একজন চোর কখন বড় গলায় চুরির কথা বলে বেড়ায়? খুনী কখন প্রকাশ্যে খুন করে এবং পালানো প্রয়োজন মনে করে না? ধর্ষক কখন ধর্ষিতার ঘর অবরোধ করে রাখে? আর নিজের অপরাধের প্রমাণ নিজেই সবার সামনে তুলে ধরে? কোন অবস্থায় অপরাধী শাস্তির আশঙ্কা নিয়ে মাথা ঘামায় না?

ধর্ষন কেন হয়, তা নিয়ে নানা আলাপ আছে। আছে নানান তত্ত্বকথার। একটা জনপ্রিয় ব্যাখ্যা হল ধর্ষনের সম্পর্ক শক্তি, ক্ষমতা আর এর কাঠামোর সাথে - Rape is always about power। আমার কাছে এই থিওরি সঠিক মনে হয় না। জারগনের মারপ্যাচে মানুষের নফস এবং প্রবৃত্তির অনেক বাস্তবতাকে এসব তত্ত্বে ইন্টেলেকচুয়ালাইয করার আর বিমূর্ত রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়।

তবে আজকের বাংলাদেশে যে ছবিটা আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটার সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ইন ফ্যাক্ট, এটা অস্বীকার করে আজকে বাস্তবতাকে বোঝার চেষ্টা করা চোখ বন্ধ করে দেখার চেষ্টা করার মতো।

সাধারণত ধর্ষন একটা অপুরটুনিস্টিক ক্রাইম। ধর্ষক সুযোগসন্ধানী শিকারির মতো অপেক্ষা করে। একটা মেয়ে রাতে গার্মেন্টেসে কাজ শেষে রাতে ঘরে ফিরছে, কোন অন্ধকার রাস্তায় ধর্ষক তাকে অ্যামবুশ করে। স্বামী-স্ত্রী নির্জন কোন এলাকায় ঘুরতে গেছে, একদল ধর্ষক তাদের হঠাৎ আক্রমন করে। কোন অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি হলে, কিংবা অরাজকতা বিরাজ করলে ডাকাতি, ছিনতাইয়ের পাশাপাশি ধর্ষনও বেড়ে যায়। এ অপরাধগুলো অপুরটুনিস্টিক।

তবে সব ধর্ষন এমন না। ধর্ষন অনেক সময় ব্যবহৃত হয় যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে। আরাকানে বার্মিয আর্মি, কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনী, ৭১ এ না-পাক বাহিনী, সিরিয়াতে নুসাইরি শাবিহা বাহিনী, দ্বিতীয় বিশ্বুযদ্ধের পর জার্মানিতে কমিউনিস্ট রেড আর্মি কিংবা ইরাকে আবু গ্বুরাইবে মার্কিন আর্মির চালানো ধর্ষন ও যৌন নির্যাতন এর উদাহরণ। ধর্মীয় কিংবা জাতিগত দাঙ্গার সময়ে ঘটা ধর্ষন/গণধর্ষনও একই ক্যাটাগরিতে পরে।

এসব ক্ষেত্রে ধর্ষনের যৌন তাড়নার দিকটা থাকে। একই সাথে থাকে ধর্ষিতার (এবং তার জাতি/কমিউনিটির) মনোবল ও সম্মান ভেঙ্গে দেয়া এবং আক্রান্তের ওপর ধর্ষকের নিয়ন্ত্রন আর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় ধর্ষক তার নিজের কমিউনিটি থেকে পুরস্কৃত হয়। যারা ধর্ষককে পুরস্কৃত করে না, তারাও ধর্ষকের আগ্রাসনের কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। কোন ধরণের জবাবদিহিতা কিংবা বিচারের মুখোমুখি হবার আশংকায় না থাকায় ধর্ষক সগর্বে, প্রকাশ্যে ধর্ষন করার লাইসেন্স পায়।

বাংলাদেশে এখন যা হচ্ছে, বিশেষ করে বেগমগঞ্জের ঘটনায় যা হয়েছে কিংবা ২০১৯ এর জানুয়ারি মাসে যা হয়েছিল সেটাকে পুরোপুরিভাবে আগ্রাসী বা দখলদার বাহিনীর ধর্ষনের সাথে তুলনা করা যায় না। কিন্তু এটাকে নিছক অপুরটুনিস্টিক ক্রাইম বলা যায় না। বেগমগঞ্জের ঘটনা এবং এরকম অন্য ঘটনাগুলো এ দুইয়ের মিশ্রণ। এখানে অবশ্যই যৌন আগ্রাসনের একটি দিক আছে, একই সাথে ধর্ষক যে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতার কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য এবং অপরিহার্য অংশ, এ বাস্তবতারও ভূমিকা আছে।

বাংলাদেশে ধর্ষক, ধর্ষিতার ঘর অবরোধ করে রাখতে পারে, কারণ সে জানে সহিংসতা চালানোর যে সক্ষমতা তার আছে, তার দল সেটার কদর করে। ধর্ষক জানে, দলগতভাবে সে ধরাছোয়ার বাইরে, নিরাপদ। মাঝেমধ্যে বেকায়দায় পড়ে এক-দুজনের বিচার হয়তো হবে, কিন্তু দলগতভাবে তাদের কোন বিচার হবে না। তাদের সহিংসতা চালানোর অনুমোদন কেড়ে নেয়া হবে না। তার সহিংসতা ছাড়া ক্ষমতা টিকবে না। ধর্ষিতাও জানে ধর্ষক আর আর যাদের কাছে বিচার চাওয়া হবে তারা একই দলের লোক, কাজেই সত্যিকার অর্থে বিচারের কোন আশা এখানে করা যায় না। আর ধর্ষক ও ধর্ষিতা দুজনেই জানে ক্ষমতার কাঠামো কার পক্ষে দাড়িয়ে আছে।

ধর্ষনের শাস্তি, সামাজিক মূল্যবোধ, পোশাক, পুরুষের মনোভাব – এ ব্যাপারগুলো গুরত্বপূর্ণ। এগুলো নিয়ে কথা বলা দরকার, কাজ হওয়া দরকার এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে এধরণের ধর্ষন এবং ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে এগুলো সেকেন্ডারি ইস্যু। যখন কারো বাসায় ঢুকে ধর্ষন করার পর ধর্ষক নিজে সেই বাসা অবরোধ করে রাখে, ধর্ষনের প্রমাণ নিজেই লক্ষ মানুষের সামনে ছেড়ে দেয়, তখন বিষয়টা আর পোশাকের কিংবা মূল্যবোধের থাকে না। এ ধর্ষনের মূল কারণ হল ঐ ক্ষমতার কেন্দ্র, যে ধর্ষককে দলগতভাবে সগর্বে, প্রকাশ্যে ধর্ষন করার লাইসেন্স দেয়। এ সত্যটা না বুঝে আবেগী কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল কথা বলে তেমন কোন লাভ নেই।