্ন লেখাতে বিভিন্ন সময় এ বিষয়টা উঠে এসেছে। মৃত্যুর সাথে বোঝাপড়ার জন্যেও হাক্সলি বেছে নিয়েছিল এলএসডি-কে। স্ত্রী-কে উদ্দেশ্য করে মৃত্যুর আগে হাক্সলির শেষ কথা ছিল –
‘এলএসডি, ১০০ মিলিগ্রাম, ইন্ট্রাম্যাসকুলার’।
লিওনার্দো ডা ভিঞ্চি ছিল একজন পলিম্যাথ, জিনিয়াস এবং পারফেকশনিস। একজন ব্যক্তির মধ্যে বহুমুখী প্রতিভা, সাধারণের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমত্তা এবং খুতখুতে হওয়ার বৈশিষ্ট্যগুলোর মিশ্রণ সাধারণত সুখকর হয় না। লিওনার্দোর জীবনের মূল ফোকাস ছিল তার আর্ট। এর ছাপ তার শেষ কথায় দেখা যায়। মৃত্যুর আগে লিওনার্দো বলেছিল,
‘আমি স্রষ্টা এবং মানুষকে অসন্তুষ্ট করেছি। আমার কাজ যতোটা চমৎকার হওয়া উচিত ছিল ততোটা হয়নি।’
অন্য আরো অনেকের মতোই ডা ভিঞ্চি এবং হাক্সলি ওইভাবেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে যেভাবে তারা বেঁচেছিল। শেষ মূহুর্তে একজন খুজেছিল সাইকোট্রপিক ড্রাগ, আর আরেকজনকে আচ্ছন্ন করেছিল তুচ্ছ অবসেশান নিয়ে আফসোস।
মৃত্যুর সাথে বোঝাপড়ার এমন অনেক গল্প আমরা শুনেছি, পড়েছি। অবাক হয়েছি। হয়তো এগুলোর মধ্যে আবিস্কার করেছি গভীর কোন জীবনবোধ। আমাদের সভ্যতা এ ধরনের গল্পগুলো হাইলাইট করে। কারণ এ সভ্যতা এমন মানুষ চায়, এমন মানুষ তৈরি করে যারা এভাবেই জীবন ও মৃত্যুকে দেখবে। কিন্তু এ বোঝাপড়ার আরেকটা ধরণ আছে। আছে অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি। আছে অন্যরকম কিছু গল্প।
আসুন এমন দুটো ছোট গল্প শোনা যাক।
গল্প ১ - সালমান আল-ফারিসি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিখ্যাত সাহাবী। শেষ জীবনে থাকতেন একটা ভাড়া করা ঘরে। যখন মৃত্যুর সময় আসলো, সালমান আল-ফারিসি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাড়িওয়ালা মহিলাকে ডেকে পাঠালেন।
বললেন -
তোমার কাছে যা গচ্ছিত রেখেছিলাম, সেটা নিয়ে এসো।
মহিলা একটা থলে নিয়ে আসলেন। থলের ভেতরে ছিল মেশক (সুগন্ধী)।
একটা পাত্রে কিছু পানি নিয়ে এসো, নির্দেশ দিলেন সালমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।
পানি আনা হল। সালমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু পানির সাথে মেশক মেশালেন । তারপর বললেন –
এই পানি আমার চারপাশে ছিটিয়ে দাও। আল্লাহ্র এমন কিছু সৃষ্টি আমার সাথে দেখা করতে আসবেন, যারা খাদ্য গ্রহণ করেন না। কিন্তু তাঁরা সুগন্ধ পান।
মহিলা নির্দেশ পালন করলেন। তারপর সালমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন,
চলে যাও, আর দরজাটা বন্ধ করে দাও।
মহিলা তাই করলেন। কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকে দেখলেন সালমান মৃত্যুবরণ করেছেন। রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।
গল্প ২ - সা’দ ইবনু আবি ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মৃতুশয্যায়। তিনি নির্দেশ দিলেন,
আমার পশমী জুব্বাটা নিয়ে এসো। বদরের দিন এই পোশাকে আমি কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম। আজকের এই দিনের জন্য তা আমি সংরক্ষণ করে রেখেছি। এটা দিয়ে আমাকে কাফন পরাও।
তাঁদের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) প্রস্তুতির সাথে আমাদের সময়কার ‘বিখ্যাত’ ব্যক্তিদের প্রস্তুতির তুলনা করুন তো। দেখুন তো দুটো দৃষ্টিভঙ্গি, আর দুটো পথের মধ্যে কতো পার্থক্য! আচ্ছা বিখ্যাতদের কথা বাদ দেই। আসুন আমাদের অবস্থার সাথে এই দুই সাহাবী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) এর অবস্থার তুলনা করি।
মৃত্যুকে তাঁরা কিভাবে দেখেছেন? আর আমরা কিভাবে দেখি? তাঁরা কিভাবে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন আর আমি কী প্রস্তুতি নিয়েছি? সালমান আল-ফারিসি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, শুধু মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেননি,যারা জান কবজ করতে আসবেন তাঁদের আপ্যায়নের জন্যেও তিনি প্রস্তুত ছিলেন।
তিনি মালাইকাদের জন্য সুগন্ধীর ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন প্রশান্ত মনে। আজ মালাকুল মাউত আমার দরজায় এসে দাড়ালে আমার প্রতিক্রিয়া কী হবে?
সা’দ ইবনু আবি ওয়াক্কাস রাদ্বীয়াল্লাহু আনহু, মৃত্যুর মূহুর্তের জন্য জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের চিহ্ন রেখে দিয়েছিলেন। তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন ঐ মানুষদের একজন হিসেবে যারা ইসলামের প্রথম যুদ্ধের দিন আল্লাহর রাসূল ﷺ এর পাশে ছিলেন। মৃত্যুর দিনের জন্য তিনি ঐ পোশাক রেখে দিয়েছিলেন যা পরে তিনি আল্লাহ্র দ্বীনের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। এই পোশাকে তিনি কবরের ফেরেশতাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছিলেন। এই পোশাকে তিনি পুনরুত্থিত হতে চেয়েছিলেন বিচারের দিনে।
আমরা মৃত্যুর চিন্তা দূরে সরিয়ে রাখি। আর তাঁরা মৃত্যুর মূহুর্তের জন্য প্রস্তুতি নিতেন দীর্ঘদিন ধরে। আমরা এমন ভাবে দিন কাটাই যেন আমাদের কোনদিন মৃত্যু হবে না। আর তাঁরা এমন ভাবে দিন কাটাতেন যেন আজকেই মৃত্যু আসবে। তাঁরা দুনিয়াতে ছিলেন মুসাফিরের মতো। ব্যাগ গোছানো। টিকেট রেডি। ট্রেন আসলেই উঠে পড়বেন। পাড়ি দেবেন চিরন্তন গন্তব্যের দিকে। আমরা তো স্টেশনকেই আমাদের স্থায়ী ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছি।
আবু বাকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন, মৃত্যু হল এমন এক মূহুর্ত যখন,
প্রত্যেক অবিশ্বাসী বিশ্বাস করবে
প্রত্যেক মিথ্যাবাদী সত্য বলবে
এবং প্রত্যেক পাপাচারী পাপ করা বন্ধ করবে
এই অবধারিত মূহুর্তের জন্য কি আপনি প্রস্তুত?
যদি কালকের সূর্য ওঠার আগে আপনার মৃত্যু হয় তাহলে কোন অবস্থায় আপনি কবরে যাবেন?
কোন অবস্থায় পুনরুত্থিত হবেন?
সূত্র – হাফিয ইবনু যাবর আর-রাবী’, ওসায়াতুল ‘উলামা ‘ইনদা হুদ্বুরাল মাউত