ইসলামী শাসনের কথা আসলে অনেকে বলে,

‘কোন ইসলাম? ইসলামের তো অনেক ধারা আছে, অনেক মাযহাব আছে, অনেক গোষ্ঠী আছে। এরা নিজেরাই একে অপরের সাথে মারামারি করে। তাহলে কোন ইসলামের ভিত্তিতে শাসন হবে? এর মধ্যে সমন্বয় হবে কীভাবে? এখনই যখন নিজেরা একমত হতে পারছেন না, তাহলে শাসন করার সময় কী হবে?’

এটা লম্বাচওড়া তাত্ত্বিক জবাব দেয়া যায়। কিন্তু তার প্রয়োজন নেই। প্রশ্নের দিকটা একটু উল্টো করে চিন্তা করা যাক।

কোন সেক্যুলারিসম? বিএনপির সেক্যুলারিসম? নাকি আওয়ামী সেক্যুলারিসম? কমিউনিসমের ধর্মনিরপেক্ষতা নাকি, ন্যাশনাল সোশালিস্ট ধর্মনিরপেক্ষতা? ক্লাসিকাল লিবারেলিসম নাকি Woke আইডিওলজি?

সেক্যুলার দর্শনের মধ্যেই তো অনেক গোষ্ঠী, অনেক ধারা আছে। এরা গত দুইশো বছর ধরে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে কোটি কোটি মানুষ হত্যা করেছে। বাংলাদেশেও গত পঞ্চাশ বছরে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা, লুটপাট আর হত্যা হয়েছে এসব আদর্শের নামে। তাহলে এর মধ্যে সমন্বয় হয় কীভাবে?

কমিউনিস্টরা যেখানে ক্ষমতায় গেছে, সেখানে কী সব আদর্শের সাথে সমন্বয় করেছে? আওয়ামী লীগ-বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে, তখন কি বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ আর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সিন্থেসিস করে আসে?

কোথাও কোন আদর্শিক সমন্বয় আসেনি। যে ‘সমন্বয়’ এসেছে সেটা এসেছে ক্ষমতার জোরে। ক্ষমতাসীন সরকার একটা সীমা, একটা ‘অফিশিয়াল’ অবস্থান ঠিক করে দিয়েছে তারপর বাকিদের সেটা মানতে বাধ্য করেছে। সব শাসনব্যবস্থায় এটাই হয়। সহিষ্ণুতা এবং অনুমোদিত পার্থক্যের সীমা ঠিক করে দেয় শাসক, বাকিদের সেই সীমার মধ্যে থাকতে হয়।

বর্তমানে মুসলিমদের মতপার্থক্য এতো তীব্র হবার বড় একটা কারণ হল ক্ষমতা না থাকা। ক্ষমতায় থাকলে ইখতিলাফি মাসআলায় শাসক যেটা বলবে সেটাই বাকিদের মানতে হবে। তারপরও নিজেদের মধ্যে তর্ক থাকলে, সেটা অ্যাকাডেমিক সীমানার মধ্যে রাখতে হবে। বিভিন্ন মাযহাবগুলোর প্রচার ও প্রসারের বড় একটা অংশ শাসনক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে হয়েছে। আকিদাহর ক্ষেত্রেও একই কথা। শাসক যেটাকে প্রমোট করবে সেটাই বেশি প্রচারিত হবে। যেমন সালাহউদ্দীন আল আইয়ুবীর স্থাপিত আইয়ুবি সালতানাতে আশ’আরী আকিদাহর পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে। এগুলো রকেট সায়েন্স না। লিবারেল সেক্যুলারিসম এসে শাসন করার বৈপ্লবিক কোন পদ্ধতি আবিষ্কার করেনি।

‘কিন্তু কাদিয়ানিরা? কাদিয়ানিদের কী হবে? তাদের তো কাফের ঘোষনা করা হবে’ –হ্যা, কাফেরকে কাফেরই তো বলা হবে। যেকোন আদর্শের নরম্যাটিভ কাঠামো থাকে। সেই কাঠামো অনুযায়ী কে সঠিক, কে সহিহ, সেটা বিচার করা হয়। তা না হলে পৃথিবীতে কোন আদর্শ টিকে থাকতে পারবে না। প্রত্যেক ব্যাখ্যাকারী নিজের মনমতো ব্যাখ্যা করে যাবে।

আধুনিক রাষ্ট্র তো বাকস্বাধীনতার কথা বলে, কিন্তু সে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন বানায় না? কে নীতিগতভাবে, মৌলিকভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনের বিরোধিতা করে? যাদের আপত্তি আছে, তাদের আপত্তি আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা নিয়ে।

ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী কাদিয়ানিরা কাফের কি না – এই প্রশ্নও হতে পারে। মুসলিমরা এই আলোচনাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু এখানে মানবতা, সহিষ্ণুতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গান গাওয়ার দরকার নেই।

তাছাড়া সেক্যুলার ডিসকোর্সেও বিভিন্ন চিন্তাকে ঢালাওভাবে খারিজ করে দেয়া হয় – যেমন নাৎসিবাদ। যদিও নাৎসিদের অনেক ভালো ভালো চিন্তাভাবনা থেকে থাকতে পারে। তারা নিজেদের কাছে অত্যন্ত দক্ষ ছিল। তাদের অভাবনীয় টেকনোলজিকাল অগ্রগতি ছিল। কার্ল শ্মিটের মতো লোকরা লিবারেলিসমের যেসব ক্রিটিক এনেছে, তার ধারকাছে আসার মতো আলোচনা সেক্যুলার ডিসকোর্সে খুব কম হয়েছে। তারপরও লিবারেল ধর্মমতে তাদের তাকফির করতে বেগ পেতে হয় না।

অ্যামেরিকাতে কোটি কোটি মানুষ QAnon কনস্পিরেসি থিওরিতে বিশ্বাস করে। এদের মধ্যে বিভিন্ন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার থেকে শুরু করে ডানপন্থী অ্যাকাডেমিকও আছে। তাই বলে তো QAnon কেউ লেজিটিমাইয করতে বলে না। সেটাকে ডোমেস্টিক টেরোরিসম সাব্যস্ত করা হয়। তাহলে কাদিয়ানের টয়লেটওয়ালা কোন ছাড়!

প্রত্যেক ওয়ার্ল্ডভিউ গ্রহণযোগ্য আলোচনার সীমানা ঠিক করে দেয়। সেই সীমানা কতোটুক হবে সেটা সেই ওয়ার্ল্ডভিউ নিজে ঠিক করে। আরেকজন এসে করে দেয় না। প্রত্যেক ওয়ার্ল্ডভিউ তাকফির করার ক্ষমতা রাখে। মূর্খ ছাড়া কেউ এটা অস্বীকার করে না।

এভাবে অনেকভাবে এসব প্রশ্নের দুর্বলতা দেখানো যায়। তবে গুরুত্বপূর্ণ হল এসব প্রশ্নের পেছনের ধারণাগুলোকে আক্রমন করা। কারণ এই ধারনাগুলোকে পরম ভক্তিভরে বিশ্বাস করা ধর্মান্ধদের বিশাল একটা অংশ এগুলোর উৎস, ভিত্তি এবং তাৎপর্য সম্পর্ক কখনো ভালোভাবে চিন্তা করেনি। কপিবাজ শিশু সাহিত্যিকদের বইয়ের কথা, ইউটিউবের কিছু ভিডিও, টেডএক্স ওয়াজ, ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনের সিনেমা আর নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার লিস্ট থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে যা কিছু ‘ডীপ’ মনে হয়েছে সেগুলো নিয়ে বালুর প্রাসাদ বানিয়েছে। এই প্রাসাদ পিষে ফেলা জরুরী।