আমাদের সমাজের মানুষের ইসলাম সম্পর্কে ধারণা কম। বিশেষ করে যাদের ‘শিক্ষিত’ ধরা হয় তাদের মধ্যে। একে তো তারা জানে না, তার ওপর তারা মনে করে তারাই সবকিছু সবচেয়ে ভালো জানে। এমন মানুষকে কোন কিছু বোঝানো বেশ কঠিন। নিজেকে বিদ্বান মনে করা মূর্খ উলটে রাখা গ্লাসের মতো। জগের পর জগ পানি ঢাললেও এক ফোটাও ভেতর পৌছায় না।

অনেকে বলেন যে এই শ্রেনীকে ইসলামের দিকে আহবান করার সময় ইসলামী শাসন আসলে জীবন আরো কতো উন্নত হবে, সেই পয়েন্ট ফোকাস করা উচিত। যেমন কোন এমপি, ব্যাংকের বড় অফিসার, কিংবা উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীকে ইসলামী শাসনের প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর সময় আমরা তাদেরকে এটা বোঝাতে পারি যে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে জীবন কতোটা সুন্দর হবে।

এ ধরনের অ্যাপ্রোচের ব্যাপারে আমার কিছু আপত্তি আছে। প্রথম ও মূল আপত্তি হল, এই ধরনের অ্যাপ্রোচে মানুষকে একটা আইডিয়াল, অলমোস্ট ইউটোপিক ছবি দেখানো হয়। বর্তমানে আমার যে লাইফস্টাইল আছে ইসলামী শাসন আসলে তা আরো উন্নত হবে – এই কথাটাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এক বিচারে কথা সত্য। যদি আপনি ভালোমন্দকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সংজ্ঞায়িত করেন তাহলে অবশ্যই কুফরের শাসনের চাইতে ইসলামী শাসন উত্তম। কিন্তু যদি আপনি প্লেযার প্রিন্সিপাল বা ইউটিলিটারিয়ান প্রিন্সিপালের আলোতে বিচার করেন, যদি আপনি দুনিয়াবী সুযোগসুবিধার আলোতে বিচার করেন তাহলে কথাটা নেসেসারিলি সঠিক না।

খুব সহজ উদাহরন দিয়ে বুঝাই। উদাহরনটা ব্যাংক নিয়ে।
অনেকেই নিশ্চয় জানেন বেশ কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশী ব্যাংকগুলো ম্যারেজ লোন (বিবাহ লোন) এর সুবিধা দিচ্ছে। আসুন এধরনের লোন সমাজে ব্যাপক হয়ে গেলে সেটার প্রভাব কী কী হতে পারে তা নিয়ে অল্প একটু চিন্তা করা যাক।

প্রথমত এই লোন যে বিয়ে করছে তার (ও তার পরিবারের) খরচের সিদ্ধান্ত ও মাত্রাকে প্রভাবিত করবে। আগে যেসব পরিবার বিয়ের সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানের পেছনে যদি ৫ লাখ টাকা খরচ করতো এখন তারা আরো ৩-১০ লাখ টাকা বেশি করতে পারছে। এটার রেযাল্ট কী? হয়তো তারা পোশাকআশাকের দিকে খরচ কিছুটা বাড়িয়ে দেবে। হয়তো বিয়ের ফুল ও ফুলসংক্রান্ত সাজসজ্জার পেছনে খরচ ডাবল হবে। হয়তো এখন আরো জাকজমকপূর্ণ স্টেইজ বানানো হবে, গয়না বেশি দেয়া হবে, একটা অনুষ্ঠান বেশি করা হবে, ওয়েডিং ফটোগ্রাফার, ডিজে, হালদী নাইটস টাইপ জিনিষের জন্য বাজেট বাড়বে, ইত্যাদি। মোদ্দা কথা, বিয়ে উপলক্ষে পরিবারগুলোর খরচে একটা সিগনিফিক্যান্ট বৃদ্ধি আসবে।

আচ্ছা এখন বলুন তো এই বাড়তি খরচগুলোর প্রভাব কী? যারা বিয়ে সংক্রান্ত বিভিন্ন সার্ভিস দেয় তাদের ডিমান্ড বাড়বে না? আগে যে মাসে ১০০ কেজি ফুল বিক্রি করতো এখন সে হয়তও ৩০০ কেজি বিক্রি করবে। একইভাবে শাড়ি-শেরওয়ানি থেকে শুরু করে স্টেইজ বানানো, ফোটোগ্রাফার, ডিজে সবকিছুর চাহিদা বাড়বে। এই ইন্ডাস্ট্রিগুলো ‘বুম’ করতে শুরু করবে। আরো মানুষ এই ধরনের সার্ভিসগুলোতে ঢুকবে, কারন এর ভালো চাহিদা আছে। হয়তো ওয়েডিং প্ল্যানিং সংক্রান্ত আলাদা একটা ব্যবসাই গড়ে উঠবে। এই ধরনের কাজ করা লোকদের ইনকাম বাড়বে। আয় বাড়ার কারনে তাদের পরিবারগুলোর জীবনযাত্রা মানে অগ্রগতি আসবে। আর জীবনযাত্রা মানে অগ্রগতি আসার মানে তারা এখন বিভিন্ন পন্য ও সার্ভিসের জন্য আগের চাইতে বেশি খরচ করবে। এভাবে তাদের খরচ করার সামর্থ্য ও সদিচ্ছা বাড়ার একটা প্রভাবে বাজারে পড়বে।

অর্থাৎ ম্যারেজ লোন যদি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে যায় তাহলে সেটার প্রভাব বহুমুখী। এটা শুধু বর-কনের পরিবারকে ইফেক্ট করে না বরং এটার একটা রিপল ইফেক্ট আছে। পুকুরের ঢেউয়ের মতো বিভিন্ন মাত্রায় সমাজে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যুযুগে ঋন এবং সুদ, দুটোর ব্যাপারেই ইউরোপের মানুষের দৃষ্টীভঙ্গি ছিল নেতিবাচক। একেবারে বাধ্য না হলে কেউ ঋন নিতো না। আর ঋন নেয়াও হতো বিপদআপদ, কোন প্রয়োজন বা বিল মেটানোর জন্য। ঋন নিয়ে ব্যবসা-বিনিয়োগ করা তাদের কাছে অপছন্দীয় ছিল। ঋন ও সুদের ব্যাপারের এতো নেগেটিভ ধারনা সত্ত্বেও তারা এটুকু স্বীকার করতো যে এর একটা বেনিফিট আছে সেটা হল সুদী ঋণের দ্বারা consumption/ভোগ বাড়ানো যায়, সাময়িকভাবে হলেও। যেমন আমাদের উদাহরনে, ব্যাংক লোনের কারনে বিয়ের বাজেট বাড়ানো যায়। আর এটাই হল পয়েন্ট।

আমরা বর্তমানে এমন একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আছি যেটা সম্পূর্ণভাবে ঋণভিত্তিক (Debt-based)। এই ব্যবস্থায় অর্থ (অর্থাৎ টাকা/কারেন্সি) তৈরি করা হয় ঋণ হিসেবে। বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো যখন ঋণ দেয় তখন তারা আক্ষরিকভাবেই নতুন টাকা তৈরি করে। যেই ম্যাজিক বা পদ্ধতির মাধ্যমে এভাবে শূণ্য থেকে টাকা তৈরি করা যায় সেটাকে বলা হয় ফ্র্যাকশানাল রিযার্ভ ব্যাংকিং (Fractional Reserve Banking)। সহজ ভাষায় ফ্র্যাকশানাল রিযার্ভ ব্যাংকিং মোট সম্পদের চেয়ে বেশি কারেন্সি বা কাগুজে মুদ্রা এবং ঋণ তৈরি করতে পারে। যার কারনে যে সম্পদ নেই আমরা সেটা খরচ করতে পারি। ব্যাপারটা অনেকটা মনোপলি খেলার টাকার মতো।

এই ব্যাপারটা বেশ জটিল এবং প্রথমবার শোনার সময় অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কথাগুলো যে সত্য তার প্রমান হিসেবে আমি ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের লিঙ্ক দিচ্ছি [১]। তবে অল্প পরিসরে এই জটিল প্রক্রিয়াকে সহজে বোঝানোর কোন উপায় আমার জানা নেই। তবে আপাতত আমাদের আলোচনার জন্য নিচের কয়েকটি পয়েন্ট মাথায় রাখলেই চলবে।

আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিটি লোন দেয়ার সময় নতুন টাকা তৈরি করে।

ব্যাংকগুলো এই কাজটি করে ফ্র্যাকশানাল রিযার্ভ ব্যাংকিং নামের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

বর্তমানে আমরা যেই টাকা বা কারেন্সি ব্যবহার করি সেগুলো হল ফিয়াট মানি (Fiat Money)। অর্থাৎ এই কাগুজে মুদ্রার বিপরীতে কোন সত্যিকারের সম্পদ (সোনা, রূপা, তামা, চাল, গম কোন কিছুই না) জমা নেই।

ব্যাংকিং ব্যবস্থার তৈরি করা ক্রৃত্রিম অর্থ যেহেতু পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়ে তাই সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ভোগ (consumption) বাড়ানো যায়, সাময়িকভাবে হলেও। কাজেই বাংলাদেশসহ বর্তমান পৃথিবীতে কিছু দিক দিয়ে বিশাল সংখ্যক মানুষ জীবনযাত্রার মানের যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন উপভোগ করছে সেটার পেছনে বড় একটা ফ্যাক্টর হল এই কৃত্রিম টাকা। কিভাবে?

ওপরের ম্যারেজ লোনের উদাহরনটা আবার পড়ুন। দেখুন কিভাবে অর্থনীতিতে লোন ইনজেকশান বিভিন্নভাবে মানুষের খরচ করার সামর্থ্য ও জীবনযাত্রার মান বাড়ায়। কাজেই আপনার হাতের ফোনটা আসলে এক অর্থে সুদ অর্থভিত্তিক অর্থব্যবস্থা, ফ্র্যাকশানাল রিযার্ভ ব্যাংকিং এর কৃত্রিম টাকা তৈরি আর আধুনিক টেকনোলজিকাল উন্নয়নের অবদান। এটা আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির দেয়া না।

আচ্ছা এসবের সাথে মূল আলোচনার সম্পর্ক কী? ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করার দরকার – এই জিনিসটা বোঝাতে গিয়ে আপনি কাউকে বললেন ‘ইসলাম আসলে আমাদের সবার জীবনযাত্রার মান আরো উন্নত হবে, অর্থনীতির আরো উন্নতি হবে’, এতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হল ইসলামী শাসনের অধীনে ফ্র্যাকশানাল রিযার্ভ ব্যাংকিং এবং কৃত্রিম টাকা বানানোর এই প্রক্রিয়া চালু রাখা সম্ভব না। যার অর্থ এক দিকে সুদ ভিত্তিক ঋণ ও এর মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া এবং অন্যদিকে কৃত্রিম টাকার কারনে সৃষ্ট হওয়া চাহিদাগুলো নিঃশেষিত হওয়া।

ধরুন ১০ বছর ব্যাপকভাবে ম্যারেজ লোন দেয়া হল। তারপর ম্যারেজ লোন বন্ধ করে দেয়া হল। নিশ্চয় বর-কনের পরিবার সহ বিয়ের সাথে জড়িত সব সার্ভিস প্রোভাইডারদের ওপর এর প্রভাব পড়বে, তাই না? এখন এই প্রভাবটার আরো হাজার গুন বড় রূপটা চিন্তা করুন। আপনি যখন প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা বন্ধ করার কথা বলছেন তখন আসলে এই মাত্রার একটা পরিবর্তনের কথা বলছেন।

মূল পয়েন্টটা হল, আপনি যখন টাকা ও লোন বানানোর এই সিস্টেম বন্ধ করে দেবেন তখন দুনিয়াবি বিচারে সেটার প্রভাবটা ইতিবাচক হবে না, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে। কাজেই ইসলামী শাসন আসলেই যে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে (যে অর্থে পশ্চিমারা বুঝিয়ে থাকে) এমন না। বরং উল্টোটা হওয়াই স্বাভাবিক।

সুতরাং ইসলাম আসলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে – এমন কথা বলা ভুল এবং অ্যাপ্রোচটা ভুল। কারন আপনি যাকে দাওয়াহ করছেন তাকে বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক ছবি দিচ্ছেন না। ইসলামী শাসন আসলে শান্তি আসবে, কল্যান আসবে, উন্নতি আসবে। হ্যা, আসবে। তবে ইমিডিয়েটলি চলে আসবে না প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হবে। আর সেই উন্নতি, শান্তি ও কল্যানের সংজ্ঞাও আধুনিক পশ্চিমের সংজ্ঞার সাথে হুবহু মিলবে না।

দেখুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের পর বিভিন্ন পুরস্কার দিয়ে কুরাইশের অনেক সম্ভ্রান্ত লোককে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করেছিলেন। পরে এদের অনেকেই ইসলামী শাসন ও মুসলিমদের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এসবই সত্য। কিন্তু ইসলামের বিজয় এই মানুষদের হাতে হয়নি। আল্লাহ এই দ্বীনের বিজয় দিয়েছেন বাইয়াতুল আক্বাবার দিনের মানুষগুলোর মাধ্যমে। যারা প্রশ্ন করেছিলেন – আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্ষার জন্য এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য প্রয়োজনের পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। আমরা রাসূলুল্লাহকে নিজেদের জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করবো। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কী পাবো?

উত্তরে তাঁদের কী বলা হয়েছিল? জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন? অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি? জ্ঞানবিজ্ঞান ও টেকনোলজিকাল উন্নয়ন? রাজত্ব? না। বিনিময় হল, জান্নাহ।
যথেষ্ট।

এই বিনিময়ে তাঁরা সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন এটা একটা উত্তম সওদা – আল্লাহ তাঁদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তাঁরা আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট। আর যারা আজও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাঁদেরকেও এ বিনিময়েই সন্তুষ্ট হতে হবে। আর বিজয় যখন আসবে বিইযনিল্লাহ ‘আয্যা ওয়া জাল, তখন আপনার জনেজনে ইসলামী অর্থনৈতিক সিস্টেম বোঝাতে হবে না। ঐ ব্যাংকার, এমপি কিংবা জেনারেল নিজে থেকেই ইসলামে প্রবেশ করবে। কারন সে দুনিয়াকেই চিনেছে তার জন্য সবচেয়ে বড় দাওয়াহ হল দুনিয়াবি বিজয় ও ক্ষমতা। কিতাব দেখিয়ে যাকে বোঝানো যায় না তাকে সিলাহ দেখালেই বুঝবে।


১। Money Creation In The Modern Economy (Bank Of England Quaterly Bulletin, 2014 Q1)