তিন বছর আগের কথা। তাড়াহুড়ো করে গরম চা-টা শেষ করতে গিয়ে জিভ পুড়ে গেল। আয়নায় চোখে পড়লো জিভের ওপরে মুখের তালুতে ছোট্ট একটা দাগ। কী মনে করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া… চেকআপ করিয়ে নিতে তো দোষ নেই। রিপোর্ট আসলো। ফোর্থ স্টেইজ টেস্টিকুলার ক্যান্সার। সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে।
ইনঅপারেবল। ইনকিউরেবল।
জানিয়ে দেয়া হল – তুমি হয়তো বেশি হলে আর সাত মাস আমাদের মাঝে থাকবে। মূহুর্তের মধ্যে বদলে গেল আলি বানাতের জীবন।
আর দশটা মানুষ এ খবরটা কীভাবে নিতো? হলিউড আমাদের শেখায় বাকেট লিস্ট করে মৃত্যুর আগে আগে সব শখ-আহ্লাদ মিটিয়ে নিতে। You only live once – জীবন তো একটাই যা পারো ফূর্তি করে নাও। এইডস আক্রান্ত পশ্চিমা সমকামীদের মধ্যে একটা প্র্যাকটিস চালু আছে। নিজের এইডসের কথা গোপন করে যতো বেশি সম্ভব মানুষের সাথে সেক্স করা। সবার মধ্যে নিজের ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়া। এক ধরণের অর্থহীন, বিকৃত, প্রতিশোধ। উল্টোটাও আছে। কিছু সুস্থ সমকামী খুঁজে খুঁজে এইডস আক্রান্ত সমকামীদের খুঁজে বের করে, তাদের কাছ থেকে নিজের শরীরে ভাইরাস নেয়ার জন্য। নিজেদের এরা বাগ-চেইসার বলে।
অদ্ভুত তাই না?
ভোগবিলাসে কাঁটিয়ে দেয়া, কিংবা ডিপ্রেসনের অন্ধকারে ডুবে যাওয়া অথবা আরো বিকৃত কিছু। পশ্চিমা সেক্যুলার জীবন আমাদের এমন সব পথের দিকেই ঠেলে দেয়। কিন্তু ভাই আলি বানাত কী করলেন? ভাই আলির কাহিনী নিয়ে একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ভিডিওতে চোখ মুছতে মুছতে, ধরা গলায় খুব অদ্ভুত একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, “ক্যান্সার আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার জন্য গিফট”।
অদ্ভূত কথাটার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন আলি। ক্যান্সার জীবনের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছিল। সফল ব্যবসায়ী আলিকে আল্লাহর সম্পদ দিয়েছিলেন। সবসময় লুই ভুটোঁর জুতো আর সানগ্লাস ব্যবহার করতেন। হাজার হাজার টাকা দামের স্লিপার পরতেন। ছিল গুচির ক্যাপের বিশাল কালেকশান। ব্যবহার করতেন লাখ টাকা দামের ঘড়ি আর ব্রেইসলেট। উদয়অস্ত আমরা যে মরীচিকার পেছনে ছুটে বেড়াই, ভাই আলি তা ছুতে পেরেছিলেন।
কিন্তু ক্যান্সারের মাধ্যমে আলি দুনিয়ার আসল মূল্য উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একটা ফেরারি স্পাইডারের চেয়ে খালি পায়ে আফ্রিকায় দৌড়ে বেড়ানো একটি শিশুর জন্য এক জোড়া জুতোর দাম বেশি। ক্যান্সার আলিকে বুঝিয়েছিল এ দুনিয়া আর এর মাঝের সবকিছুই মুছে যাবে। আর কাফনের কাপড়ে কোন পকেট থাকবে না। যখন কবরের প্রশ্নকারীরা আসবে, দুনিয়া এবং এর সমস্ত সম্পদ আমাদের বাঁচাতে পারবে না। মাটির এ খাঁচা মাটিতেই মিশে যাবে, রয়ে যাবে শুধু তাওহিদ, ইমান, তাক্বওয়া আর নেক আমল।
মিলিয়েনেয়ার আলি নিজের ব্যবসা বিক্রি করে দিলেন। নিজের সম্পদ বিলাতে শুরু করলেন। গড়ে তুললেন Muslims Around The World নামের চ্যারিটি। টোগোতে মসজিদ আর স্কুল বানালেন। লাখ লাখা টাকা দামের জিনিস মানুষকে দিয়ে দিলেন – “ক্যান্সার আমার জন্য গিফট। ক্যান্সার আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমি সবকিছু ছেড়ে খালি হাতে যেতে চাই। আল্লাহর কাছে যেতে চাই”।
দুনিয়া ছেড়ে যাবার আগে তাই ভাই আলি দুনিয়াকে ছাড়তে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। নশ্বর দুনিয়াকে বিক্রি করে আখিরাত কিনতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ক্যান্সার ছিল ভাই আলির জন্য হিদায়াত। সত্যিই ক্যান্সার ছিল তাঁর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে গিফট। ভাই আলি বানাত মারা যান গত ২৯শে মে রাতে। ডাক্তারদের ঠিক করে দেয়া টাইমফ্রেইমে না, আসমান ও যমীনের অধিপতির নির্ধারিত সময়ে।আল্লাহ তাঁর গুনাহ মাফ করে দিন, তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন, তাঁর ওপর রহম করুন। [ভাই আলির গল্প দেখতে ক্লিক করুন - https://youtu.be/bwLqGeQbJkk]
ভাই আলির অদ্ভূত সুন্দর এ গল্পটাই আবারো আপনাদের সামনে তুলে ধরা, কারণ এ গল্প থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। অনিশ্চয়তাপূর্ণ এ জীবনে একমাত্র নিশ্চয়তা হল মৃত্যু। আমাদের অর্থ, সম্পদ, স্ট্যাটাস কোন কিছুর গ্যারান্টি নেই। কাল সকালে উঠে আপনার পরিবারের সদস্যদের দেখতে পাবেন – এমন কোন গ্যারান্টি নেই। এক মূহুর্তে জীবন পাল্টে যেতে পারে। যা কিছুর পেছনে আমরা সব সময়, শ্রম, চিন্তা ঢেলে দেই তার সবকিছুই নশ্বর। এক্সপাইয়ারি ডেইট লাগানো এক স্বপ্নের পেছনে আমরা জীবনটা বিক্রি করে দেই। অথচ আমাদের উচিৎ আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নেয়া। অসীমকে ফেলে সীমিতের মোহে ছুটে চলা – এ কেমন উন্মাদনা?
অনেক সময় বড় কোন বিপর্যয়ের পরই মানুষ চিরন্তন সত্যকে চিনতে পারে। সহজ জীবন আমাদের অনেককে সত্য সম্পর্কে ভুলিয়ে রাখে। আল্লাহর নিয়ামতের মধ্যে ভাসতে থাকা এই অকৃতজ্ঞ আমরা আল্লাহকেই ভুলে যাই। ভাই আলির মতোই – সব ক্ষয়িষ্ণু আনন্দের ধ্বংসকারী মৃত্যু – আমাদের জন্যও অপেক্ষা করছে। আপনার-আমার জন্য সময় নির্ধারিত হয়ে গেছে, আর সমগ্র সৃষ্টি মিলেও একে ন্যানোসেকেন্ডও পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু আমরা কি জানি আমরা কবরে কী নিয়ে যাচ্ছি? আমরা কি জানি আমরা কবরের প্রশ্নকারীদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো কি না?
মানুষ চোখ মুছছে, দু’আ করছে। আপনাকে কবরে নামানো হচ্ছে। ছোট্ট, সংকীর্ণ, অন্ধকার, ভারী। আপনার জন্য দু’আ করা হচ্ছে আর আপনি দমবন্ধ করা সংকোচনে হাহাকার করছেন। প্রচন্ড ওজন আপনার ওপর চেপে বসেছে। আপনার জন্য দু’আ হচ্ছে। তারা ওপরে, আপনি নিচে। তারা আলোতে, আপনি অন্ধকারে। আপনার চেনা মুখগুলো, আপনার প্রিয় মানুষগুলো – এই তো আর কিছুক্ষণ পর আপনাকে এই গর্তে শুইয়ে রেখে যার যার মতো বাড়ি ফিরে যাবে। নিজ নিজ স্ত্রী, সন্তানের কাছে – নিজ নিজ জীবনে। আপনাকে এই মাটির ঘরে ফেলে যাবে। আপনি একা, কেউ নেই পাশে। আর তারা চল্লিশ কদম যাবার সাথে সাথেই আসবে প্রশ্নকারীরা…
কী প্রস্তুত করেছি আমরা এই দিনটির জন্য? কীভাবে বাঁচবেন? এবার চোখ বন্ধ করার পর আপনি চোখ খুলবেন রাজাদের রাজার সামনে – আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল এর সামনে…কী নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াবেন?
এই ধূলোমাটিই হল সবচেয়ে ধনীদের শেষ পরিণতি। এই ধূলো সবচেয়ে আকর্ষনীয়, সবচেয়ে সুন্দর শরীরের নারীর শেষ পরিণতি। এই ধূলোই ক্ষমতাধরদের শেষ পরিণতি – এই ধূলোই আমাদের সবার শেষ পরিণতি। From dust, To dust…
কী প্রস্তুত করেছি আমরা?
ভাই আলি মৃত্যুর আগে প্রায় ৮ কোটি টাকা সাদাকা করেছিলেন। আমরা সম্ভবত যাকাতটাও ঠিক মতো দেই না। নামায পড়ার সময় কই? রোযার অবসরগুলো কাটে মার্কেটে ছুটোছুটি করে। অথচ আমাদের দেশেই সীমান্তে ঝড়-বৃষ্টি-ক্ষুধা আর মৃত্যু মাথায় নিয়ে বসে আছে তাওহিদে বিশ্বাসী লাখ লাখ মুসলিম উদ্বাস্তু। ভাই আলি নিজের টাকা, গাড়ি, ঘড়ি, পোষাক – সব বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা কী করছি?
আখিরাত এসে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে…আমরা উদাসীন।
প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে।
যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপস্থিত হচ্ছ।
…
তারপর সেদিন অবশ্যই তোমরা নিআমত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
[সূরা তাকাসুর, আয়াত ১, ২ এবং ৮]