১। ২০১৯ এর ডিসেম্বরে উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করেন জার্মান মুসলিম ফুটবলার মেসুট ওযিল। প্রায় ত্রিশ লক্ষ উইঘুরদের ওপর চালানো চীনের অবর্ণনীয় নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে ওযিল বলেন, মুসলিম উম্মাহ উইঘুর পরিত্যাগ করেছে। এ ঘটনার পর অফিশিয়ালি বিবৃতি দিয়ে এ বক্তব্য থেকে নিজেদের দূরত্ব ঘোষণা করে ওযিলের ক্লাব আর্সেনাল। চাইনিয সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত বিবৃতিতে আর্সেনাল বলে তারা সবসময় “রাজনীতি থেকে দূরে থাকার নীতি অনুসরণ করে”।

প্রায় ছ’ মাস পর অ্যামেরিকাতে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেদের প্রোফাইল পিকচার কালো করে অ্যামেরিকায় চলা বিক্ষোভের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে আর্সেনাল। একজন কৃষাঙ্গ অ্যামেরিকানকে তার এথনিসিটির কারণে হত্যা করা হলে সেটা নিয়ে কথা বলা আর্সেনালের কাছে রাজনীতি না। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে তাঁদের ধর্মের কারণে কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে বন্দী করা হলে, নির্যাতন করা হলে, হত্যা ও ধর্ষন করা হলে সেটা নিয়ে কথা বলা আর্সেনালের কাছে রাজনীতি।

২। গত সপ্তাহে ভারতীয় অভিনেতা ও সেলিব্রিটিদের হিপোক্রেসি নিয়ে কথা বলে আলোচনায় আসে বলিউড অভিনেতা অভয় দেওল। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু আর অ্যামেরিকায় পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে হঠাৎ সোচ্চার হওয়া ভারতীয় সেলিব্রিটি এবং মধ্যবিত্তদের উদ্দেশ্য করে অভয় দেওল বলে, হয়তো নিজের ঘরে চলা পুলিশি নির্যাতন ও বর্ণবাদ নিয়ে ভারতীয়দের এখন চিন্তা করার সময় হয়েছে।

৩। দিন কয়েক আগে ভারতের কেরালাতে গর্ভবতী এক হাতির মৃত্যুতে উত্তাল হয়ে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়া। মানবতার অধঃপতন নিয়ে চলে ব্যাপক হাহুতাশ। ঠিক একই সময়ে ভারতের কারাগারে বন্দী সাফুরা যারগার নামের গর্ভবতী মুসলিম নারীকে নিয়ে কোন কথা হয় না। নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে বন্দী করা হয় সাফুরাকে। তাঁর জামিনের আবেদন অমানবিকভাবে নাকচ করে দেয়া হয় কোর্ট নামের সেক্যুলারিযমের সবচেয়ে বড় মন্দিরে।

৪। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর থেকে বাংলাদেশের সেক্যুলাররা খুব করে ঘৃণা আর পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলছে। বলছে মানবিকতা, অধিকার আর রুল অফ ল’-এর কথা। বিস্ময়কর ব্যাপার হল এই সেক্যুলারদের বিশাল একটা অংশ আজ থেকে ৭ বছর আগে শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে ‘রুল অফ ল’ উপেক্ষা করে, “ফাঁসি, ফাঁসি, ফাঁসি চাই” স্লোগান দিয়েছে। এদের অনেকেই সুর মিলিয়েছে, ‘একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’ স্লোগানে।

বাংলাদেশে যখন ‘শিবির করা’ কিংবা ‘জঙ্গি হওয়ার’ কারণে অসংখ্যা মুসলিমকে হত্যা, নির্যাতন কিংবা বন্দী করা হয়েছে, তখন এদের বেশিরভাগ চুপ থেকেছে। খুশিও হয়েছে। পত্রিকাতে যখন ইসলামী বইকে ‘জঙ্গি বই’, ইসলাম পালনকে জঙ্গিবাদ বলা হয়েছে তখন তারা নিয়ম করে মাথা ঝাকিয়ে গেছে। মাদকব্যবসায়ী কিংবা অন্য কোন শ্রেণীর লোকেরা যখনো ডজনে ডজনে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে, তখন এরা উল্লাস করেছে। ‘বন্দুকযুদ্ধের’ প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলাপ করেছে। অনেকে উস্কে দিয়েছে। হঠাৎ করে আজ তাদের মানবতা জেগে উঠেছে!

এমন উদাহরণ অসংখ্য। উদাহরণগুলো দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন আসে। সোশ্যাল মিডিয়াতে হাহুতাশ করা এই দেশীবিদেশী লোকগুলোর নৈতিকতার মাপকাঠি আসলে কী? কেন এমন ‘বেছে বেছে ক্ষুব্ধ হওয়া’? কেন এমন ডাবলস্ট্যান্ডার্ড?

জর্জ ফ্লয়েড কিংবা অন্য কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে চলা সিস্টেম্যাটিক বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবশ্যই অবস্থান নেয়া উচিৎ। এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। ইসলাম আমাদের শেখায়, সাদা এবং কালোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, মানুষের মাঝে স্তরভেদের মাপকাঠি হল তাকওয়া। কিন্তু প্রশ্ন হল বৈষম্য ও যুলুমের বিরুদ্ধে যে অবস্থান, সেটার ভিত্তি কী? নৈতিকতা? আবেগ? আদর্শিক সম্পর্ক? নাকি নিছক ট্রেন্ড আর ভাইরাল টপিকের অনুসরণ?

বাংলাদেশের কিছু সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটি তথা লিবারেল মিশনারীর মতে, এই অবস্থানের ভিত্তি হবে আবেগ। মন। তাদের কথা হল, যে ঘটনা যার মনে নাড়া দেবে, সে ওটা নিয়ে কথা বলবে। যদি আসলেই ব্যাপারটা তাই হয়, তাহলে তারা অন্যান্য সময়ে সাধারণ মানুষকে যেসব নীতিবাক্য শোনান সেগুলোর আর কোন বৈধতা থাকে না। ইন ফ্যাক্ট, কোন ধরণের অবজেক্টিভ মরালিটির ব্যাপারই আর থাকে না।

আমি কেন ধর্ষনের বিরুদ্ধে কথা বলবো? ধর্ষনের ঘটনা হয়তো আমার মনে নাড়া দেয়নি। কেন আমি নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলবো?

আমি কেন ‘সন্ত্রাস হামলা’ কিংবা ‘উগ্রবাদের’ বিরুদ্ধে কথা বলবো?

কেন আমি দেশপ্রেম কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কেয়ার করবো? কেন অমুকতমুককে সম্মান করবো? এগুলো আমার মনে নাড়া দেয় না।

আমার মনে শুধু নেটফ্লিক্স সিরিয আর হলিউড ব্লকবাস্টারের ঘটনাগুলো নাড়া দেয়। আমার মনে শুধু বলিউডের আইটেম গান নাড়া দেয়। আমার মনকে শুধু আমার স্বার্থ, আমার আরাম, আমার খুশি নাড়া দেয়। আমি কেন অন্যকিছু নিয়ে মাথা ঘামাবো?

এসব প্রশ্নের কোন উত্তর তখন আর নিউ এইজ মিশনারীদের কাছে থাকে না। যদি দ্বারা কনসিসটেন্টলি ‘মনে নাড়া লাগার’ নীতি অনুসরণ করতে চায় তাহলে খুবই ভাল। পরের কোন ইস্যুতে এসে নীতিবাক্য আওড়ানো আর পাবলিককে জ্ঞান দেয়ার সময় যেন একথাগুলো খেয়াল থাকে। সমকামী অধিকার টাইপ বিষয় নিয়ে লিবারেল ওয়াজ করার সময় যেন আবার ‘আমাদের করতে হবে’, ‘বুঝতে হবে’, ‘মানবতা’, ‘অধিকার’ এর মতো শব্দগুলো মুখ থেকে বের না হয়।

আর যদি যুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থানের ভিত্তি হয় নৈতিকতা, তাহলে প্রশ্ন আসে, এই নৈতিকতার কি কোন কনসিস্টেন্ট মাপকাঠি আছে? কেন এই নৈতিকতা এক সময় মাথা চাড়া দেয় আর অন্য সময় ঘুমিয়ে থাকে?

কেন লক্ষ লক্ষ মানুষের ওপর চালানো জাতিগত নিধন, প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষকে ডিহিউম্যানাইয করার রাষ্ট্রীয় প্রজেক্টের বিরুদ্ধে এই নৈতিকতা সোচ্চার হয় না? কিন্তু অ্যামেরিকাতে চলা তুলনামূলক অল্প মাত্রার যুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়?

এই নৈতিকতা কি আইডিওলজিকালি মোটিভেইটেড? অর্থাৎ যারা আদর্শিকভাবে আমার কাছাকাছি তারা যে ইস্যুতে সোচ্চার হবে, আমিও সেই ইস্যুতে সোচ্চার হবো? আমার দল, আমার গোত্রের নীতিই আমার নীতি? নাকি এই নৈতিকতা নিউয সাইকেল দ্বারা প্রভাবিত? মিডিয়া যখন যা নিয়ে চিল্লাপাল্লা করে আমার নৈতিকতা সেটাতেই সাড়া দেয়। অন্যসময় ঘুমে থাকে।

এই বেছে বেছে ক্ষুব্ধ হওয়া কি জাস্ট এক ধরনের পাবলিক রিলেশন্স স্টান্টবাজি। ট্রেন্ডিং টপিক কাজে লাগিয়ে লাইক-কমেন্ট-শেয়ার বাড়ানোর ধান্দা? নাকি এটা ভারচু সিগনালিং? চলমান কোন ইস্যুতে জনপ্রিয় কোন অবস্থান নিয়ে নিজেকে নৈতিক প্রমাণ করার চেষ্টা?

বাস্তবতা হল তাদের কোন কনসিসটেন্ট মাপকাঠি নেই, নৈতিকার কোন কনসিসটেন্ট সংজ্ঞা নেই। তাদের সংজ্ঞা, মাপকাঠি, ক্ষোভ, একাত্মতা প্রতিনিয়ত পাল্টাতে থাকে। মানবতা, অধিকার, ন্যায়বিচার নিয়ে তাদের কথাগুলো আসলে ফাপা বুলি। এসব অন্তসারশূন্য কথাবার্তা, উপচে পড়া আতলামি আর ন্যাকামি দিয়ে এরা আসলে নিজেদের ডাবলস্ট্যান্ডার্ডকে গ্রহণযোগ্যতার পোশাক পরায়। তাই এই প্রশ্নগুলো বারবার, বাংলাদেশের সুশীল, সেক্যুলার, প্রগতিশীল, শাহবাগী আর লিবারেল মিশনারীদেরকে করা দরকার। ভাঙ্গা রেকর্ডের মত পুনরাবৃত্তি করে প্রশ্নগুলো গেঁথে দেয়া দরকার মানুষের মনে। যাতে সেক্যুলারিযমের ডাবলস্ট্যান্ডার্ড সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।