জীবনে দু’বার আমি সরাসরি সম্প্রচার দেখেছি গণহত্যার। প্রথমবার ২০০৮-০৯ এ গাযায় চালানো যায়নিস্ট ইস্রায়েলের কাস্ট লিড অপারেশনের সময়। পরেরবার ২০১৩ এর অগাস্টে। রাবা’ ম্যাসাকার। বিস্ফোরিত অবিশ্বাসভরা চোখে, প্রায় সম্মোহিত হয়ে দেখেছি সারা দুনিয়ার চোখের সামনে নির্বিচারে মুসলিম হত্যা। দেখেছি সব কিছু দেখেও, সব কিছু শুনেও, সব কিছু বুঝেও টু শব্দটিও করেনি কেউ। দু’বারই সত্যটা মাথায় গেঁথে নিয়েছি - কোন জবাবদিহিতা, কোন চিন্তা ছাড়া নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে মুসলিমদের হত্যা করা যায়। ইসলাম আর মুসলিমদের জন্য কোন আইন, অধিকার, নিয়ম নেই। একটা আঙ্গুলও নড়বে না, অর্ধেকটা মানুষেরও এ নিয়ে মাথা ব্যাথা হবে না। বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার এটাই বাস্তবতা।
এ দুটো ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে দেয় যায়নিস্ট-ক্রুসেইডার বিশ্বব্যবস্থার বানানো সিস্টেমের ভেতরে ঢুকে সিস্টেমকে বদলানোর চিন্তা অবাস্তব স্বপ্নবিলাস কেবল। কাফিরদের বানানো নিয়ম মেনে, ওদের বাঁধা ছকে, ওদের মাঠে খেলে জেতার সব চেষ্টা শেষ পর্যন্ত এক্সারসাইয ইন ফিউটিলিটি। ওরা চায় আমরা নিয়ম মেনে চলি, সিস্টেমকে মেনে নেই, সিস্টেমের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য নিজেদের বিশ্বাস আর আদর্শের সাথে আপস করি। কিন্তু সব কিছু মেনে নেয়ার পরও দিন শেষে পাতানো খেলায় জেতা সম্ভব না।
আমার মনে আছে ০৮-০৯ এ গাযায় যায়নিস্টদের চালানো ধ্বংসযজ্ঞের সময় হামাসের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, হামাস গাযার জনগণের ভোটে নির্বাচিত বৈধ সরকার। ইস্রায়েলের কোন অধিকার নেই হামাসকে অবৈধ বলার। ১৩ তে মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন স্পোক্সপারসনকে বলতে দেখেছিলাম (ভদ্রলোকের নাম সম্ভবত জিহাদ আল হাদ্দাদ), গণতন্ত্রই আমাদের জিহাদ। অনেক তিক্ত পথ পাড়ি দিয়ে এ দলগুলোর মুখ থেকে একথাগুলো বের হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না তবু। আলজেরিয়ায় ইসলামিক স্যালভেইশান ফ্রন্ট নির্বাচনে জিতেছিল তাঁদের ক্ষমতায় জেতে দেয়া হয়নি। গণতন্ত্রের পথে হেটেও হামাস বৈধতা পায়নি। মুসলিম ব্রাদারহুড দৃষ্টান্ত স্মৃতিতে এখনো তাজা। যাই করুন না কেন, যতো ছাড় দিন না কেন, শেষ পর্যন্ত ওরা আমাদের জিততে দেবে না।
ড. মুহাম্মাদ মুরসি এবং ইখওয়ানুল মুসলিমীন সাম্রাজ্যের নিয়ম মেনে খেলতে নেমেছিলেন। সিস্টেমের ভেতরে ঢুকে বদলাতে চেয়েছিলেন সিস্টেমকে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে বৈধতা পাবার আশায় তারা গণতন্ত্রের পথ ধরেছিলেন। পাছে লোকে জঙ্গি বলে, এ আশঙ্কায় এড়িয়ে গিয়েছিলেন সম্মান, মর্যাদা আর শক্তির পথ। এবং অল্প কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল তারা বুঝি জিতেও গেছেন। হয়তো নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিজয় চলে আসছে হাতে নাগালে। কিন্তু না! সাম্রাজ্য কখনো ইসলাম ও মুসলিমদের জিততে দেবে না। প্রয়োজনে খেলার নিয়ম বদলে যাবে, প্রয়োজনে খেলা বন্ধ হবে, কিন্তু মুসলিমদের ক্ষমতায় জেতে দেয়া যাবে না।
তাই সব নিয়ম মেনে চলার বিনিময়ে ড. মুরসি এবং ইখওয়ান পেয়েছে বুলেট ও বন্দ্বিত্ব। বিশ্বব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে নিজ আদর্শের সাথে আপসের বিনিময়ে পেয়েছে অপমান ও লাঞ্ছনা। গৌরবহীন, অর্জনহীন, আপস ও পরাজয়। এটাই এ সিস্টেমের বাস্তবতা। গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলাম কায়েমের মানহাজের চূড়ান্ত ফলাফল। বৈধতা আর বিজয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত এ সিস্টেম মুসলিমদের শুষে ছিবড়ে বানিয়ে ছুড়ে ফেলে। এ পথে বিজয় নেই, আছে শুধু দুই জীবনের লাঞ্ছনা।
আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল আমাদের বোঝার ও মানার তাউফিক দান করুন। মুসলিম বন্দীদের কল্যাণময় মুক্তি ত্বরান্বিত করে দিন। মযলুম মুসলিমদের উত্তম প্রতিদান দান করুন। তাওয়াগ্বিতকে লাঞ্ছিত করুন দুনিয়াতে এবং আখিরাতে এবং এর মাধ্যমে আমাদের চোখগুলোকে শীতল করুন। আর রাহমানুর রাহীম মুসলিমদের ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিন। গাফুরুর রাহীম মুসলিমদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিন এবং তাঁদের আখিরাতের হিসেবনিকেশ সহজ করে দিন। আল্লাহ আমাদের তাউফিক দিন সম্মান, মর্যাদা ও শক্তির পথে চলার, এ পথের কথা বলার, এ পথে চলার নিয়্যাত করার।