১। কাশ্মীরে বিপুল পরিমাণ সেনা মোতায়ন, ইন্টারনেট ও ফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করার কারণ শেষ পর্যন্ত জানা গেছে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিজেপি সরকার। আর এর প্রতিবাদে কাশ্মীরি মুসলিমদের বিক্ষোভ ও আন্দোলনকে গোড়াতেই পিষে ফেলার জন্যই হিন্দুস্তান সরকারের এতো আয়োজন। এ সেনা মোতায়েন ছিল দখলদারিত্বকে পাকাপোক্ত আর প্রতিবাদকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য।
না, এখনই কোন যুদ্ধ শুরু হচ্ছে না।
এখন থেকে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ, দুটি আলাদা অঞ্চল হিসেবে কেন্দ্র দ্বারা শাসিত হবে কাশ্মীর। ৩৭০ ধারার কারণে কাশ্মীরের সাংবিধানিক স্বাতন্ত্র্য ছিল, সীমিত পর্যায়ে ছিল কিছুটা স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ। এসব কিছু এখন মুছে গেল। তবে বাস্তবতা হল পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিকায়িত অঞ্চল কাশ্মীর দখলদারিত্বের খাঁচায় আটকে আছে অনেক, অনেক দিন ধরে। সাংবিধানিক এ স্বাতন্ত্র্য আগেও কিছু আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে খুব বেশি কিছু ছিল না।
তবে যে বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ তা হল, এখন বাতিল হয়ে যাবে ৩৭০ ধারার অধীনস্ত ৩৫এ অনুচ্ছেদও। ৩৫এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাশ্মীরের জমি এবং সম্পদের মালিক হতে পারতো কেবল ‘স্থায়ী বাসিন্দা’রাই। এ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরের মুসলিম-প্রধান স্ট্যাটাস বজায় রাখা। কিন্তু এখন ভারতীয় পুরোদমে কাশ্মীরে শুরু করতে পারবে তাদের সেটলার কলোনিয়ালিযম। কাশ্মীরিদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হবে, বুলডোযার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হবে তাদের বাড়িঘর, দেদারসে সেইসব জমি কিনে নেবে বিভিন্ন কর্পোরেশন এবং হিন্দুরা। গড়ে উঠবে হিন্দু-প্রধান অংশ। পুরোদমে চলবে নিয়মতান্ত্রিক জাতিগত নিধন। ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরকে ঠিক যেভাবে গিলে খেয়েছে যায়োনিযম, সেই একই পথে এগোবে হিন্দুতভা। আর সবরকম সহায়ত দেবে মধ্যপ্রাচ্যের যায়নিস্ট ক্যান্সার। আরএসএস এর পরিকল্পনা হল ধীরে ধীরে কাশ্মীরে মুসলিমদের সংখ্যলঘুতে পরিণত করা।
২। যাইদ হামিদ এবং ভীনা মালিকরা টুইটারে গাযওয়ায়ে হিন্দের ঘোষণা দিয়ে ফেললেও আদতে কিছুই করবে না পাকিস্তান। পাকিস্তানকে জানিয়েই ভারত এ পদক্ষেপ নিয়েছে, এবং পাকিস্তান কাশ্মীরিদের ঠিক অতোটুকুই সমর্থন দেবে যা তাদের আঞ্চলিক হিসেবনিকেশের সাথে যাবে। আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বর্তমান পর্যায়ে কাশ্মীর পাকিস্তানের এজেন্ডায় নেই। মাসুদ আযহার এবং হাফিফ সাইদের মতো আইএসআই ঘনিষ্ঠ লোকেদের বিরুদ্ধেও সম্প্রতি পাকিস্তানের নেয়া অল্পস্বল্প পদক্ষেপগুলো থেকে ব্যাপারটা আচ করা যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জম্মুকাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট আর হিযবুল মুজাহিদিনকে পাকিস্তানের সহায়তা দেয়ার দিন অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। যারা এখনই ভারত-পাকিস্তান সেনাবাহিনির যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখছেন তাদের সম্ভবত অপেক্ষা করতে আরও বেশ কিছু দিন।
৩। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করা দীর্ঘদিন ধরেই হিন্দুত্ববাদীদের দাবি। বিজেপি অনেকদিন ধরেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল এ ধারা বাতিল করার। টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর এ পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় মোদির সামনে ছিল না। যদি এবারো গড়িমসি করতো তাহলে যে আরএসএস এবং সঙ্ঘ পরিবার তাদের ক্ষমতায় বসিয়েছে তারাই বিগড়ে যেতো। একই কারণে হিন্দুত্ববাদের এজেন্ডার আর দুটো বিষয় সামনের দিনগুলোতে বাস্তবায়ন করতে হবে বিজেপিকে।
প্রথমটি হল এনআরসি তথা নাগরিত্বের তালিকা, যার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হবার কথা ৩১শে অগাস্ট। এর মাধ্যমে রাতারাতি রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়তে পারে আসামের ৩০-৪০ লক্ষ মানুষ,যার অধিকাংশই মুসলিম। নাগরিকত্ব ও রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে নেয়া এ মানুষগুলোকে কি বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হবে? নাকি আসামেই তাদের ওপর নেমে আসবে আরাকানের মতো কোন ভবিষ্যৎ? মনে রাখা দরকার, যে বিজেপির প্রপাগ্যান্ডা এবং প্রিয়া সাহার মতো এজেন্টরা এরইমধ্যে কোটি কোটি বাংলাদেশী অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর মিথ রেডি করে রেখেছে সম্ভাব্য যেকোন কিছুকে বৈধতা দেয়ার জন্য।
দ্বিতীয়টি হল, বাবরি মসজিদের ধংসস্তূপের ওপর রামমন্দির নির্মান। বিজেপি যদি এবার রামমন্দির নির্মানের কাজ শুরু না করে তাহলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, শিবসেনা আর বজরঙ দলের লোকজনই হয়তো তাদের টেনে নামাবে। রামমন্দির নিয়ে সামনে আগানো ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই বিজেপির সামনে।
৪। দীর্ঘ সাত দশক ধরে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের যে স্বপ্ন দেখা হয়েছে, কাল তা পোড়ানো হয়েছে বিজেপির জ্বালানো চিতায়। সমগ্র ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে, বাম-ডান, লিবারেল-কনযাভেটিভ, হিন্দু রাজনৈতিক সব শক্তি একযোগে এ চিতায় ঘি ঢেলেছে। সেক্যুলার সংবিধানের আড়ালে লুকিয়ে মুসলিম অধিকার রক্ষার স্বোপ্ন যে কোনদিনই সত্য হবে না, বরং ক্রমশ দুর্ভোগ যে আরও তীব্র হবে, কাল তা প্রমাণিত হয়ে গেছে অকাট্যভাবে। পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার তৈরি কাঠামো অনুযায়ী মুসলিমদের জন্য নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুসরণের পরিণতি কী, তা আবারো কাল প্রমাণিত হল। যদি শিক্ষাগ্রহণ করার মতো কেউ থেকে থাকে, তবে তারা শিক্ষা নিক।
৫। কাশ্মীরের মুসলিমদের এবং উপমহাদেশের মুসলিমদের এখন নিজেদের সাথে সৎ হয়ে চিন্তা করতে হবে, তাঁরা কি আসলেই হিন্দুত্ববাদের অখন্ড ভারত এজেন্ডার মোকাবেলা করতে চায়? বেছে নিতে চায় সম্মান, মর্যাদা ও শক্তির কঠিন, রক্তাক্ত ও দুর্গম পথ? নাকি এতো ঝামেলায় না গিয়ে বলিউড, আইপিএলে সুখটান দিয়ে হিন্দুত্ববাদের পায়ের নিচে নিজেদের মাথা বিছিয়ে দিয়ে, নিজেদের মা-বোন-স্ত্রীদের দেবতাদের ভেট হিসেবে উৎসর্গ করে বেছে নিতে চায় নির্ঝঞ্ঝাট ‘শান্তির’ জীবন?
যদি তারা পরেরটা বেছে নেয় তাহলে এতো চেচামেচি বাদ দিয়ে জন গানা মানা-র সুর ধরলেই ভালো হবে।
আর যদি তাঁরা প্রথমটা বেছে নেয় তাহলে ইসলামাবাদের দিকে না তাকিয়ে তাকাতে হবে কান্দাহারের দিকে। ইমরানের দিকে না তাকিয়ে তাকাতে হবে যাকির মুসার দিকে। ‘আযাদি’ আর ‘কাশ্মীর বানেগা পাকিস্তান’ এর স্লোগানের বদলে তুলে নিতে হবে নতুন স্লোগান –
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
ইম্মাহ শারীয়াহ ওয়া ইম্মাশ শাহাদাহ