রাত প্রায় ১১টা। ব্যবসায়িক কিছু প্রয়োজনে চট্টগ্রাম আসা, দিনভর ছুটোছুটির পর এখন ফেরার পালা। সিনএনজি যাচ্ছে এ কে খানের দিকে। খুচরো আলাপে তেমন পারদর্শী না হলেও মনে ইঞ্জিনের বিকট শব্দ থেকে মনোযোগ সরাতে কথা শুরু করলাম। পাশে বসা ভাইয়ের জুতার ফ্যাক্টরি। চট্টগ্রামের বেশ কিছু দোকানে মাল দেন। বাকিতেই দেন। রিটেইলার প্রত্যেকবার বলে ‘অমুক তারিখ আসেন, সব হিসাব কিলিয়ার করে দিবো।‘ ভাই অমুক তারিখ যান, তারপর তমুক তারিখেও যান। একই কাহিনী। এইবারও গেছেন। এবার কোন টাকা পাওয়া গেল কি না জিজ্ঞেস করায় বললেন – ভাই আর বইলেন না, এরা যে কিরকম বাটপাড় বিশ্বাস করবেন না। ক্যাশভর্তি টাকা। আমি যখন গেলাম তখন ক্যাশে হাত দিয়ে বলে, আল্লাহর কসম ভাই ক্যাশে টাকা নাই। ইমানে বললাম। থাকলে অবশ্যই দিতাম। বিশ্বাস না হলে ক্যাশ খুলে দেখাই…

বললাম - তো ক্যাশ খুলে দেখতেন। সে ব্লাফ দিচ্ছে, আপনি হাতেনাতে ধরতেন। আপনি টাকা পান আর না পান, সে যে বাটপাড়ি করছে, মিথ্যা বলছে, হারাম খাচ্ছে এটা সামনাসামনি প্রমান হত।

আমাদের কথার মধ্যে হঠাৎ সিএনজি ড্রাইভার কথা বলা শুরু করলোঃ
-না ভাই এরকম কসম করা জায়েজ আছে।
জায়েজ আছে মানে? আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করা জায়েজ আছে?
-না মানে এমনিতে তো মিথ্যা কসম করা যাবে না। কিন্তু শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রে জায়েজ আছে। ঐ যে বললো না আল্লাহর কসম ক্যাশে টাকা নাই, ক্যাশে টাকা থাকলেও এমন বলা জায়েজ আছে।
ও আচ্ছা। এমন কসম করা জায়েজ আছে এই তথ্য কোথায় পেয়েছেন?
-হুজুরে বলছেন।
কোন হুজুর?
-অনেক হুজুরেই বলেছেন। ওয়াজে শুনেছি। দোকানদাররাও বলে, তারাও বিভিন্ন হুজুরের কাছে শুনেছে।

সিএনজি ড্রাইভারের সাথে এরপর আরও কিছু কথা হলো। নিশ্চিত হলাম সে আসলেই আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে এরকম ক্ষেত্রে মিথ্যা কসম করা জায়েজ। আর তার দাবি হল, এটাই তার চেনা অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস। হুজুররাই এটা বলেছেন। চট্টগ্রামে যেহেতু বেরেলভিদের বিশাল হাব তাই কোন না কোন হুজুর এরকম বলেছে এই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর যখন কোন ‘আলিম’, ‘দা’ঈ’ বা ‘হুজুর’ এরকম কথা বলবে তখন অধিকাংশ মানুষ তাদের পেছনে জড়ো হবে – এটাই স্বাভাবিক। ধর্ষক যদিও জানে তার কাজটা খারাপ কিন্তু তবুও সে মনে মনে একটা জাস্টিফিকেশান চায়। অপরাধী তার অপরাধবোধকে ঝেড়ে ফেলতে চায়। তার অপরাধের ব্যাপারে সে ভালো বোধ করতে চায়। আর যখন ‘ইলমের দাবিদারদের কাছ থেকে এই জাস্টিফিকেশানগুলো পাওয়া যায় তখন তো সোনায় সোহাগা। দুনিয়া পাবার জন্য, বাদশা কিংবা জনগনকে খুশি করার জন্য আলিমদের অধঃপতনের উদাহরন ইতিহাসে কম নেই। শুধু বানী ইস্রাইলের মাঝেই এরকম অজস্র উদাহরন আছে। হতাশাজনক ব্যাপারটা হল আজকে আমাদের আওয়াম ও উলামার মধ্যে বানী ইস্রাইলের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যগুলো অনুসরণের প্রবণতা খুব বেশি।

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আহর ইমামদের মতে আলিম তিন প্রকার।
১) আলিমে সুলতান বা শাসকের অনুগত আলিম।
২) আলিমে জমহুর বা জনগণের খেয়ালখুশির অনুসরণ করা আলিম।
৩) আলিমে রাব্বানি যারা সত্যিকার অর্থে নবীদের ওয়ারিশ আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম।

আর সাধারন মানুষের ইজতিহাদ হল রাব্বানী আলিমদের খুজে বের করা, যেই আলিম আমার সব কাজের লাইসেন্স দেয় তাকে খুজে বের করা না। এই ব্যাপারে শায়খ আবু আদনানের নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন - http://ow.ly/rGsj30dyTLc

যে কথাটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ তা হল সাধারন মানুষের ইজতিহাদ নিয়ে বলা কথাটা। সাধারন মানুষের দায়িত্ব ‘ইলমের জন্য আলিমের কাছে যাওয়া। কিন্তু যেকোন আলিম বা দা’ই তাকে যেকোন কিছু বলে দেবে আর সে তা গ্রহন করে সেটাকে সত্য হিসেবে মানতে থাকবে ব্যাপারটা এমন না। যদি তাই হতো তাহলে আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করা ব্যক্তি তার জায়গাতে ঠিকই আছে, আর মিথ্যা কসম করাকে জায়েজ বলা সিনএনজি ড্রাইভারও তার জায়গায় ঠিকই আছে, আর নুমান আলি খানের রেফারেন্স দিয়ে পর্দা ছাড়া মিক্সড গ্যাদারিং এর আয়োজন করা কিংবা ফেইসবুকে, ওয়াটস্যাপে ফ্লার্ট করা ব্রাদারস অ্যান্ড সিস্টার্সরাও তাদের জায়গাতে ঠিক আছে। অজুহাত তো আছে। আলিম বলেছেন। হুজুর বলেছেন। উস্তায বলেছেন। মিলিয়ন মিলিয়ন ফলোয়ার সুর মিলিয়েছে। না। নিশ্চয় কোন বোঝাবহনকারী অপরের বোঝা বহন করবে না।

বিয়ের আগে নারীপুরুষের মেলামেশা স্পেসিফিকালি বললে কোর্টশিপের ক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান কী এ নিয়ে নুমান আলি খানের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। নুমান আলি খানের এধরনের বিতর্কিত ও ভিত্তিহীন বক্তব্য দেয়ার অভ্যাস নতুন না। তাই আলোচনা-সমালোচনাও নতুন না। আর এটা শুধু নুমান আলির ক্ষেত্রে হচ্ছে এমন না, উমার সুলাইমান ও জনাথন ব্রাউনের ইয়াক্বিন ইন্সটিউট, শুহাইব ওয়েব ও তার প্রতিষ্ঠান, আল-কাউসার ইন্সটিউট, হামযা ইউসুফ ও যায়তুনা, আল-মাগরিব এবং অবশ্যই ইয়াসির ক্বাদিসহ পশ্চিমাপ্রবাসী অনেক দা’ই এবং প্রতিষ্ঠান ইসলামের অবিচ্ছেদ্য কিছু বিষয়ে এমন ধরনের কথা বলছেন যা কেউ এর আগে শুনে নি বা কখনো সিরিয়াস স্কলারশিপের মধ্যে এই ধরনের বক্তব্যদানকারীদের ধরা হয় নি। দুঃখজনকভাবে আজকে হচ্ছে। মার্ক যাকারবার্গ ফেইসবুকের নিউযফিডের ইন্টারফেইস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিল – পৃথিবীর কোন এক কোণায় হাজার হাজার মানুষের না খেতে পেয়ে মারা যাবার খবরের চাইতে হয়তো একটা বিড়ালের মাটিতে গড়াগড়ি করার দৃশ্য তোমার কাছে বেশি ইন্টারেস্টিং। আমাদের নিউযফিডের কাজ হল তোমার পছন্দ অনুযায়ী তোমার পছন্দের খবরগুলো তোমার সামনে নিয়ে আসা।

যাকারবার্গ সফল। উম্মাহর দুরবস্থা, উম্মাহর অপমান, তাওহিদের সঠিক ব্যাখ্যা, মিল্লাতু ইব্রাহিম সম্পর্কে জানার চাইতে বিড়ালের গড়াগড়ি, পোকিমন নিয়ে হাসাহাসি আর কিশোরের মতো আচরণ করতে ব্যস্ত মধ্যবয়স্ক ভাড়ের অঙ্গভঙ্গি আমাদের কাছে আজকে বেশি ইন্টারেস্টিং হয়ে গেছে। এটা ঠিক কেন হয়েছে সেটা লম্বা আলোচনার বিষয়। যদি আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল সুযোগ দেন তাহলে এ বিষয়ে লেখার ইচ্ছে আছে। তবে একজন মুসলিম ভাই হিসেবে একটা প্রশ্ন সবাইকে করতে চাই।

ধরুন আপনি কোন দা’ঈ, শায়খ, আলিম বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দ্বীন ইসলাম বুঝেছেন। সেটা হতে পারে নুমান আলি খান, ইয়াসির ক্বাদি, মতিউর রহমান মাদানি, দেওবন্দ ইউনিভার্সিটি, মদীনা ইউনিভার্সিটি, আবুল ‘আলা মওদুদি, সাইদ কুতুব, আব্দুল্লাহ আযযাম কিংবা অন্য যেকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। আপনি উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে কৃতজ্ঞ কারন তাদের মাধ্যমে আল্লাহ আপনাকে সত্য চিনিয়েছেন। কিন্তু আপনি কি ইসলামের খাতিরে এই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুসরণ করেন এবং তাদের ভালোবাসেন? নাকি আপনি এই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ভালোবাসেন দেখে ইসলাম পালন করেন?

যদি প্রথমটা হয় তাহলে কোন আলিম, দা’ই, সেলিব্রিটি যে-ই হোক তার ভুলকে ভুল হিসেবে স্বীকার করে নিতে কোন সমস্যা হবার কথা না, যদি নুসুসের ভিত্তিতে স্পষ্টভাবে ভুল প্রমান হয়। আল্লাহ আযযা ওয়া জাল বলেছেন - আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে। [সূরা আহযাব, ৩৬]

আর যদি দ্বিতীয়টা হয় তাহলে আপনি আপনি কুফর ও শিরকের ভেতরে আছেন আল্লাহ আপনাকে হিদায়েত দিন। আমাদের আনুগত্য আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল ওয়া তাঁর রাসূলের ﷺ প্রতি। বাকি সবকিছু সেকেন্ডারি। আমরা আলিমদের সম্মান করি ভালোবাসি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তা করতে বলেছেন দেখে। আমরা মুসলিম ভাইকে ভালোবাসি ইসলামের কারনে। আমরা মদীনা ইউনিভার্সিটি, দেওবন্দকে ভালোবাসি এই জায়গাগুলো ‘ইলম শেখানো হয় তাই। আমরা ইসলামের কারনে আলিমদের সম্মান করি, আমরা ইসলামের কারনে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভালোবাসি, আমরা ইসলামের মাপকাঠি দিয়ে তাদেরকে মাপি। উল্টোটা না।

তাই যখন কোন ব্যক্তি হাসতে হাসতে নিয়্যাতের ব্যাপারে বাতিল ব্যাখ্যা প্রচার করে, সাহাবাদের ব্যাপারে রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন কথা বলার সময় শিষ্টাচার ভঙ্গ করে, কাফিরদের কাফির বলা যাবে না এমন দাবি করে, কাফির–মুশরিকদের প্রতি বারাত রাখা যাবে না এমন দাবি করে, ক্বুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাপারে ইচ্ছেমতো ভুল ব্যাখ্যা বা দাবি চালিয়ে দেয়, একজন পুন্যবান ব্যক্তির (অনেকের মতে একজন নবীর মেয়ে) মেয়ে এবং একজন নবীর স্ত্রী যার লজ্জাশীলতা ও উন্নতচরিত্রের সাক্ষ্য আসমান ও যমীনের মালিক দিয়েছেন, তার ব্যাপারে মিথ্যারোপ করে, তার নিয়্যাতের ব্যাপারে ধারনাবশত আপত্তিকর কথা বলে এবং তার উপযুক্ত সম্মান বজায় না রেখে কথা বলে – যখন একই ব্যক্তি এইসব কিছু করে, এবং করেই যায় এবং করেই যায় এবং আপনার কাছে এইসব কিছুর চাইতে কেন আপনার প্রিয় ‘উস্তাযের’ সমালোচনা করা হচ্ছে এই প্রশ্ন বেশি ওজনদার মনে হয়, তাহলে সম্ভবত আপনার নিজের অন্তরের ব্যাপারে আর উক্ত ব্যক্তির প্রতি আপনার ভালোবাসার ব্যাপারে ভীত হবার সময় এসেছে।

যাকে আল্লাহ হেদায়েত করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না, যাকে আল্লাহ গোমরাহ করেন তাকে কেউ হেদায়েত করতে পারে না।