জাতীয়তাবাদ একটা বিপজ্জনক এবং বিষাক্ত ধারণা। মুসলিমদের যে অংশটা পরিপূর্ণভাবে ইসলাম মেনে চলার চেষ্টা করে, অনেক বছর ধরে এ কথাটা তারা বলে আসছে। বাংলাদেশ আজ যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে একটা নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের বাঙ্গালি জাতীয়বাদের বড় ধরণের ভূমিকা আছে, এটা অনস্বীকার্য। দেরিতে হলেও জাতীয়তাবাদের এই বিপদ সম্পর্কে বাংলাদেশের সেক্যুলারদের এক অংশ বুঝতে এবং বলতে শুরু করেছে। কিন্তু এ দুই বিরোধিতার মধ্যে পার্থক্য আছে।

মুসলিমরা জাতীয়তাবাদকে বাদ দিয়ে পরিপূর্ণভাবে ইসলাম গ্রহণের কথা বলে। কিন্তু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বলা সেক্যুলাররা জাতীয়তাবাদকে রিপ্লেইস করতে বলে একই ধরনের ফাঁপা এবং বিপজ্জনক অন্য একটা ধারণা দিয়ে। এই ধরণের সেক্যুলাররা; অর্থাৎ বাংলাদেশের ‘মডারেট সেক্যুলার’রা, জাতীয়তাবাদের বদলে জোর দিতে বলে নিজের আত্মপরিচয়, বিবেক, বিবেচনা, সভ্যতা, ভালো মানুষ হওয়া - ইত্যাদির ওপর। কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগে। ভালো লাগে দেখেই মানুষ আকৃষ্ট হয়, আর কথাগুলোর পেছনের আসল অর্থটা খতিয়ে দেখে না।

বিবেক-বিবেচনা, সভ্য হওয়া, ভালো মানুষ হওয়া – এই কথাগুলোর আসলে অর্থ কী? সমকামীতার ব্যাপারে আপনার বিবেক যা বলে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসরের বিবেক একই কথা বলে না, তাই না?

নারী অধিকারের ব্যাপারে বাইতুল মোকাররম এর খতীবের বিবেচনা আর নিউযিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনাও এক না। কার বিবেক সঠিক? কার বিবেচনা সঠিক?

একইভাবে সভ্যতারও আছে অনেক রকমের সংজ্ঞা, অনেক রকমের ব্যাখ্যা। আপনি কোন ধরণের সভ্য মানুষ হবেন? সভ্য মানুষ হবার আগে ‘সভ্যতা’-র একটা সংজ্ঞা, একটা মাপকাঠি দাড় করানো দরকার না?

আপনি কোন ধরণের ভালো মানুষ হবেন? ভালো মানুষ মানে কী? ভালো সুনাগরিক হওয়া? বিপ্লবী হওয়া? ছাপোষা গৃহী হওয়া? ভালো প্রেমিক হওয়া? বিসিএসে চ্যান্স পাওয়া? প্রশ্ন ফাঁস হবার পরও প্রশ্ন না দেখে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া? দানখয়রাত করা? ভালো ভোক্তা হওয়া? সমাজের প্রোডাক্টিভ মেম্বার হওয়া? মুক্তমনা হওয়া? মসজিদ কমিটির মেম্বার হওয়া? ডিগ্রি অর্জন করা? ভালো মানুষ আসলে কে? ভালো আসলে কোনটা? ভালোর সংজ্ঞা কী? ভালো মাপকাঠি কী?

বিবেক-বিবেচনা, ভালো মানুষ, সভ্যতা – এই শব্দগুলো আসলে খালি গ্লাসের মতো। এই গ্লাসে মদ রাখা যায়, মধুও রাখা যায়। নিজের মতো করে যে যার গ্লাস ভরে নেবে। এগুলো কিছু খোলস, কিছু মুখোশ যার আড়ালে নিজের বিশ্বাস (কিংবা ওয়ার্ল্ডভিউ) আর তার মানদণ্ডকে লুকিয়ে রেখে সেগুলোকে সর্বজনীন বলে প্রচার করা যায়।

মানুষ যখন বলে ‘ভালো মানুষ’ – তখন ভালোর একটা পূর্বনির্ধারিত সংজ্ঞা অনুযায়ী কথাটা বলে। ভালো কী – সেটার একটা উত্তর সে অলরেডি ঠিক করে রেখেছে। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষকে ‘ভালো’ বলা হয়, যারা কোন অর্থেই ভালো মুমিন না। কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে তাদের হয়তো বিশেষ দক্ষতা বা অর্জন আছে, কিন্তু ইসলামের মানদন্ডে তারা ভালো মানুষ না। অথচ সমাজের প্রচলিত মানদণ্ডে তারা ‘ভালো’। ভালোর সংজ্ঞা দুই রকম হচ্ছে কারণ মানদণ্ড দুটো আলাদা। একটার ভিত্তি ওয়াহি, অন্যটার ভিত্তি কালচার, সংস্কার, প্রথাপ্রচলন।

কথাটা সহজ করে বলি। ভালোমন্দের ধারণা সবসময় কোন না কোন বিশ্বাসের কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল। মানুষ যখন ‘ভালো’ বলে – তখন কোন একটা ফ্রেইম অফ রেফারেন্সের সাপেক্ষে ভালো বলে। তাই মূল ফোকাস হওয়া উচিৎ ঐ বিশ্বাসের কাঠামো।

মডারেট সেক্যুলাররা যখন সভ্যতা, ভালো মানুষ হওয়া কিংবা বিবেকবুদ্ধির কথা বলে, তখন আসলে কথাগুলো বলে লিবারেল সেক্যুলার ওয়ার্ল্ডভিউর জায়গা থেকে। কারণ এটাই আজকের কর্তৃত্বশালী ওয়ার্ল্ডভিউ।

এই কাঠামোর ভেতরে 'ভালো মানুষ' হবার একটা নির্দিষ্ট অর্থ আছে। এই ভালোমানুষ গ্লোবাল মাল্টি কালচারালিসমে বিশ্বাস করে। সে সেক্যুলার, সে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, সে মানবাধিকারকে পবিত্র কিছু মনে করে, সে ব্যক্তিস্বাধীনতার বিশ্বাসী ইত্যাদি। কোন জাতি, ধর্ম, কিংবা সীমান্তের মধ্যে সে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে না। সে কোন বৃহৎ সামষ্টিকতার অংশ না। সে একজন অ্যাটোমাইযড ইন্ডিভিযুয়াল। এই ভালোমানুষ একজন গ্লোবালাইসড কনসিউমার।

মুসলিমদের যে বিষয়টা বোঝা উচিৎ তা হল – মডারেট সেক্যুলার আর র‍্যাডিকাল সেক্যুলার – দু’জনই দিনশেষে সেক্যুলার। সে আপনাকে যেটা গেলাচ্ছে সেটা সেক্যুলারিসমই। বাংলাদেশের এক দল সেক্যুলার উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী আনন্দবাজারী সেক্যুলারিসম চায়। আরেকদল উগ্র শাহবাগী সেক্যুলারিসমকে এক ধরণের ক্লাসিকাল লিবারেলিসম দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চায়। কেউ শাহবাগী, কেউ ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী’, কিন্তু তারা যেই ব্যবস্থা চায় সেটা সেক্যুলার।

জাতীয়তাবাদসহ অন্যান্য মানবরচিত তন্ত্রমন্ত্রের যথাযথ খন্ডন এবং বিকল্প ইসলামে আছে। হ্যা তত্ত্বের কচকচি নেই, সোফিস্ট্রি নেই, আলগা ইন্টেলেকচুয়ালিসম কিন্তু শো-ম্যানশিপের ঢং নেই – কিন্তু বনী আদমের জীবনকে যথাযথভাবে চালিত করতে যা যা দরকার, তা সহজ এবং বোধগম্যভাবে ইসলামে আছে। আল্লাহকে চেনার পরও, তাওহিদ বোঝার পরও ইসলামের সমাধান ছেড়ে সেক্যুলারিসমের নানা অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো হল অন্তর ও আকলের রোগের ফলাফল।