১৯২৯ সাল। জটিল সমস্যায় পড়েছেন অ্যামেরিকান টোবাকো অ্যাসোশিয়েশনের প্রধান জর্জ হিল। অ্যামেরিকান নারীরা ঘরের ভেতরে ধূমপান করলেও কোন ভাবেই জনসম্মুখে তাদেরকে ধূমপান করানো যাচ্ছে না। অথচ দিনের বড় একটা সময় নারীরা ঘরের বাইরেই কাটাচ্ছে। পাবলিক প্লেইসে সিগারেট ফোঁকার ব্যাপারে আড়ষ্টতা কোন ভাবে কাটানো গেলে রাতারাতি বিক্রি বেড়ে যাবে। কিন্তু সেটা হবে কিভাবে?

এই জটিল সমস্যার সমাধানের জন্য জর্জ হিল গেলেন এডওয়ার্ড বার্নেইসের কাছে। ভদ্রলোককে আধুনিক পাবলিক রিলেশন্সের জনক বলা হয়। ‘পাবলিক রিলেশন’ হল প্রপাগ্যান্ডার শব্দের তুলনামূলক নিরীহ একটা প্রতিশব্দ। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বার্নেইস কাজ করেছেন জেনারেল ইলেট্রিক থেকে শুরু করে সিআইএ-এর সাথে। তার অবশ্য আরেকটা পরিচয় আছে। সম্পর্কে তিনি সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ভাগনে।

বার্নেইস কিভাবে মহিলালাদের ঘরের বাইরে ধূমপান করতে কনভিন্স করলেন জানেন?


একটা অ্যাড ক্যাম্পেইন শুরু হল- টর্চেস অফ ফ্রিডম। মুক্তির মশাল। বার্নেইস সিগারেটকে উপস্থাপন করলেন নারীর মুক্তি এবং পুরুষের সমান হবার প্রতীক হিসেবে। পুরুষরা যদি রাস্তায় বুক ফুলিয়ে সিগারেট টানতে পারে, নারীরা কেন পারবে না? কেন নারী এতে অস্বস্তিবোধ করবে?


এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তৈরি ট্যাবু ছাড়া আর কিছুই না। আধুনিক, স্বাধীন নারী এসব ট্যাবুর তোয়াক্কা করে না। বরং পাবলিক প্লেইসে নারীর ধূমপান এক ধরনের বৈপ্লবিক কাজ। এতে নিছক সিগারেট ফোকা হচ্ছে না, বরং ছেড়া হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিকতার বাধনও। নারীর হাতে ধরা সিগারেট আসলে তার মুক্তির মশাল।

প্রচারনা শুরু হল জোরেসোরে। ১৯২৯ সালের ইস্টার সানডে-র দিন দশ জন সুসজ্জিত তরুনীকে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে নিউইয়র্কের ফিফথ অ্যাভেনিউতে মার্চ করতে দেখা গেল গর্বিত ভঙ্গিতে। মুক্তির মশাল হাতে মুক্ত নারী।

এরা সবাই ছিল বার্নেইসের ভাড়া করা মডেল। মূল আয়োজক ছিল বার্নেইসের সেক্রেটারি বার্থা হান্ট। তবে ক্যাম্পেইন সফল হল।। নারীমুক্তি আর নারীর সিগারেট ফোঁকা নিয়ে আলোচনা শুরু হল দেশ জুড়ে। ক্যানসার স্টিক ফুঁকে নারীরা স্বাধীন হল। ভারী হল সদাশয় জর্জ হিল এবং তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের পকেট।

বিজ্ঞাপন কিভাবে সমাজের চিন্তা, আচরণ এবং মূল্যবোধকে প্রভাবিত করে, বার্নেইসের মুক্তির মশাল ক্যাম্পেইন তার বিখ্যাত উদাহরণ। বার্নেইস খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ধরতে পেরেছিলেন। মানুষের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল তার অবচেতন মনকে প্রভাবিত করা।


গতো নব্বই বছর ধরে সরকারী প্রচারণা, সিনেমা, অন্যান্য মিডিয়া এবং বিজ্ঞাপনে বার্নেইস এবং তার মত অন্যান্যদের আবিষ্কার করা টেকনিকগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে নানা ভাবে। বিভিন্ন গবেষণাতে দেখা গেছে, বিজ্ঞাপন শুধু পণ্য কেনার প্রতি আগ্রহ তৈরি করে না। বিজ্ঞাপন প্রভাবিত করতে পারে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধকেও।

কোন নির্দিষ্ট আচরণ এবং মূল্যবোধকে বিজ্ঞাপনে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হলে, দর্শকের মধ্যে সেগুলোর ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা গড়ে ওঠে। নানা মাত্রায় তারা তা অনুকরণের চেষ্টা করে।

ক্লোসআপ এবং ইউনিলিভারের ‘কাছে আসার গল্প’ ক্যাম্পেইনের সামাজিক প্রভাবটা এই দিক থেকে বোঝা তাই জরুরী। বিজ্ঞাপনগুলো দিয়ে ক্লোসআপ প্রথমে দর্শকের মনে তাদের পণ্যের সাথে ‘মিষ্টি প্রেমের দুষ্টু গল্প’-এর সম্পর্ক তৈরি করছে। ‘কাছে আসা’-কে উৎসাহিত করছে। উসকে দিচ্ছে মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী মনোদৈহিক তাড়নার একটাকে। ফাইনালি, ‘কাছে আসা’ বলতে কী বোঝায়, বদলে দিচ্ছে সেই ধারণাকেও

আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে ,কাছে আসার গল্প বলতে অধিকাংশ বাঙালি হয়তো ভাবতো কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটির তরুন-তরুণীর মধ্যে প্রেম। তারপর বিয়ে, কিংবা বিচ্ছেদের পর দেবদাসের মত টিপিকাল মধ্যবিত্তীয় দুঃখবিলাস।

কিন্তু আধুনিক পশ্চিম শুধু নারীপুরুষের যিনাতে সন্তুষ্ট না। সমকামীতা, উভকামীতা, বহুগামীতা, ট্র্যান্সজেন্ডারসহ সব কিছুকে তারা বৈধ মনে করে। আধুনিক পশ্চিম এবং ক্লোসআপ পারস্পরিক সম্মতিক্রমে যখন ইচ্ছা, যার কিংবা যাদের সাথে ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা শোয়ার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাদের মতে, এতে যেকোন ধরনের সীমা আরোপের অর্থ ‘মুক্তি’ এবং ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’-কে সীমাবদ্ধ করা।

যৌনতার স্বাধীনতার ব্যাপারে ক্লোসআপ তাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করছে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। সময়ের সাথে সাথে তাদের প্রচারণার মাত্রা বদলাচ্ছে। গতো কয়েক বছর তারা ছাদ কিংবা হুড তোলা রিকশায় কাছে আসা-যাওয়াকে প্রমোট করেছে। এবছর উৎসাহিত করছে ‘ধর্মের বাঁধ ভেঙ্গে’ প্রেমকে। আর ধর্মের বাঁধ একবার ঠিকঠাক ভাঙ্গতে পারলে সমকাম, উভকাম কিংবা অন্য যেকোন ‘কাম’-কে পবিত্র প্রেম হিসেবে প্রচার করা খুব একটা কঠিন হবে না।

ক্লোসআপ একা না। এর আগেও এদেশে অনেকে এটা করেছে। এখনো করছে। ১০-১২ বছর আগেকার ডিজুস আর বন্ধু-আড্ডা-গান ক্যাম্পেইনের কথা চিন্তা করুন। এই বিজ্ঞাপনগুলো দেখে বড় হওয়া প্রজন্ম এবং তাদের অভিভাবকরা আগের তুলনায় স্লিপওভার, বন্ধুবান্ধীদের ট্যুর, কিংবা ‘গ্রুপ স্টাডি’র ব্যাপারে অনেক উদার

উবারও কিছুদিন আগে ক্যাম্পেইন করেছে। রাতে ডেইট? চিন্তার কিছু নেই। যাবার সময় উবার ডাকলেই হবে। আমাদের মেয়েদের উবার নিরাপদে পৌছে দেবে ভাড়া করা হোটেল কিংবা খালি বাসায়। এই ট্রেন্ড ভালোভাবেই চলছে।

কেউ বলতে পারেন, বিজ্ঞাপনগুলো আসলে মূল্যবোধ পরিবর্তন করছে না। সমাজে যা অলরেডি চলছে, তারা সেটাতে স্রেফ ক্যাপিটালাইয করার চেষ্টা করছে। বাজারে চাহিদা আছে দেখেই তারা এভাবে বিজ্ঞাপন বানাচ্ছে।

কথাটা পুরোপুরি ভুল না। সমাজের অনেক অংশে এই ধরনের আচরণ বেশ প্রচলিত হয়ে গেছে, এটা সত্য। তবে এখানেও কিছু বিষয় দেখা জরুরী।

প্রথমত, কোন বিষয়ে সমাজে ঘটা আর সেটা সমাজে গ্রহণযোগ্য হবার মধ্যে পার্থক্য আছে। যেমন, ১৯২৯ সালে ঘরের ভেতরে ধূমপান আর বাইরে ধূমপানের মধ্যে পার্থক্য ছিল। এই ধরনের বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে, যা নিছক ‘আছে’, তা গ্রহনযোগ্য হয়ে ওঠে। একসময় হয়ে ওঠে 'ব্যাপকভাবে প্রচলিত', আর তারপর…স্বাভাবিক।

দ্বিতীয়ত, ক্লোসআপ সমাজের মূল্যবোধকে একটা নির্দিষ্ট দিকে নিয়ে যেতে চায়, এটা তার নিজেরাই স্বীকার করে- https://cutt.ly/POFJ0OP

সমাজে যিনা চলছে। কিন্তু ক্লোসআপ চায় সেটা গ্রহণযোগ্য হোক। প্রকাশ্যে হোক, বলেকয়ে হোক। লজ্জা ছাড়া হোক। ক্লোসআপ এবং তাদের মত অন্যরা চায়, ধর্ম, প্রচলন, পরিবার কিংবা লিঙ্গের সীমানা ভেঙ্গে ভালোবাসাবাসি।

যা চলছে সেটা থেকে নিছক প্রফিট করে তারা সন্তুষ্ট না। ক্লোসআপ এটাকে আরো সামনে নিয়ে যেতে চায়। ঠেলতে চায় সীমানাকে। বাংলাদেশের (এবং অন্যান্য দেশের) সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় ষাটের দশকের অ্যামেরিকার যৌন বিপ্লবের মূল্যবোধ ও দর্শনকে। এটা আমার কথা না, ক্লোসআপের নিজেদের সাইট এবং নিজেদের প্রকাশিত শ্বেতপত্রেই এসব কথা বলা আছে। [লিঙ্ক, কমেন্টে]

ক্লোসআপ যা করছে তার প্রভাব আছে আমার-আপনার আত্মীয়, বন্ধু, পরিবার এবং সন্তানদের জীবনে। এই সমাজের মধ্যেই আমরা থাকি। পুকুরের পানি ষ্ট হলে সব মাছকেই সেটা প্রভাবিত করে। তাই ক্লোসআপের এই এজেন্ডার বিরুদ্ধে কথা বলা, মানুষকে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করা এবং সাধ্যমত তাদের বয়কট করা জরুরী।

হ্যাঁ, আরো অনেকে এই ধরনের কাজ করছে এবং করবে। আমরা এক সাথে তাদের সবার বিরুদ্ধে বলতে পারবো না। কথা সত্য। কিন্তু শুরু তো কোন না কোন জায়গা থেকেই করতে হবে, তাই না? আগে বিরোধিতা করা হয়নি, অন্যদের বিরুদ্ধে বলা হয় নি, ঠিক আছে। এখন বলুন। ক্লোসআপকে দিয়ে শুরু হোক। পরে অন্যদের কথা বলা যাবে। এক সাথে পুরোটা করা যাচ্ছে না, তাই পুরোটা এক সাথে বাদ দেয়া তো যৌক্তিক না।

তাছাড়া আপনাকে বাড়তি কিছুই করতে হচ্ছে না। আরেক ব্র্যান্ডের টুথপেইস্ট কিনতে অতিরিক্ত তেমন খরচ নেই। ক্লোসআপ বর্জন করতে বলা, মানুষকে বিষয়গুলো জানানো - এসবেও খরচ নেই।

ফেইসবুকে আমরা কেউ এই শতাব্দীর কালজয়ী উপন্যাস লেখায় ব্যস্ত না। ইউটিউবার কিংবা টিকটকাররাও মহান কোন সিনেমা কিংবা ডকুমেন্টারি বানাচ্ছেন না। হাসির ভিডিও, লাইককমেন্ট, হালকা কাব্যিক ভাবসাব, খুচরো কিছু স্ট্যাটাস, রিঅ্যাকশন ¬-এই তো সোশ্যাল মিডিয়ার রুটিন। এগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ক’দিন ক্লোসআপ নিয়ে কথা বললে বিশাল কোন ক্ষতি কি হয়ে যাবে?

একেবারেই না।