উয়াইনার গভর্নরের আশ্বাস পেয়ে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল ওয়াহ্‌হাব নব উদ্যমে দাওয়াতী মিশন শুরু করলেন, হালাক্বা দিয়ে। তাওহীদ আর আকীদার শিক্ষা দিয়েই তিনি উম্মাহকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে তার কাছে এসেছিলো মানুষগুলোকে তিনি তাওহীদ আর আকীদার বুনিয়াদী শিক্ষা দিতেন। আলহামদুলিল্লাহ এভাবে তিনি মোটামুটি শক্ত একটা অবস্থান তৈরী করলেন। এক জায়গায় কবরের পূজা করা হচ্ছিল, তিনি শিষ্যদের বললেন আমাদের এটি ধ্বংস করা দরকার। সম্ভবত সেটি ছিল উমার বিন খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর ভাই যায়দ বিন খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর কবর। রিয়াদের সীমান্তের কাছাকাছি।

ভন্ড নবী মুসায়লামাতুল কাযযাব এর বিরুদ্ধে ইয়ামামার যুদ্ধে যাইদ ইবনুল খাত্তাব শহীদ হয়েছিলেন, এবং তাঁকে সেখানেই দাফন করা হয়েছিল। মুসায়লামা হচ্ছে সেই ভন্ড প্রতারক, যে রাসুল (ﷺ) এর জীবদ্দশাতেই নবুওয়ত দাবী করেছিল, এবং রাসুল (ﷺ) এর ইন্তেকালের পর তার ফিতনা বেড়ে যায়। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর খিলাফতের সময় খালিদ ইবনু ওয়ালিদ রাদ্বীয়াল্লাহু আনহু তাঁকে পরাজিত করেন এবং যুদ্ধে সে নিহত হয়। পরবর্তী সময় সেখানকার অধিবাসীরা হযরত যায়েদ বিন খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর সম্মানার্থে সেখানে তাঁর কবরের ওপর একটি কুব্বা বানায়।
কেন? সম্ভবত তাঁর সম্মানে।

কী সৌভাগ্য আমাদের! একজন সাহাবী আমাদের প্রতিবেশী।

কবর উঁচু করা, কবরের ওপর কিছু তৈরি করা একটি ঘৃনিত হারাম কাজ [১]

কেননা আমরা জানি এর অবশ্যম্ভাবী ফলাফল কী। কবরকে উঁচু করা যাবে না। কিন্তু তারা সেই কবরের ওপর গম্বুজ বানালো। পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র জায়গা মক্কাতেও উম্মুল মুমিনীন খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর কবরের ওপরও কুব্বা নির্মাণ করা এবং এর বিভিন্নভাবে আল্লাহর পরিবর্তে এখানে ইবাদত শুরু হয়। এরকম দৃষ্টান্ত মদীনাতেও পাওয়া যাবে। কাজেই মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাব যাইদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর কবরের কাছে গেলেন এবং বললেন আমাদের এটা (কবরের ওপর বানানো গম্বুজ) ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু গভর্নর বললেন আশেপাশের এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে। এখন এটা করা যাবে না।

আরব উপদ্বীপের প্রত্যেকটা অঞ্চলে তখন গোত্রীয় শাসন চালু ছিল। এবং ধারনা করা হচ্ছিল স্থানীয় গোত্রগুলো গম্বুজ ধ্বংসে বাঁধা দেবে। কারণ তারা মনে করতো এটি একটি পবিত্র নিদর্শন। আজ যদি আপনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কবরের উপর নির্মিত গম্বুজটি ভাঙতে যান, ঠিক একই অবস্থা হবে। তারা বলবে, ‘তুমি কি নবীকে ঘৃনা কর?’

এইভাবে তারা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাবকেও অভিযুক্ত করেছিল।
আল্লাহর কসম! এই গম্বুজটিকে ধ্বংস করা উচিৎ এবং মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া উচিৎ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবরের উপর কুব্বা রাখা হারাম। [২]

আমি অবাক হয়ে যাই, কিভাবে সেখানকার মানুষ এটা নিয়ে চুপ করে আছে? কর্তৃপক্ষ যুক্তি দেখায় যে এটা কবরের নিরাপত্তার জন্য। তাদের একথার জবাবে বলা যায় লক্ষ লক্ষ প্রযুক্তি বিদ্যমান যেগুলোর দ্বারা কবর উঁচু না করেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। গম্বুজই কেন লাগবে?

মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাব এবং তাঁর সাথীদেরকে উদ্দেশ্য করে অজ্ঞ লোকগুলো বলেছিল, তোমরা কি সাহাবী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) দের ঘৃণা কর? আমাদেরকে ইবাদত করা থেকে বিরত রাখতে চাও? তুমি কি নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অপছন্দ করো?

যখন আমি এই কথাগুলো বলি তখন অনেকেই বলে তুমি কি রাসুল (ﷺ) কে অপছন্দ কর? আল্লাহর কসম! আল্লাহর কসম, আমরা তোমাদের চেয়ে রাসুল (ﷺ) কে বেশি ভালোবাসি, তাঁর জন্য আমাদের পিতামাতা কুরবান হোক, রাসূলুল্লাহর সম্মানের সামনে আমাদের জানমাল, সন্তানসন্ততি সস্তা। আমরা আমাদের প্রিয় মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে তোমাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসি আর সেজন্যই আমরা সব গম্বুজ এবং উঁচু কবর সমান করে দিতে চাই। কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই নির্দেশ দিয়ে গেছেন। খোদ রাসুলুল্লাহ (ﷺ) একবার আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কে অভিযানে পাঠানোর আগে নির্দেশনা দিয়ে বলেছিলেন, আলী আমি তোমাকে এক গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে পাঠাচ্ছি।

কী ছিল সেই অভিযান?

আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, আমরা কিছু সাহাবীদের কবর দিয়েছিলাম, এবং রাসূলুল্লাহ আমাকে ফেরত পাঠালেন। বললেন মদীনায় ফিরে যাও। কোন মূর্তি ছাড়বেনা যতক্ষন না তুমি তার মুখ ভেঙ্গে দাও; কোন কুব্বা বা কবরের ওপর কোন কিছু রাখবে না, তা মাটির সাথে এক না করা পর্যন্ত। [৩]

যাহোক মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্‌হাব কোন নব আবিস্কৃত দাওয়াহ পেশ করেননি। আমরা যখন তার বই নিয়ে আলোচনা করব, দেখা যাবে সেখানে নতুন কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষে দ্বীন সংস্কারকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম নতুন বিষয়ের প্রচলন করেছিলেন। তাঁর বই নিয়ে আলোচনার সময় আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করব। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্‌হাব হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর সেই হাদীসের বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে চাইলেন। তিনি বললেন আমাদের এটা ধ্বংস করতে হবে। তখন গভর্নর বললেন, ঠিক আছে আমরা আপনার সাথে আছি। মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাব এবং তাঁর ছাত্ররা কবরের উপর নির্মিত গম্বুজকে যখন মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে গেলেন, যা আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই ঘটল। এলাকাবাসী যখন দেখল মাজারটি ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে তারা বাঁধা দিল। প্রায় ৬০০ মানুষ নিয়ে গভর্নর উপস্থিত হল এবং এলাকাবাসীকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন, এবং গম্বুজ ধ্বংস করা হোল।

তারপর একের পর এক সফলতা আসতে লাগল। তার দাওয়াহ ছড়িয়ে পড়লো বিভিন্ন দিকে। দলে দলে মানুষ এই কাফেলায় শামিল হতে লাগল, কেননা এটা ছিল ফিতরাহ বা মানুষের সহজাত প্রবনতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন। উন্মাদ ছাড়া আর কে বা আল্লাহকে রেখে কবরের উপাসনা করবে? কবরের কাছে চাইবে? যেখানে কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে! এই লোকগুলোর সহজাত বিবেচনাবোধকে কলুষিত করেছিল দালাল আর ভন্ড আলেমরা। অনেক ক্ষেত্রে পিতা মাতার কাছে থেকে ভুল শিক্ষা পেয়ে সন্তানরাও সে পথে পা বাড়িয়েছিল। তাই মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্‌হাব এই বিদআতের মূলোৎপাটন করতে চেয়েছিলেন এবং কবরগুলোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর তিনি তার জন্মভূমি উয়াইনাতে ফিরে গেলেন এবং তার দাওয়াতী মিশন অব্যাহত রাখলেন।


১) “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরে চুন কাম করা, তার উপর বসা এবং তার উপর নির্মান করতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম)

২) The green dome in Madeenah: its history and the ruling on its construction and on leaving it as it is,

https://tinyurl.com/y568car5

https://tinyurl.com/yypfk3ds

৩) হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত আবুল হাইয়্যাজ আসাদী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর উদ্দেশ্যে বলেন, আমি কি আপনাকে এমন কাজের প্রতি উৎসাহিত করব না, যা করার জন্য আমাকে রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উৎসাহিত করেছেন? আর তা হল প্রতিকৃতি না মিশিয়ে তা হাত ছাড়া করবে না, এবং উঁচু কবরকে সমতল না করে ছাড়বে না। [সহীহ মুসলিম]