বহুদিনের পুরোনো প্রশ্ন, ‘মুসলিম-বিশ্ব পিছিয়ে আছে কেন?’

বহুদিনের মুখস্থ উত্তর—ইসলামের কারণে।

এমন উত্তর প্রাচ্যবিদ, পশ্চিমা ইসলামবিদ্বেষী কিংবা ওবামার মতো লোকের কাছ থেকে আসলে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো অনেক মুসলিমদের মধ্যেও এমন চিন্তাভাবনা কাজ করে। নিজের মুসলিম পরিচয়কে ঘৃণা করা আর হীনম্মন্যতায় ভোগা মুসলিমদের অনেকেই ঔপনিবেশিক যুগের শুরু থেকে এ প্রশ্নের জবাবে সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের সাথে সুর মিলিয়ে বলে আসছে–‘ইসলামই হলো মূল সমস্যা। অগ্রগতির একমাত্র উপায় ইসলামকে বাদ দেয়া।’

তবে পরাজিত মানসিকতার মুসলিমরা এ কথাটা সরাসরি বলে না। একটু ঘুরিয়ে বলে। যেমন এদের কেউ কেউ বলে, ‘ইসলামের সংস্কার দরকার’, অথবা বলে, ‘আমাদের উচিত পুরোনো ফিকহগুলোকে আবার খতিয়ে দেখা, শরীয়াহর ব্যাপারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করা এবং প্রয়োজন মতো নতুন নতুন ইজতিহাদ করা’, অথবা তারা বলে ‘আগেকার আলিমদের মধ্যে নারীবিদ্বেষী প্রবণতা ছিল’।

কথাটা সরাসরি না বলে, মুসলিম মর্ডানিস্টরা এভাবে ঘুরিয়ে বলে। এদের অনেকে সনাতন পদ্ধতিতে ইলম অর্জন করেছে। পোশাক-আশাকের দিক থেকেও বাহ্যিকভাবে এদের অনেককে দেখে আলিম মনে হয়, যেমন জামালুদ্দিন আফগানী, মুহাম্মাদ আবদুহ, আলি জুমা কিংবা আব্দুল্লাহ বিন বায়্যাহ। সব মর্ডানিস্ট কিন্তু আদনান ইব্রাহিমের মতো সুট-টাই পরে না।  

ইসলাম, আলিম এবং ইলমের প্রতি সাধারণ মুসলিমদের মনে থাকা গভীর শ্রদ্ধাবোধকে কাজে লাগিয়ে–ধর্মীয় পোশাক, শিক্ষা এবং শব্দ ব্যবহার করে–এ মর্ডানিস্টরা খুব সহজে মানুষকে প্রভাবিত করে ফেলে। এ কারণে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা শুরু থেকেই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ ধরনের আলিমদের ব্যবহার করে আসছে। আজও করছে।

এবার আসুন ‘পিছিয়ে পড়ার’ প্রশ্নটা একটু খতিয়ে দেখা যাক।

নিজেদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য মুসলিমরা যখন ইসলাম ও ইসলামী ঐতিহ্যকে দায়ী করে, তখন কে আসলে লাভবান হয় বলুন তো?

কী? প্রশ্নটা বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে? আচ্ছা পৃথিবীর পিছিয়ে পড়া অন্যান্য অঞ্চলগুলোর দিকে একটু তাকানো যাক।

ভেনেজুয়েলার মতো ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশগুলো কেন পিছিয়ে আছে? নিউইয়র্ক টাইমসের লিবারেল বিশ্লেষকরা এ প্রশ্নের উত্তর দেয় এভাবে–

‘মি. মাদুরোকে (ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট) ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে, এটা বেশ কিছুদিন ধরেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। ২০১৩-তে বামপন্থী একনায়ক হুগো শাভেজের স্থলাভিষিক্ত হবার পর থেকে তার অব্যবস্থাপনা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং তেলের মূল্য হ্রাস (যেটা ভেনেজুয়েলার আয়ের মূল উৎস) দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলছে। মাত্রাতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতির কারণে বেতনের টাকা পরিণত হয়েছে একটা অর্থহীন জিনিসে। লোকজন ক্ষুধা আর চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে আশপাশের দেশগুলোতে।’[1]

দেখুন, দেখুন! ভেনেজুয়েলার লোকগুলোর জন্য পশ্চিমা দেশগুলো কী দরদটাই-না দেখাচ্ছে। তারা কত চিন্তিত! ভেনেজুয়েলার লোকগুলো না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে! তাদের প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই! তারা মাত্রাতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতিতে ভুগছে! আমাদের কিছু একটা করা দরকার! আমাদের উচিত ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তনের পরিকল্পনা সমর্থন করা!! আমাদের হয়তো ভেনেজুয়েলা আক্রমণও করা উচিত! এই পরিস্থিতিতে ভেনেজুয়েলার নিপীড়িত মানুষদের সাহায্য করার এটাই একমাত্র মানবিক উপায়!!

কিন্তু তারা যা বলে না তা হলো–এই ক্ষুধা, ওষুধের অভাব আর মাত্রাতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণ হলো বছরের পর বছর ধরে ভেনেজুয়েলার ওপর চলা অর্থনৈতিক অবরোধ। বছরের পর বছর ধরে একটা দেশের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হলে, সেই দেশের মানুষ তো অর্থনৈতিক সংকটে পড়বেই, তাই না? আপনি প্রথমে অর্থনৈতিক অবরোধ দেবেন। তারপর সংকট দেখা দিলে নিজের অপছন্দের রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ওপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে সরকার পরিবর্তন কিংবা সামরিক অভিযানের কথা বলবেন। খুব মজা, তাই না?! দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের চক্রাকার যুক্তি ব্যবহার করে নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ অন্যান্য পশ্চিমা মিডিয়াগুলো সামরিক অভিযান আর সরকার পরিবর্তনের পলিসি সমর্থন করে আসছে।

ভেনেজুয়েলা এ কূটকৌশলের একমাত্র শিকার না। ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশকে এভাবে অ্যামেরিকান ‘মানবতার’ মাধ্যমে নতজানু করা হয়েছে। বিশ্বের এই তথাকথিত ত্রাণকর্তা(!) অ্যামেরিকা, পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে এভাবেই রক্ষা করছে! এটাই নাকি একমাত্র উপায়!

TruthDig এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী,

‘নিউইয়র্ক টাইমসের আর্কাইভের এক জরিপে দেখা গেছে, ল্যাটিন অ্যামেরিকাতে হওয়া অ্যামেরিকা সমর্থিত ১২টা সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে ১০টাকেই সমর্থন দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদনা পরিষদ। যে দুটো অভ্যুত্থানকে তারা সমর্থন দেয়নি, তার একটি হলো ১৯৮৩ সালের গ্র্যানাডা আক্রমণ আর ২০০৯ সালের হন্ডুরাস অভ্যুত্থান। এ দুটি ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান ছিল অস্পষ্ট কিংবা অনিচ্ছুক বিরোধিতার।

সিআইএ, মার্কিন সেনাবাহিনী আর এদের সাথে যুক্ত কর্পোরেশানগুলো ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশগুলোকে কেন বারবার টার্গেট করছে জানেন? কারণ, এ দেশগুলো অ্যামেরিকান পুঁজিবাদ আর তাদের কৌশলগত উদ্দেশ্যের জন্য হুমকি। এ কারণেই দেশগুলোতে বারবার সমস্যা তৈরি করা হচ্ছে, দেশগুলো অগণতান্ত্রিক হবার কারণে না। তাই নিউইয়র্ক টাইমসের কিছু কিছু কথা সত্য হলেও, বাস্তবে যা হচ্ছে তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা এগুলো থেকে পাওয়া যায় না।’[2]

সংক্ষেপে এটাই অ্যামেরিকার কৌশল। এভাবেই তারা কাজ করে। নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাকে দিয়ে অ্যামেরিকার স্বার্থ পূরণ হবে? কারা অ্যামেরিকা এবং অ্যামেরিকান কর্পোরেশানগুলোর কাছে সস্তায় প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করবে?

অধিকাংশ দেশের সরকার সোৎসাহে এবং সাগ্রহে অ্যামেরিকাকে স্বাগত জানায়। তবে মাঝেমধ্যে কিছু-না-কিছু লোক উদিত হয়, যারা ঝামেলা করে। এই ঝামেলার সমাধান অ্যামেরিকা কীভাবে করে? নিষ্ঠুর, কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আর অবরোধের মাধ্যমে। যার কারণে জীবন দিতে হয় বিপুলসংখ্যক মানুষকে। মনে আছে ম্যাডেলিন অলব্রাইট বলেছিল, অ্যামেরিকার চাপানো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ৫ লক্ষ ইরাকী শিশুর মৃত্যু ‘দরকারি’ ছিল?

একদিকে অ্যামেরিকার সরকার এসব করে বেড়ায়, অন্যদিকে অ্যামেরিকান মিডিয়া রিপোর্ট করে, ‘দেখুন, এই দুস্থ লোকগুলো মারা যাচ্ছে! ক্ষুধার্ত এই শিশুদের জন্য আমাদের কিছু একটা করা উচিত!’

তবে অ্যামেরিকার বন্ধুভাবাপন্ন কোনো স্বৈরশাসকের দুঃশাসনের কারণে যখন জনদুর্ভোগ তৈরি হয়, তখন আর তাদের মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো পদক্ষেপও নিতে দেখা যায় না।

অতএব, এই পিছিয়ে পড়াদের তালিকায় মুসলিম-বিশ্ব একা না। উত্তর অ্যামেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের বাইরে পৃথিবীর অনেক অঞ্চলই একই রকম অর্থনৈতিক দুর্দশার শিকার। তাহলে ইসলামের দিকেই কেন বারবার অভিযোগের আঙুল? কেন ইসলামিক ঐতিহ্য এবং সোনালি যুগের আলিমদের দোষারোপ করা? এটার কোনো অর্থ হয়?

আসলে কী ঘটছে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। অ্যামেরিকা পুরো পৃথিবীকে জিম্মি করে রেখেছে। দেশগুলোর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। আর কিছুদিন এ অবস্থায় থাকার পর জিম্মি তার অপহরণকারীকে ভালোবাসতে শুরু করছে।

যখন দেখবেন মুসলিম-বিশ্ব পিছিয়ে পড়ার জন্য কেউ ইসলামকে দায়ী করছে, চোখে ওদের আঙুল দিয়ে তখন পিছিয়ে পড়া কাফির দেশগুলোর অবস্থা দেখিয়ে দেবেন। সেই দেশগুলোর কেন এ অবস্থা? তারা তো মুসলিম না, তারা তো ইসলাম মানে না।

পুরো পৃথিবীর মধ্যে শুধু অল্প কিছু পশ্চিমা দেশই কেন অনাহার আর দারিদ্র্য থেকে বেঁচে থাকার ফর্মুলা আবিষ্কার করল? এই ম্যাজিক ফর্মুলা শুধু পশ্চিম ইউরোপই কেন আবিষ্কার করতে পারল? বাকি পৃথিবী কেন পারল না? বিশ্বের বাকি ৯০% মানুষ কি অথর্ব? ইউরোপীয়দের কি এমন কোনো জাতিগত কিংবা বর্ণগত শ্রেষ্ঠত্ব আছে, যার বদৌলতে শুধু তারাই এটা পারল? আর্য শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই কি এই সফলতা?

নাকি অন্য কিছু ঘটছে মিডিয়ার টেনে দেয়া পর্দার আড়ালে?

[ড্যানিয়েল হাক্বিকাতযু, The Modernist Menace To Islam বই থেকে নেয়া। বাংলায় ‘সংশয়বাদী’ নামে অনূদিত।]


[1] Venezuela: Between Maduro and a Hard Place, The New York Times, January 24, 2019

[2] Your Complete Guide to the N.Y. Times’ Support of U.S.-Backed Coups in Latin America, Truthdig, January 29, 2019