ক্যাথলিক এবং প্রটেস্টান্টদের অবস্থানের মধ্যে কোনটা সঠিক? প্রটেস্টান্ট রিফর্মেইশানের ব্যাপারে মুসলিমের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিৎ? আপাতভাবে মনে হতে পারে, স্রষ্টা ও বান্দার মাঝে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চার্চের অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করার সাথে ইসলামের অবস্থানের মিল আছে। আবার এমনো মনে হতে পারে যে ক্যাথলিক চার্চের ট্র্যাডিশানের সাথে ইসলামী ইলমের সিলসিলার সাদৃশ্য আছে। তবে শুধু বাহ্যিক মিলের ওপর ভিত্তি করে তাড়াহুড়ো করে উপসংহার টানা এখানে ঠিক হবে না। বরং মুসলিম হিসেবে দুই অবস্থানের ত্রুটিই আমাদের চোখে ধরা পড়ে।

ক্যাথলিক চার্চের শিক্ষা এবং আচরণে এমন অনেক, অনেক বিষয় ছিল যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। ক্যাথলিক চার্চে ইন্ডালজেন্সের (indulgence) এর ধারণা ছিল। আর্থিক অনুদান কিংবা বিশেষ কোন কাজের (যেমন ক্রুসেইডে যাওয়া) বিনিময়ে চার্চের পক্ষ থেকে পাপ মুক্তি এবং ক্ষমার সার্টিফিকেট দেয়া হতো। মানুষ যা ইচ্ছে করুক না কেন, এই সার্টিফিকেট কিনলে মাফ পেয়ে যাবে। চার্চের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য পোপরা ব্যাপকভাবে এই সার্টিফিকেটের মার্কেটিং করলো। চার্চ খেয়ালখুশি মতো হালাল-হারামের ফাতওয়া দিতো। এসব ফাতওয়ার ব্যাপারে বাইবেল থেকে দলীল চাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। প্রশ্ন করলে বলা হতো এগুলো একান্ত গোপনীয় রহস্য, এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা যাবে না। এছাড়া সমাজের অভিজাত শ্রেনী আর সাধারণ মানুষের মধ্যে বিচারে পার্থক্য করা হতো। ইহুদীদের মতো খ্রিস্টানরাও তাদের অভিজাত শ্রেনীর জন্য তাদের শরীয়াহর হুকুমকে বদলে ফেলতো।

লুথার এ ধরণের অবস্থানের বিরোধিতা করেছিল। মুসলিম হিসেবে এ বিরোধিতার যৌক্তিকতা আমাদের সামনে স্পষ্ট। পুরোহিততন্ত্র অবধারিতভাবে এধরণের পরিস্থিতির জন্ম দেয়। এটা খ্রিস্টান ছাড়াও বনী ইস্রাইলসহ অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। পুরোহিততন্ত্রের এ ধারণা  ইসলাম সমর্থন করে না। কুরআন-সুন্নাহ থেকে আমরা জানি এ ব্যাপারটা শিরকের পর্যায়ে পৌছতে পারে। কুরআনে বলা হয়েছে,

‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগীদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামপুত্র মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদাত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছে। তিনি ছাড়া কোন (হক) ইলাহ নেই।'

[তরজমা, সূরা আত তাওবাহ, ৯: ৩১]

হাদীসে এসেছে,

‘আদি ইবনু হাতিম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন তখন তাঁর গলায় ছিল সোনার একটি ক্রুশ। ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি খ্রিষ্টান ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন সূরা তাওবাহর এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন। আদি (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তখন বললেন, তারা অর্থাৎ ইহুদী-খ্রিষ্টানরা তো ধর্মযাজক আর সন্ন্যাসীদের ইবাদাত করত না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘হ্যাঁ, যদিও তারা তাদের উপাসনা করত না, কিন্তু যখন এসব যাজক তাদের কোনো কিছুকে হালাল করে দিত, তারা সেটাকে হালাল মনে করত: আর যখন এরা কিছুকে তাদের জন্য হারাম করে দিত, ওরাও সেটাকে হারাম মনে করত (এটাই ইবাদাত)।'

[সুনানুত তিরমীযি]

কাজেই দ্বীনের ওপর ব্রাহ্মণ জাতীয় কোন শ্রেনীর এক্সক্লুসিভ কর্তৃত্বের কথা ইসলাম স্বীকার করে না। একইভাবে আমরা বিশ্বাস করি মুমিন সরাসরি আল্লাহর ইবাদত করবে। এখানে চার্চ, পোপ, পাদ্রী, পীর কিংবা কবরকে মধ্যস্থতাকারী-ব্রোকার হিসেবে লাগবে না।

তাওবাহ, ইবাদত, দুআ–বান্দা সরাসরি আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর প্রতি করবে। কোন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে হবে না। বান্দার সাথে মালিকের সম্পর্কে কোন মিডলম্যান নেই। ইসলামে পুরোহিতন্ত্র নেই। ব্রাহ্মণ্যবাদ নেই। সব মুমিন সমান, তাদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্যকারী হল তাকওয়া। এই অর্থে আপাতভাবে Priesthood of all believers –এর ধারণা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হতে পারে।

কিন্তু Priesthood of all believers -এর আরেকটা ব্যাখ্যা হয়। সেটা হল টেক্সটের ব্যাখ্যা, শরীয়াহর হুকুম-আহকাম নির্ণয়ের কাজ সবাই করতে পারবে। প্রত্যেকে নিজের মতো করে দ্বীনকে বুঝবে, ব্যাখ্যা করবে। ফাতওয়া দেবে।

এই চরম রিলেটিভিস্টিক অবস্থানের ফলাফল হল দ্বীনকে অকার্যকর করা। প্রত্যেক ব্যাখ্যাকারীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী যদি কোন জিনিসের অর্থ বদলাতে থাকে, তাহলে কার্যত সেটার কোন অর্থ থাকে না। এই অবস্থান ইসলামের সাথে মিলে না। সব ব্যাখ্যাকারীর ব্যাখ্যাকে আমরা বৈধ মনে করি না। হাদীসে এসেছে এই উম্মাহ ৭০ এর বেশি ফিরকাতে বিভক্ত হবে, যার মধ্যে শুধু একটি অংশ নাজাত পাবে। সরল পথ একটিই।

ইসলামের ব্যাপারে অনেক ধরণের ‘ব্যাখ্যা’ থাকলেই সব ব্যাখ্যা সঠিক হয়ে যায় না।

হাদীসে দ্বীনের ব্যাপারে অজ্ঞতাবশত কথা বলার ব্যাপারেও সতর্ক করা হয়েছে। যে কেউ চাইলেই কুরআন খুলে তাফসীর করতে পারবে না। দু-একটা মূলনীতি শিখে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা ইলমী সিলসিলাকে নাকচ করতে পারবে না। হঠাৎ কুরআন কিংবা হাদীসের তরজমা পড়ে ফাতওয়া দেয়া শুরু করতে পারবে না। এর জন্য আহলুল ইলমের কাছে যেতে হবে। কাজেই ক্যাথলিকদের পুরোহিততন্ত্রের মতো প্রটেস্টান্টদের ‘আমার মনে হয়...’ জাতীয় মানহাজও ইসলামে গ্রহণযোগ্য না।

আপাতভাবে এখানে একটা সাংঘর্ষিকতা তৈরি হতে পারে। দ্বীনের ব্যাখ্যা করার জ্ঞানতাত্ত্বিক ক্ষমতা কোন নির্দিষ্ট শ্রেনীর হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লে, কারো একচেটিয়া কর্তৃত্ব থাকলে সেটা পুরোহিততন্ত্রের দিকে যাবে। অবধারিতভাবে সেই পুরোহিততন্ত্র এক সময় সত্য থেকে বিচ্যুত হবে এবং এই ক্ষমতার অপব্যবহার করবে। যা ক্যাথলিক চার্চের ক্ষেত্রে হয়েছে।

অন্যদিকে দ্বীনকে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত হলে সেটা জন্ম দেবে চরম বিশৃংখলার। চরম এই আপেক্ষিকতা দ্বীনকে অর্থহীন বানিয়ে ফেলবে। প্রটেস্টান্ট এবং মডার্নিটির মডেল। কাজেই একদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদ তৈরি হবার আশঙ্কা, অন্যদিকে ‘সবার জন্য তাফসীর, সবার জন্য ফাতওয়া’-এর মহামারী আশঙ্কা।

সমাধান কী?

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ এ উভয়সংকটের সমাধান করেছে দুটো জিনিসের মাধ্যমে। হাদীসের ইসনাদ বা বর্ণনাসূত্র (Chains of Transmission) এবং খায়রুল কুরুন বা প্রথম তিন প্রজন্মের শিক্ষা। হাদীস এবং সালাফুস সালিহীনের দৃষ্টিভঙ্গি উম্মাহর জন্য একই সাথে শেকড় এবং মাপকাঠির মতো। রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক কারণে কোন বিপথগামী আলিম কিংবা আলিমগোষ্ঠী শরীয়াহর অপব্যাখ্যা করতে পারে। কোন আলিম কিংবা আবেদের আন্তরিক ভুল সময়ের পরিক্রমায় বহুলভাবে প্রচলিত হয়ে যেতে পারে। মরমী ইসলাম, লোকজ ইসলাম কিংবা সংস্কৃতির নামে দ্বীনের শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক কোন আচার বা বিশ্বাস ট্র্যাডিশানে রূপান্তরিত হয়ে টিকে থাকতে পারে শত শত বছর।

কিন্তু ইসনাদ এবং সালাফুস সালিহিনের অবস্থানের মানদণ্ড থাকার অর্থ হল এমন যেকোন ব্যাখ্যা, বক্তব্য কিংবা অবস্থানকে নবী (ﷺ) এর শিক্ষা এবং উম্মাহর সর্বোত্তম প্রজন্মদের অবস্থানের আলোকে যাচাই করা সম্ভব। কোন কিছু কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক হলে, সালাফুস সালিহিন যেভাবে বুঝেছেন তার বিরুদ্ধে গেলে, সে কথা আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি। সেটা যার কথাই হোক না কেন এবং সেই কথার পরবর্তী যুগে যতো জন থাকুক না কেন। যেমনটা ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ বলেছিলেন, নবী (ﷺ) এর কথা ছাড়া অন্য যে কারো কথা গ্রহণ কিংবা বর্জন করা সম্ভব। একমাত্র নবী (ﷺ) এর কথাই বিনা প্রশ্নে অনুসরনীয়[1]

একইভাবে কেউ যখন কুরআনের আয়াতের মনমতো ব্যাখ্যা দেয়, দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে চায়, কিংবা নিজের খেয়ালখুশির জাস্টিফিকেশান তৈরি করতে চায় তখন তার জন্য মূল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এ দুটো জিনিস। এ দুই মাপকাঠির মাধ্যমে তার অবস্থানকে যাচাই এবং প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব।

অসংখ্যা জাল হাদীস থাকার পরও হাদীসের মান নির্ণয় করা সম্ভব। আজ যদি হঠাৎ করে কুরআনের আয়াত এবং হাদীসের অসীম সংখ্যক নতুন ব্যাখ্যা যদি তৈরি হয়, ম্যাস মিডিয়ার মাধ্যমে যদি সেগুলোর ব্যাপক প্রচার হয় তবু সেগুলোকে সরিয়ে সঠিক ব্যাখ্যা জানা সম্ভব। কারণ আমাদের কাছে ইসনাদসহ হাদীস এবং সালাফুস সালিহিনের ব্যাখ্যা সংরক্ষিত আছে।

দ্বীনের মধ্যে নতুন কোন বিষয় উদ্ভাবন, দ্বীনকে বিকৃত করা এবং কেন্দ্র থেকে বিচ্যুতির বিরুদ্ধে এ দুটো বিষয় হল উম্মাহর জন্য সেইফটি লকের মতো। এ দুটো জিনিসের মাধ্যমে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ ক্যাথলিসিযমের পুরোহিততন্ত্র এবং প্রটেস্টান্টিসমের চরম আপেক্ষিকতা এবং এপিসটেমিক এনার্কিকে এড়িয়ে যায়। যারা এ দুটো বিষয়ের ক্ষেত্রে আপস করে তারা অবধারিতভাবে কোন না কোন মাত্রায় এ দুই প্রান্তিক প্রবণতার কোন একটার দিকে ঝুঁকে পড়ে।  

প্রটেস্টান্ট রিফর্মেইশানের ইতিবাচক দিক ছিল ক্যাথলিক চার্চের বিভিন্ন দুর্নীতি এবং বিচ্যুতির বিরোধিতা করা। কিন্তু চার্চের ভূমিকাকে প্রশ্ন করলেও ঈসা আলাইহিস সালাম-এর শিক্ষার বিকৃত যে রূপ ক্যাথলিকরা গ্রহণ করেছিল মোটাদাগে প্রটেস্টান্টরা তার অনেক কিছুই মেনে নেয়। দিন শেষে ঈসা আলাইহিস সালামকে ‘ঈশ্বরের পুত্র’ মনে করা, এবং  ট্রিনিটিসহ বিভিন্ন কুফর এবং শিরকে তারা ঈমান রাখে।

শাইখ আব্দুল আযীয আত-তারিফীর মতে প্রটেস্টান্টদের মূল সমস্যা হল তারা অর্ধেক সত্যকে নিয়েছে। দীর্ঘদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর প্রটেস্টান্টরা বুঝতে পেরেছিল, ক্যাথলিক চার্চ যা শেখাচ্ছে, তারা যা আঁকড়ে আছে সেটা বিশুদ্ধ না। এ শিক্ষা তাদের দ্বীন ও দুনিয়াকে পরিশুদ্ধ করতে পারে না। এই বাস্তবতাটুকু তারা মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু বাকী অর্ধেকটুকু তারা মেনে নেয়নি। ইসলামের ব্যাপারে জানা সত্ত্বেও বিশুদ্ধ তাওহীদ এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নুবুয়াত তারা স্বীকার করেনি। অহংকার তাদেরকে সত্যের এই অংশকে মেনে নিতে দেয়নি। তাই অবাধ্যতা ও দাম্ভিকতাবশত আল্লাহর শরীয়াহকে বাদ দিয়ে তারা গ্রহণ করলো মনের শরীয়াহ ।

একই কথা মডার্নিটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।


[1] নবিজীর (ﷺ) কথা যে আমরা সুনিশ্চিতভাবে জানতে পারছি তার সেটা নিশ্চয়তা দিচ্ছে ইসনাদ এবং হাদীসশাস্ত্র। অন্যদিকে কুরআন এবং হাদীসের ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা সঠিক সেটা আমরা জানছি সালাফুস সালিহিনের কাছে থেকে।এভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ পুরোহিততন্ত্রের পথ বন্ধ করে।