ব্যাংকিং-ব্যবস্থার ব্যাপারে মাওলানা তাকী উসমানী এবং একই মতের অন্যান্য আলিমদের আপত্তির দিকটি স্পষ্ট করা দরকার। তাঁদের মতে বর্তমান ব্যাংকিং-ব্যবস্থা ইসলামী না হওয়ার কারণ হলো এর শাখাগত দিকগুলো শরয়ী চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। অর্থাৎ আপত্তি ব্যাংকিং-ব্যবস্থার উদ্দেশ্য নিয়ে না। তাঁরা বলছেন না যে ব্যাংকিং-ব্যবস্থা যেসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছে, সেগুলো অনৈসলামী; বরং তাঁদের আপত্তির কারণ হলো এর কার্যক্রম শরীয়াহর নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না। মোদ্দাকথা হলো, তাদের গবেষণা পুরো ব্যবস্থা নিয়ে না; বরং তাঁদের বিশ্লেষণের আলোচ্য বিষয় হলো ব্যাংকের শাখাগত কার্যক্রম। যে কারণে তাঁরা উপসংহার দিচ্ছেন যে ব্যাংকিং-ব্যবস্থা শিরকাত, মুদারবাসহ শরীয়তের অন্যান্য নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হলে এ নিয়ে ইসলামের অবস্থান থেকে আর কোনো আপত্তি থাকবে না।
বাস্তবতা হলো ব্যাংকিং-ব্যবস্থার কার্যক্রম শরীয়াহর নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হলেও এটি ইসলামী হবে না। কারণ, এই ব্যবস্থা যেসব উদ্দেশ্য অর্জনের পথ খুলে দেয় (যেমন বস্তুবাদী মানসিকতা, ভোগ ও মুনাফা সর্বোচ্চকরণের মানসিকতা) সেগুলো শতভাগ অনৈসলামী। পুঁজিবাদের মূল সমস্যা তার পদ্ধতি না। পুঁজিবাদ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে যেসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যায়, সেগুলোতেই সমস্যা। সেগুলোই নিকৃষ্ট এবং জাহালাত। আর এই নিকৃষ্ট বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেলে বস্তুগত উন্নতি হতে পারে এ কথা সত্য, তবে এভাবে জীবনযাপনকারী প্রত্যেকে নিজের জন্য জাহান্নামের পথকে সহজ করে তুলবে। পুরো ব্যবস্থার ওপর মনোযোগ না দিয়ে শুধু শাখাগত বিষয়গুলোর দিকে তাকিয়ে ফতোয়া দেয়া একটি মারাত্মক ভ্রান্তি। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
এমন কোনো জীবনব্যবস্থার কথা কল্পনা করুন, যেখানে অশ্লীলতা, পাপাচার ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। গুনাহের ব্যাপারে মানুষের অপরাধবোধ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যার ফলে ওই সমাজে বিয়ের বদলে যিনাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় আইন পর্যন্ত বিয়েকে কঠিন আর যিনাকে সহজ বানিয়ে ফেলেছে ( এটা বর্তমানে অনেক সমাজের বাস্তবতা)। এমন পরিস্থিতিতে একজন তাহাজ্জুদগুজার বান্দার জন্যও কিন্তু নিজ সন্তানদের গুনাহ থেকে বাচিয়ে রাখা, এমনকি নিজেকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখাও অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। যার ফলাফল হলো এই পরিসংখ্যান। পশ্চিমা সমাজে শতকরা ৭0-৮০ জনের চেয়েও বেশি মানুষ কিশোর বয়সেই কমপক্ষে একবার যিনায় লিপ্ত হয় । কিছু কিছু রাষ্ট্রে তো শতকরা পঞ্চাশ জনেরও বেশি শিশুর জন্ম হচ্ছে জারজ হিসাবে । এখন চিন্তা করুন, কোনো আল্লাহভীরু, তাহাজ্জুদগুজার আলিম মুসলিমদের এসব গুনাহ থেকে বাঁচাতে চাইলেন। তিনি সমস্যার ব্যাপকতা ও প্রয়োজনকে দলিল সাব্যস্ত করে ‘ইসলামী’ পতিতালয় নির্মাণ করলেন। এই পাপাচারের সাথে যুক্ত অনেক মহিলাকে সেখানে আনলেন। তারপর নিম্নোক্ত শরয়ী নীতিমালা অনুযায়ী পতিতালয়ের কার্যক্রম শুরু করে দিলেন।
• শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া নারী-পুরুষের মেলামেশার সুযোগ দেয়া হবে না।
• দৈহিক মিলনের আগে বিয়ের সব ধাপ, কার্যক্রম ও মোহরের পরিমাণ ঠিক করে নেয়া হবে।
• বিয়ের জন্য ‘শরয়ী কাযী ও সাক্ষীর’ ব্যবস্থা থাকবে।
• দৈহিক মিলনের পর স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিয়ে মোহর আদায় করে নেবে।
• যেহেতু শরীয়াহর নিয়ম অনুযায়ী নারীদের তালাকের পর দ্বিতীয় বিয়ের আগে ইদ্দতের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, তাই এ ক্ষেত্রে গ্বামিদি সাহেবের ফতোয়ার ওপর আমল করা হবে। অর্থাৎ মেডিকেল টেস্টের মাধ্যমে গর্ভে বাচ্চা না আসার ব্যাপারটি প্রমাণিত হলেই ইদ্দত শেষ হয়ে যাবে। দরকার হলে এর জন্য উন্নতমানের ল্যাবরেটরিও বানিয়ে নেয়া হবে।
ভেবে দেখুন, ‘ইসলামী’ পতিতালয় বানানোর জন্য শরয়ী নীতিমালার প্রতি কী পরিমাণ লক্ষ রাখা হয়েছে! এখন গ্রামে গ্রামে এই ‘ইসলামী’ পতিতালয় বানানো শুরু হলো। তারপর পুরো পরিকল্পনা আপনার সামনে তুলে ধরে কেউ একজন প্রশ্ন করল, বলুন তো এর মাঝে খারাপ কী আছে? আপনি পুরো বিষয় মাথায় না রেখে ‘ভালোর গ্রহণ মন্দের বর্জন’ এর নীতি অবলম্বন করলেন, আর কেবল শাখাগত দিকের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলে দিলেন, ‘মিয়া এখানে ইদ্দত পালনের পন্থা হানাফী ফিকহ অনুযায়ী হয়নি।’ কিংবা বললেন ‘বিয়ের জন্য যেসব সাক্ষী নির্ধারণ করা হয়েছে তাদের আদালত তথা ন্যায়পরায়ণতার গুণ নেই’ ইত্যাদি। এখন এ ধরনের ইজতিহাদের ব্যাপারে আর আপত্তির ব্যাপারে কী বলা যেতে পারে?
অন্য কোনো ফিকহের ভিত্তিতে ইদ্দত পালনের পন্থাকে সঠিক করে নিলেই কি এটি ‘ইসলামী’ পতিতালয় হয়ে যাবে?
অধ্যায় - মাওলানা তাকী উসমানী ও ইসলামী অর্থনীতি
বই - ইসলামী ব্যাংক:ভুল প্রশ্নের ভুল উত্তর