ইসলাম কি শান্তির ধর্ম?
‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ - কথাটা শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়েছি। ইসলামের সমর্থনে কথা বলার সময়ে আমরা প্রায়ই এটা বলি। বিশেষ করে কাফেরদের সাথে ইসলাম নিয়ে কথা বলার সময়ে পশ্চিমা বিশ্বে অবস্থান করা মুসলিমরা এ কথাটা খুব বেশি ব্যবহার করেন। কিন্তু এ কথা বলার পর অনেক সময় কাফেররা বলে বসে, ‘ইসলাম যদি শান্তির ধর্মই হয় তাহলে তোমাদের কুরআনের ঐসব আয়াতের কী হবে যেখানে কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বলা হয়েছে?’ এ পর্যায়ে এসে মনে হতে শুরু করে যে মুসলিমরা তাঁদের ধর্মের কিছু কিছু বিষয় লুকোতে চাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে মুসলিমরা তর্কে জড়িয়ে যায়, পালটা জবাব দিয়ে বলে, ‘তোমাদের কিতাবেও তো হত্যা আর যুদ্ধের কথা আছে!’
আমাদের বোঝা উচিৎ যে ইসলাম নিয়ে লজ্জিত হবার কিছু নেই। আর এই উপলব্ধির জন্য আগে ইসলাম নিয়ে, এবং ইসলামের সত্যতার নিয়ে আমাদের ভালোভাবে জানতে হবে। দৃঢ় বিশ্বাস আসার পরই কেবল আমরা এই দ্বীন নিয়ে পরিপূর্ণভাবে গর্বিত হতে পারবো। এ দ্বীনের সত্যতার ঘোষণা দিতে পারবো গর্বের সাথে। সারা দুনিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে, স্পষ্টভাবে।
আমরা যদি বলতে চাই - ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম ভালোবাসার ধর্ম, বা অন্য কোন মূল্যবোধের ধর্ম - তাহলে প্রথমে দেখতে হবে, এই মূল্যবোধটি ইসলামের সব শিক্ষার মধ্যে বিদ্যমান কি না। এমন কোন আয়াত বা হাদিস আছে কি না যা এর বিরুদ্ধে যায়। তাই ইসলামের শিক্ষাকে এক কথায় প্রকাশ করার জন্য ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’, বলাটা তেমন যুতসই না। কারণ ইসলাম সব ক্ষেত্রে শান্তির কথা বলে না। অনেক ক্ষেত্রে আল্লাহ্ আমাদের যুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন। এমন অনেক আয়াত এবং হাদীস আছে যেখানে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
কাজেই ইসলাম শান্তির ধর্ম কথাটা সব ক্ষেত্রে খাটে না। কিন্তু আমরা যদি বলি, ইসলাম হল হাক্ব ও আদলের ধর্ম, সত্য ও ন্যায়বিচারের ধর্ম – তাহলে সেটা সব অবস্থায় প্রযোজ্য হবে। ইসলামের সব শিক্ষার ক্ষেত্রে এ দুটো বৈশিষ্ট্য প্রযোজ্য। সত্য ও ন্যায়বিচারের মূল্যবোধ অন্তর্নিহিত ইসলামের সব বিধান ও শিক্ষায়। এমন কোন আয়াত নেই যেখানে হকের বিপরীত নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমন কোন আয়াত পাবেন না যেখানে অবিচারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
তিনিই আল্লাহ যিনি সত্য ও মীযান (ইনসাফের মানদন্ড) সহকারে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। [তরজমা, সূরা আশ-শূরা, ১৭]
এবং তিনি বলেন,
এ কুরআনকে আমি সত্যতা সহকারে নাযিল করেছি আর সত্যতা সহকারেই তা নাযিল হয়েছে। [তরজমা, সূরা আল ইসরা, ১০৫]
এবং তিনি বলেন,
আমি আমার রসূলদেরকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ পাঠিয়েছি আর তাদের সঙ্গে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও (সত্য মিথ্যার) মানদন্ড যাতে মানুষ ইনসাফ ও সুবিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। [তরজমা, সূরা আল-হাদীদ, ২৫]
তাই ইসলাম হল হাক্ব ও আদলের দ্বীন। সত্য ও ন্যায়বিচারের ধর্ম। ইসলামের সকল শিক্ষায় এ দুটো মূল্যবোধ বিদ্যমান। অন্যদিকে শান্তির শিক্ষা সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। এমন অনেক পরিস্থিতি আছে যেখানে কাফিরদের সাথে শান্তি স্থাপন করাটাই অবিচার, অন্যায়। এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হল সত্য ও ন্যায়বিচারের দাবি।
একই কথা প্রযোজ্য, মুক্তি বা স্বাধীনতার ক্ষেত্রে। আমরা বলতে পারি না যে ‘ইসলাম স্বাধীনতার ধর্ম’। কারণ তখন বলা হবে – ‘ইসলাম যদি স্বাধীনতার ধর্মই হয় তাহলে কেন তোমরা ব্যক্তির সমকামী হবার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করো না’? দেখুন, স্বাধীনতা মানেই ভালো, এমন না। এমন অনেক স্বাধীনতা আছে যা অন্যায় ও অবিচারে পূর্ণ। এমন অনেক স্বাধীনতা আছে যার স্বীকৃতি ইসলাম দেয় না।
একইভাবে এটাও ঢালাওভাবে বলা সম্ভব না যে ‘ইসলাম সাম্যের ধর্ম’।
তখব বলা হবে, ‘ইসলাম যদি সাম্যের ধর্ম হয় তাহলে কেন সামাজিক ভূমিকা, অধিকার এবং দায়িত্বের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার ইসলাম দেয় না?’ কিন্তু আমরা বলি, সাম্য অনেক সময় অন্যায় এবং অন্যায্য হয়ে থাকে। শান্তি, স্বাধীনতা, সাম্য - এ সবই ইসলামে আছে। কিন্তু সেটা প্রযোজ্য সনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে, নির্দিষ্ট মাত্রায়। ঢালাওভাবে ইসলামের সব বিধানের ভিত্তি শান্তি, স্বাধীনতা কিংবা সাম্য না।
তাহলে প্রশ্ন হল, কিভাবে সব ক্ষেত্রে সত্য ও ন্যায়বিচারকে চেনা যাবে?
চেনার উপায় হল সব ক্ষেত্রে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর আনুগত্য ও গোলামি করা। ইসলাম হল আল্লাহ্র প্রতি দাসত্বের ধর্ম। ইসলাম মানুষকে মুক্ত করে কামনাবাসনার দাসত্ব থেকে। মুক্ত করে ক্ষমতাসীন, সম্পদশালী, মিডিয়া আর গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালাদের গোলামি থেকে। ইসলাম সৃষ্টির গোলামি থেকে মানুষকে মুক্ত করে তাদের স্রষ্টার গোলামি করতে শেখায়। আমরা যখন এভাবে ইসলামকে বুঝতে শিখবো, তখনই প্রকৃত ইসলামকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারবো। মানুষের প্রশ্ন তখন আমাদের বিভ্রান্ত, বিচলিত কিংবা অপ্রস্তুত করবে না।
তাই যারা অমুসলিমদের দাওয়াহ করেন, যারা ইসলামের পক্ষে কথা বলেন, তাদের প্রতি নাসীহাহ হল, এই ব্যাপারে পরিষ্কার থাকুন। দ্ব্যার্থবোধক কথা না বলে স্পষ্ট কথা বলুন। ইসলাম শান্তির ধর্ম না বলে বলুন, ইসলাম হাক্ক ও আদলের ধর্ম। আল্লাহ্ মানুষের মনে হাক্ক ও আদলের প্রতি সহজাত আকর্ষন তৈরি করে দিয়েছেন। ফিতরাতিভাবে মানুষ এ দুটোর দিকে আকৃষ্ট হয়। যারা এ দুটো মূল্যবোধ গ্রহণ করবে তাঁদের ইসলামে স্বাগতম। যারা এগুলোকে প্রত্যাখ্যান করবে তারা তা করবে নিজেদের বিকৃত প্রবৃত্তির কারণেই।
আল্লাহ্ ‘আযযা ওয়া জাল বলেন,
তুমি যাকে ভালবাস তাকে সৎপথ দেখাতে পারবে না, বরং আল্লাহ্ই যাকে চান সৎ পথে পরিচালিত করেন… [তরজমা, সূরা আল-ক্বাসাস, ৫৬]
আর এটা ইসলামের সম্মান ও মর্যাদার সাথে মানানসই না যে মানুষকে খুশি করার জন্য আমরা শান্তির স্লোগান তুলবো। কিংবা ইসলামের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করবো সাম্য, স্বাধীনতা কিংবা অধিকারের আধুনিক সংজ্ঞার সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে। আজকের দুনিয়ায় বহুল ব্যবহৃত এ শব্দগুলোর সাময়িক প্রভাব দেখে হন্তদন্ত হয়ে এর সাথে ইসলামের মিল খোঁজার কোন প্রয়োজন নেই। এগুলো ঠুনকো কিছু বুলি মাত্র। আজকের বিশ্বে শান্তি, সাম্য, স্বাধীনতা আর অধিকারের বুলি ফেরি করে বেড়ানো লোকেরা আর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কথা আর কাজে কোন মিল নেই। বৈশ্বিক পলিসির ক্ষেত্রে নিজেদের আওড়ে যাওয়া এসব আদর্শের লঙ্ঘন তারা করে হরহামেশা।
শেষ করার আগে আবারও সংক্ষেপে বিষয়টা পরিষ্কার করি।
আমরা বলছি না যে ইসলামের মাধ্যমে শান্তি স্থাপন সম্ভব না। বরং আমরা বলছি ইসলাম যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তা সাধারন মানুষের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। অন্যদিকে অন্যায়কারী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি রাখে। ইসলাম সঠিক ধরনের শান্তির কথা বলে। যা সত্য ও ন্যায়বিচারের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এবং ইসলাম এমন শান্তির পাশাপাশি শক্তির কথাও বলে যা শান্তির প্রতিরক্ষা করবে। ইসলাম ঐ শান্তির কথা বলে না যার ভিত্তি হল বশ্যতা ও দুর্বলতা।
যারা আজ বিশ্বজুড়ে কুফর ও যুলুমের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে, শান্তির নামে পৃথিবী জুড়ে ফাসাদ করছে, তারাও কিন্তু গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সাম্য-কে শর্তহীনভাবে বাস্তবায়ন করে না। কখনো শান্তির কথা বলে মুসলিমদের সমালোচনা করে। আবার কখনো শান্তির বুলি বিসর্জন দিয়ে গণতন্ত্রের নামে মুসলিমদের হত্যা করে। তারা এগুলোর ওপর সীমা আরোপ করে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো। অন্যদিকে ইসলামও সীমা আরোপ করে। তবে আল্লাহর নাযিলকৃত শিক্ষা অনুযায়ী। হাক্ক ও ন্যায়বিচারের কাঠামোর ভেতরে।
কোন উত্তম মূল্যবোধের ওপর কাফিররা আমাদের চেয়ে বেশি হক্বদার না। বরং তারা তো শুধু মুখস্থ বুলি আওড়ায় আর স্লোগান দিয়ে বেড়ায়। আবার যেসব মূল্যবোধের নামে স্লোগান দিয়ে যায় সেগুলোকে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো বদলে ফেলে। অনেকসময় নিজেরাই সেগুলোর বিরুদ্ধাচারণ করে।
বিচক্ষনতার পরিচায়ক হল ঢালাওভাবে, ইসলামকে শান্তির ধর্ম না বলা। বরং বিষয়টি স্পষ্টভাবে, বুঝিয়ে বলা উচিৎ। এবং আল্লাহ্ই সর্বাধিক জ্ঞাত।
মূল - ড. ইয়াদ কুনাইবি