মুক্তচিন্তা এবং বাকস্বাধীনতার যৌক্তিকতা বোঝানোর জন্য লিবারেল-সেক্যুলার ডিসকোর্সে ‘মার্কেটপ্লেইস অফ আইডিয়াস’ নামে একটা কনসেপ্ট ব্যবহার করা হয়। চিন্তার হাটবাজার। ধারণাটা অর্থনীতির ‘মুক্তবাজার’-এর কনসেপ্ট থেকে ধার করা।

মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুযায়ী–প্রত্যেক ক্রেতা ও বিক্রেতা যদি স্বাধীনভাবে নিজ স্বার্থ রক্ষায় সিদ্ধান্ত নেয়, সবাই যদি বাজারে অংশগ্রহণের সমান সু্যোগ পায় এবং সরকার যদি বাজারে কোন ধরণের হস্তক্ষেপ না করে–তাহলে দিন শেষে সাপ্লাই-ডিমান্ডের শক্তি বাজারকে সর্বোত্তম সাম্যাবস্থা বা একুলিব্রিয়ামে পৌছে দেবে। সহজ ভাষায়, সবাই স্বাধীনভাবে নিজের স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করতে পারলে আপনাআপনি বেস্ট আউটকাম আসবে।

মার্কেটপ্লেইস অফ আইডিয়াস-এই ধারণাটাকে পণ্য এবং সেবার বদলে চিন্তা এবং কথার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে। অর্থাৎ, সবাই স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করবে, যার যা ইচ্ছে বলবে, কোন ‘কথা’ বা ‘স্পিচ’-কে নিয়ন্ত্রন করা হবে না। চিন্তার হাটবাজারে বিভিন্ন বক্তব্য, ধারণা, মতাদর্শ, বিশ্বাস একে অপরের প্রতিযোগিতা করবে। দিনশেষে শ্রেষ্ঠ ধারণা বিজয়ী হবে। দুর্বল ধারণাগুলো বাজার থেকে হারিয়ে যাবে। ঠিক যেমন মুক্তবাজারের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পণ্য টিকে থাকে এবং সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক দাম প্রতিষ্ঠিত হয়।

মার্কেটপ্লেইস অফ আইডিয়াস-এর এই ধারণা আমি সঠিক মনে করি না। আমি বাকস্বাধীনতাতেও বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি সীমাহীন বাকস্বাধীনতা বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব আসলে নেই, এবং কিছু কিছু ‘স্পিচ’ নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিৎ। এমন মনে করার বিভিন্ন কারণ আছে। সেগুলো নিয়ে পড়ে কোন দিন আলোচনা করা যাবে। আগ্রহী পাঠক এ ব্যাপারে ড. স্ট্যানলি ফিশের আলোচনা দেখতে পারেন।

তবে আমি যা-ই মনে করি না কেন, লিবারেল-সেক্যুলাররা এই মার্কেটপ্লেইস বিশ্বাস করার কথা বলে। বঙ্গদেশীয় সেক্যুলাররা যখন ইসলামবিদ্বেষ, নবী (ﷺ)-এর অবমাননা, সমকামীতার প্রচারণা কিংবা ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণাচর্চার মতো বিষয়গুলোকে বৈধতা দিতে চায়, তখনই কিন্তু বাকস্বাধীনতা এবং মার্কেটপ্লেইস অফ আইডিয়াসের ধারণাকে ব্যবহার করে।

তাই এই সেক্যুলাররা যখন কোন নির্দিষ্ট ঘরানার বই, লেখক, বক্তব্য, বক্তা ইত্যাদি সেন্সর করতে চায় (তা যেকোন অজুহাতেই হোক না কেন), তখন বেশ মজার একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়। একদিকে তারা বাকস্বাধীনতার কথা বলে অন্যদিকে আরেকজনের গলা চেপে ধরতে চায়। একদিকে তারা বলে–সবাই মুক্তভাবে কথা বলতে পারলে সবচেয়ে শক্তিশালী আদর্শ ও ধারণা জয়ী হবে, তাই কথার ওপর কোন নিয়ন্ত্রন আরোপ করা উচিৎ না। অন্যদিকে তারাই আদর্শিক প্রতিপক্ষের কথা বন্ধ করে দিতে চায়। একদিকে মুক্তচিন্তা এবং নিজেদের আদর্শিক শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলে অন্যদিকে ‘আমাদের বই কেন বিক্রি হয় না’, এই অভিমানে ভিলেজ পলিটিক্স পর্যায়ের গুটিবাজি করে।

বঙ্গদেশীয় সেক্যুলারদের কথা ও কাজের এই সাংঘর্ষিকতা থেকে কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার হয়–.প্রথমত, বাংলাদেশের সেক্যুলাররা চিন্তার হাটবাজারে নিম্নমানের কিছু প্রডাক্ট নিয়ে আসে। মার্কেটে তাদের প্রডাক্টের ডিমান্ড নেই। মানুষ তাদের প্রডাক্ট পাত্তা দেয় না। তবু তারা চায় তাদের প্রডাক্টই কেনা হোক। প্রয়োজনে বাজার থেকে অন্যসব প্রডাক্ট সরিয়ে ফেলতে হবে, তবু তাদের প্রডাক্ট চালাতে হবে। যে কোন মূল্যে জমিদারি টিকিয়ে রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সেক্যুলাররা আসলে মুক্তচিন্তা এবং বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী না। তারা নিজেদের জন্য বাকস্বাধীনতা আর প্রতিপক্ষের জন্য সেন্সরশিপে বিশ্বাসী। তারা যখন বলে, ‘সবার জন্য বাকস্বাধীনতা’, তখন সেটার অর্থ হল, ‘আমাদের জন্য বাকস্বাধীনতা’। একইভাবে তাদের কাছে মুক্তচিন্তার অর্থ হল, তাদের বিশ্বাসগুলোকে অন্ধভাবে মেনে নেয়া। মুক্তচিন্তক হল এমন ব্যক্তি যে বাঙালি প্রগতিশীলতাকে বিনা প্রশ্নে অনুসরণ করে।

তৃতীয়ত এবং মোস্ট ইম্পরট্যান্টলি, লিবারেল সেক্যুলারিসম এটা একটা অসংলগ্ন ওয়ার্ল্ডভিউ। এর মধ্যে কোন ইন্টার্নাল কনসিস্টেন্সি নেই। লিবারেল সেক্যুলারিসম এক জায়গাতে যেসব দাবি করে, অন্যান্য জায়গাতে ক্রমাগত সেটার উল্টোটা করে। এই ওয়ার্ল্ডভিউর মূলনীতিগুলোর সাথে এর প্রয়োগের সামঞ্জস্য নেই। .বঙ্গীয় সেক্যুলারদের গোস্বা আর সেন্সরশিপের বাতিক নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। আপত্তিও নেই। ক্ষমতা থাকলে আমি নিজেও অনেক কিছু সেন্সর করতাম। তবে সেক্যুলারদের মিথ্যাচার এবং দ্বিমুখীতা নিয়ে আমার সমস্যা আছে। না। সেন্সর করলে করুন, সরাসরি স্বীকার করুন। কিন্তু ব্যবসা না হলে কিংবা আদর্শিকভাবে মার খেলে গুণ্ডামি করে প্রতিপক্ষের কন্ঠরোধ করবেন আবার একই সাথে বাকস্বাধীনতার চ্যাম্পিয়ন সাজবেন, এটা অন্য লেভেলের নির্লজ্জতা হয়ে যায়। অনেকটা বেশ্যার মুখে সতী সাধ্বী হবার দাবির মতো।