অর্থের দিক থেকে মডারেট শব্দটা একটা খালি গ্লাসের মতো। আকর্ষনীয় রঙ, কারুকাজ করা। দেখতে সুন্দর। কিন্তু আলটিমেটলি গ্লাসটা খালি। এই গ্লাস সবাই নিজের মতো করে ভরে নেয়। কেউ গ্লাসের মধ্যে মধু রাখে, কেউ রাখে মদ। তারপর নিজের বাছাই করা পানীয় ভর্তি গ্লাসটাকে সে ‘মডারেট’ হিসেবে উপস্থাপন করে। ‘মডারেট’ শব্দের অর্থ তখন নির্ভর করে গ্লাসে থাকা পানীয়ের ওপর।

লিবারেল-সেক্যুলার ডিসকোর্সের অনেকগুলো কনসেপ্টের মধ্যে এই ‘খালি গ্লাস’ বৈশিষ্ট্য আছে। ইচ্ছেমতো যেকোন কিছু এই গ্লাসগুলোতে ঢেলে নেয়া যায়।

বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে বলা যায়, ইসলামে বাকস্বাধীনতার শিক্ষা আছে, কারণ ইসলামে যালিম শাসকের বিরুদ্ধে হক্ব কথা বলতে বলা হয়েছে। আবার বাকস্বাধীনতার কথা বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অবমাননাকেও সমর্থন করা যায়। কিন্তু নিঃসন্দেহে ইসলাম সেটা সমর্থন করে না।

একইভাবে বলা যায়, ইসলাম সাম্যের শিক্ষা দেয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন তাঁর কন্যা ফাতিমাও (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) যদি চুরি করেন তাহলে তাঁকেও শরীয়াহ নির্ধারিত শাস্তি পেতে হবে। কোন ব্যতিক্রম হবে না। আবার সাম্যের নামে বলা যায় সাধারণ নরনারীদের মতো সমকামীদেরও ‘বিয়ে’র অধিকার থাকা উচিৎ। সাম্যের এই ধারণা ইসলাম সমর্থন করে না।

কেউ বলতে পারে ইসলামে অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার শিক্ষা আছে। ইসলামী শাসনের অধীনে অনেক শতাব্দী ধরে আহলুল কিতাবরা যিজয়া দিয়ে নিরাপদে থেকেছে। কিন্তু ধর্মীয় স্বাধীনতার জায়গা থেকে যদি বলা কাদিয়ানিরা নিজেদের মুসলিম দাবি করলে সেই দাবি মেনে নিতে হবে, তাদের বিশ্বাসকে সম্মান করতে হবে- তাহলে সেটা ইসলামী শরীয়াহ সমর্থন করে না।

তার মানে হল স্বাধীনতা, সাম্য, সহিষ্ণুতা-এই শব্দগুলো একেকটা খালি গ্লাস। গ্লাসগুলো দেখতে সুন্দর। গ্লাসগুলো দেখলে আমাদের মধ্যে ইতিবাচক অনুভূতি হয়। কিন্তু গ্লাসগুলো খালি। এগুলোর সুনির্দিষ্ট কোন অর্থ নেই। শব্দগুলো উচ্চারণ করার সময় মানুষ এগুলোর মধ্যে নিজের মতো করে একটা অর্থ বসিয়ে নেয়। এবং প্রত্যেক মানুষ এই অর্থটা বসায় নিজের ওয়ার্ল্ডভিউ বা প্যারাডাইম অনুসারে। নিজের চিন্তা, দর্শন আর বিশ্বাসের সাপেক্ষে। তাই এধরণের বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা করতে হলে, গ্লাসের মধ্যে আমি ঠিক কী ঢালছি সেটা নির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট করা জরুরী। তা না হলে একই শব্দ ব্যবহার হলেও আলোচনা হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস নিয়ে।

মডারেট বা মধ্যপন্থা শব্দটাও এমন। একেকজনের কাছে ‘মডারেইশান’-এর অর্থ একেক রকম। মডারেট শব্দটার অর্থ সব সময় কনটেক্সট-স্পেসিফিক। কনটেক্সট থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে এই শব্দের স্বতন্ত্রভাবে কার্যকরী কোন অর্থ নেই। তখন ওটা শুধু একটা খালি গ্লাস।

মধ্যম অবস্থান সবসময় আপার এবং লোয়ার লিমিটের ওপর নির্ভর করবে। আমি যদি বলি ১ থেকে ১০০-এর ভেতরে মধ্যম রেইঞ্জের একটা সংখ্যা বলুন, তাহলে উত্তর হিসেবে ৫০ কিংবা ৫৫ সঠিক। কিন্তু আমি যদি বলি ১ থেকে ১০০০ এর ভেতর মধ্যম রেইঞ্জের একটা সংখ্যা বলুন, তাহলে উত্তর হিসেবে ৫০ সঠিক হবে না। কাজেই ‘মধ্যমপন্থা’ কোনটা, সেটা জানার জন্য আমাকে প্রথমে রেইঞ্জটা জানতে হবে। এটাই হল কনটেক্সট।

ইসলাম মধ্যমপন্থী দ্বীন। দ্বীন ইসলাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে পালন করতে শিখিয়েছেন, যেভাবে সালাফুস সালিহিন তা পালন করেছেন, সেটা অনুসরণ করা আমাদের দায়িত্ব। কেউ যদি এটা করে তাহলে সে সঠিক অবস্থানে আছে। এমন মুসলিমকে 'মডারেট মুসলিম' বা 'মধ্যমপন্থী মুসলিম' বলা হবে না। তাকে মুসলিম বলা হবে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর অনুসারী বলা হবে-এটাই ইসলামের প্যারাডাইমের ভেতরে মধ্যপন্থা। প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল।

কিন্তু ‘মডারেট মুসলিম’ কিংবা ‘মডারেট ইসলাম’, ইসলামী শরীয়াহ কিংবা মুসলিম ঐতিহ্য থেকে আসা কোন শব্দ না। এই কনসেপ্টটাও আমাদের না। এই কনসেপ্টের স্রষ্টা কলোনিয়াল আগ্রাসনকারী এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো তাদের লিবারেল ক্রুসেইডার উত্তরসূরীরা। তাদেরকে ‘মডারেট’ ইসলাম এর ধারণা তৈরি করতে হয়েছে কারণ ইসলামের কিছু অংশকে তারা ‘এক্সট্রিমিসম’, ‘র‍্যাডিকালিসম’, ‘টেরোরিসম’-ইত্যাদি নাম দিয়ে বাদ দিতে চায়।

আদি ও অকৃত্রিম ইসলাম বরাবরই আগ্রাসী ক্রুসেইডার-যায়োনিস্ট এবং তাদের পূর্বপুরুষদের জন্য মাথাব্যাথার কারণ ছিল। এই দ্বীনের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে বারবার মুসলিমরা তাদেরকে পরাজিত করেছে। তারা জানে মুসলিম বিশ্বের তাদের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এ আদর্শকে মুছে ফেলতে হবে।

সমস্যা হল মুসলিমদেরকে একেবারে ইসলাম থেকে বের করে আনা সম্ভব না। তাই তারা চায় প্রকৃত ইসলামকে খন্ডিত করে ইসলামের একটা গৃহপালিত সংস্করণ তৈরি করতে। তাই প্রথমে আদি ও অকৃত্রিমকে ইসলামকে তারা ‘র‍্যাডিকাল ইসলাম’ নাম দেয়। এই আদর্শের অনুসারীদের বলা হবে এক্সট্রিমিস্ট বা র‍্যাডিকাল মুসলিম। এই ইসলাম অক্ষরবাদী, এই ইসলাম উগ্র, এই ইসলাম বর্বর। কারণ এই ইসলাম লিবারেল-সেক্যুলার প্যারাডাইমকে স্বীকার করে না। এই ইসলাম লিবারেল ক্রুসেইডারদের বেঁধে দেয়ার সীমার মধ্যে থাকতে রাজি না। এই ইসলাম যুগে যুগে মুসলিমদের অত্যাচার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে, এবং বিদ্যমানতাকে পরিবর্তন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

তারপর ‘র‍্যাডিকাল ইসলাম’-এর প্রতিতত্ত্ব হিসেবে দাড় করানো হয়েছে ‘মডারেট ইসলাম’-কে। এখানে মডারেট শব্দের অর্থে এসেছে অর্থ পশ্চিমা আগ্রাসনকারীর অবস্থান থেকে। এটা হল এমন ‘ইসলাম’ যা লিবারেল মতবাদগুলোকে গ্রহণ করে সেটার ওপর হিজাব পরাবে।

যে ‘ইসলাম’ আগ্রাসী পশ্চিমকে শত্রুর বদলে শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে দেখবে।

যে ‘ইসলাম’ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে শরীয়াহ অনুযায়ী চালিত করার বদলে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের ইচ্ছে অনুযায়ী শরীয়াহকে চালাবে।

যে ‘ইসলাম’ স্ট্যাটাস কৌ-কে বদলাবে না, বরং জানপ্রাণ দিয়ে স্ট্যাটাস কৌ-কে টিকিয়ে রাখতে চাইবে।

যে ‘ইসলাম’ বিদ্রোহী তৈরি না করে গাদ্দার তৈরি করবে।

সহজ ভাষায় ‘মডারেট ইসলাম’ হল শত্রুর স্বার্থরক্ষায়, শত্রুর পছন্দ অনুযায়ী, শত্রুর নির্দেশনায় তৈরি করা ‘অনুমোদিত ইসলাম’।

যে মুসলিম মার্কিন সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে গালে ক্লোসলি ট্রিমড দাড়ি নিয়ে ইরাক কিংবা আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যায় সে মডারেট মুসলিম।

যে মুসলিম অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সে র‍্যাডিকাল।

যে মুসলিম লিবারেল-সেক্যুলার অবস্থানের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে ফিকহী মত বের করে, সে মডারেট, মুজাদ্দিদ, ভিশনারী।

যে মুসলিম ঐ অবস্থান গ্রহণ করে যা দালীলিকভাবে শক্তিশালী এবং সালাফুস সালিহিনের অধিকাংশের কাজের সাথে সংগতিপূর্ণ সে অক্ষরবাদী, পিছিয়ে পড়া, মোল্লা।

এই বাস্তবতাটুকু আমরা সবাই জানি। আমরা সবাই এটা উপলব্ধি করি। যদিও আমরা হয়তো অনেক সময় এটা গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারি না।

সহজ উদাহরণ দেই।

ধরুন ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে দু’জন মুসলিম কথা বলছে।

একজন বললো-ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য আমাদের পশ্চিমা বিশ্বে আরো লবিয়িং করতে হবে। পশ্চিমা লেফটিস্টদের সাথে ঐক্য করতে হবে।

আরেকজন বললো-সশস্ত্র পন্থা ছাড়া ফিলিস্তিন সমস্যার কোন সমাধান নেই। এবং এই সশস্ত্র সংগ্রামের ভিত্তি হতে হবে তাওহিদ এবং এর উদ্দেশ্য হতে হবে আগ্রাসী শত্রুকে পরাজিত করে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা।

এই দু’জনের মধ্যে কাকে র‍্যাডিকাল বলা হবে? আর কাকে মডারেট বলা হবে?

ধরুন, নারী অধিকার নিয়ে কথা হচ্ছে।

একজন বললো, পুরুষের যা যা অধিকার আছে তার সবকিছুই নারীর আছে। বর্তমানে নারীদের উচিৎ ঘরের বাইরে বের হয়ে এসে অর্থনীতিতে অংশ নেয়া, উম্মাহর উত্তরণে ভূমিকা রাখা।

আরেকজন বললো, নারীদের জন্য ডিফল্ট অবস্থান ঘরের ভেতরে। শরীয়াহতে তার মূল ভূমিকা এখানেই ঠিক করা হয়েছে।

এই দু’জনের মধ্যে কার অবস্থানকে র‍্যাডিকাল বলার সম্ভাবনা বেশি? আর কাকে মডারেট বলার সম্ভাবনা বেশি?

প্রশ্নগুলো পড়া মাত্র অটোম্যাটিকালি আপনার মাথায় উত্তর চলে এসেছে। কারণ মডারেট এবং র‍্যাডিকালের এই শ্রেনীবিভাগ কমসেকম দুই দশক ধরে আমাদের মাথায় ড্রিল করে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।

আজকের পৃথিবীতে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রশ্নে যখন মডারেট কিংবা র‍্যাডিকাল শব্দগুলো ব্যবহার হয় তখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে অনুমোদিত এবং অবৈধ ইসলামের যে ধারণা সেটার অংশ হিসেবেই শব্দগুলো আসে।

কোন মুসলিম স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেকে মডারেট কিংবা র‍্যাডিকাল বলে না। কেউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলে না ‘আই অ্যাম এ মুসলিম, অ্যান্ড আম নট এ টেরোরিস্ট’।

এই কথাগুলো আসে প্রতিক্রিয়া হিসেবে কারণ অলরেডি র‍্যাডিকাল হিসেবে কিংবা টেরোরিস্ট হিসেবে মুসলিমকে চিত্রিত করা হয়েছে। যখন ইসলামী চরমপন্থার কথা বলা হয়, তখন অলরেডি ইসলামী চরমপন্থার একটা সংজ্ঞা দাড় করিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এই সংজ্ঞা ইসলামী শরীয়াহর আলোকে তৈরি হয়নি। এই সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে পেন্টাগনের নির্দেশে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের মধ্যে অনেক বক্তা, লেখক, রাজনৈতিক দল, দা’ঈ, বুঝে না বুঝে এই বিভাজন গ্রহণ করেছেন এবং সেটাকে রিইনফোর্স করেছে।

যে ব্যক্তি এই বাস্তবতাগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতে রাজি না, অথবা যে এই বাস্তবতাগুলো স্বীকার করে না, সে আসলে এ বিষয়ে কোন ধরণের অর্থবহ আলোচনায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা রাখে না।