১.
ফেমিনিস্টদের তৈরি করা অনেক মিথের মধ্যে একটা মিথ হল “ক্যারিয়ার” মিথ। ফেমিনিস্ট রেটোরিকের কল্যাণে অধিকাংশ মেয়ে এখন তার জীবনের অপরিহার্য লক্ষ্যের মধ্যে “ক্যারিয়ার”-কে ইনক্লুড করবে। বাবা-মাও বলবে মেয়ের সফল ক্যারিয়ার হোক, মেয়ে বিয়ের পর ক্যারিয়ার গড়ুক – এটাই তারা চায়। কিন্তু “ক্যারিয়ার গড়া” আর চাকরির মধ্যে পার্থক্য আছে। কর্মক্ষেত্রে ঢোকা অধিকাংশ মানুষ ক্যারিয়ার গড়ে না। তারা চাকরি করে। হাজার জনের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ নিজ নিজ ক্ষেত্রের চূড়ায় পৌছায়। যারা নিজ কর্মক্ষেত্রে বলার মত সাফল্য ও সম্মান অর্জন করেন এমন মানুষের সংখ্যাও সীমিত। নারী ও পুরুষ, দু দলের ক্ষেত্রেই কথাটা প্রযোজ্য। ৯০% মানুষ “ক্যারিয়ার গড়তে” পারে না। তারা চাকরি করে। জীবিকা নির্বাহ করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা খাটাখাটনি করে। মধ্যম মানের থেকে যায়। পরিসংখ্যান হয়ে জীবন কাঁটিয়ে দেয়। এখানে গ্ল্যামার কিংবা গ্লৌরির কিছু নেই। কিন্তু নারীবাদীদের কথা শুনে মনে হবে তারা এক এক জন সফল ক্যারিয়ার গড়তে পারছে না, শুধু পুরুষ-তন্ত্রের দোষে! হাস্যকর, বিস্ময়কর ধরণের বোকামি-পূর্ণ কথাবার্তা।

২.
যার আসলেই ক্যারিয়ার গড়তে পারে তাদের জীবনটা খুব একটা আনন্দের না। প্রচুর কাজে ডুবে থাকতে হয়। পরিবার, হবি, অবসরের জন্য সময় পাওয়া যায় না। সফল ক্যারিয়ার থাকা বেশির ভাগ মানুষ ওয়ার্কোহলিক হয়, এবং সম্ভবত কিছুটা সাইকোপ্যাথিকও। কাজের প্রতি একটা হালকা অসুস্থ ভালোলাগা না থাকলে দিনের মধ্যে ১৮-২০ ঘণ্টা কাজ করা যায় না। যেসব মানুষ খুব প্রডাক্টিভ হয় তাদের অধিকাংশের ব্যবহার খুব একটা ভালো হয় না। অসামাজিক হয়, যদিও অনেকে হয়তো ব্যাপারটা আড়াল করতে পারে। হাই ফাংশানিং হাই অ্যাচিভার কিছু মানুষ থাকে। তবে তারা ব্যতিক্রম। আর বাস্তবতা হল মেয়েদের মধ্যে এমন মানুষ কম। ছেলেদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক যে মানসিকতা থাকে সেটা এক্ষেত্রে শক্ত প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মেয়েদের প্রকৃত ভিন্ন। মেয়েরা শেকড় গাঁড়তে চায়। এর মানে এটা না যে মেয়েরা ডাক্তার, বিজ্ঞানী, এটা বা ওটা হতে পারবে না। পারবে। কিন্তু একেবারে চূড়ায় ছেলেদের সংখ্যা বেশি হবে। যেমনটা ইতিহাস জুড়ে হয়ে এসেছে। কথাটা অপছন্দ হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতার সামনে পছন্দ-অপছন্দের তেমন মূল্য নেই।

৩.
আধুনিক সময়ে কিছু ক্ষেত্রে অনেক মেয়ে সফল “ক্যারিয়ার গড়তে” পেরেছে। মিডিয়া তথা শো-বিয এর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এই লাইনে ক্যারিয়ার গড়ার মূল্য ঠিক কী, হার্ভে ওয়েনস্টেইনের কেলেঙ্কারিতে সেটা পরিষ্কার হয়েছে। জেইন ফন্ডা থেকে শুরু করে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, গুইনেথ প্যাল্ট্রোর মতো সফল ক্যারিয়ার গড়া নারীরা এখন বলছে ক্যারিয়ারের শুরুতে হার্ভেদেরকে কীভাবে খুশি করতে হয়েছে। আর হার্ভে একজন না। এরকম হার্ভে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। ঢালিউড থেকে হলিউডে, লাক্স ফটোজেনিক থেকে ফেমিনা মিস ইন্ডিয়াতে, মিস বাংলাদেশ থেকে মিস ওয়ার্ল্ডে।

৪.
মজার ব্যাপার হুল হার্ভে ওয়েনস্টেইন কীভাবে তার অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে কমবয়েসি মডেল ও অভিনেত্রীদের উপর “যৌন নিপীড়ন” চালিয়েছিল এ খবর নিয়ে তোলপাড় শুরু হবার পর পুরুষ অভিনেতা জেইমস ভ্যান ডার ভিক-ও পাবলিকলি বলা শুরু করলো ক্যারিয়ারের শুরুতে সেও বিভিন্ন স্টুডিওর প্রভাবশালী পুরুষদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের স্বীকার হয়েছিল। সমস্যা হল ভ্যান ডার ভিক থেকে জোলি, সবাই তখন ব্যাপারগুলো চেপে গেছে। সফল হয়েছে। ক্যারিয়ার গড়েছে। আজ হার্ভে বেচারা কাদায় পড়ার পর, সবাই মুখ খুলছে। পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে হওয়া কাজকে নিপীড়ন বলাটা কেন জানি যৌক্তিক মনে হয় না। একজন বিক্রি করছে একজন কিনছে। জাস্ট বিযনেস।

৫.
হলিউডের ব্যাপারে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নতুন না। একসময়কার জনপ্রিয় শিশুশিল্পী কোরি ফেল্ডম্যান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল শৈশবে বিভিন্ন প্রডিউসার ও স্টুডিও এক্সেকিউটিভদের দ্বারা সে এবং আরও অনেকে ধর্ষিত হয়েছিল। লর্ড অফ দা রিংয –এর এলাইযা উডও মোটামুটি একই ধরণের কথাই বলেছে। হলিউড চালায় প্রভাবশালী শিশুকামীদের এক সিন্ডিকেট। আসলে ইন জেনারেল মিডিয়ার মধ্যে বিশেষ করে টিভি, মুভি, এবং মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপকভাবে এ ব্যাপারগুলো থাকে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম না। ক্যারিয়ার গড়তে হলে নিজেকে বিক্রি করাটাই স্বাভাবিক। মেয়ে এবং ছেলে – সবার জন্যই। বাংলাদেশেও।

৬.
আধুনিক সময়ের সবচেয়ে অদ্ভুত একটা বৈশিষ্ট্য হল এরকম নোংরামি ভরা “ইন্ডাস্ট্রি” গুলো থেকে মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা তাদের চিন্তাভাবনা নিচ্ছে। ১০-২৫ বছর বয়েসি মানুষগুলো টিভি, মুভি আর মিউযিক থেকে জীবনের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি নিচ্ছে। খণ্ড খণ্ড করে ব্যক্তিত্ব তৈরি করছে। ডাস্টবিন থেকে ডাস্টবিনে ঘুরে বেড়ানো স্ক্যাভেঞ্জারের মতো কুড়িয়ে নেয়া আবর্জনায় নিজেদের ঝুলি ভরছে। এই অন্ধকার আর অসুস্থতা দিয়ে ঘেরা জগত থেকে বের হয়ে আসা “শিল্প” থেকে মানুষ স্পিরিচুয়ালিটি শিখছে। ব্যাপারটা কৌতুককর। ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর।

৭.
পশ্চিমা চিন্তার বর্তমান যে অবস্থা, যে কাঠামো তাতে পশ্চিমা শত দর্শনের মধ্যে মাত্র দুটো সেন্স মেইক করে। নায়ালিযম আর হেইডোনিযম। সব আপেক্ষিকের জগতে ধ্বংস-বাদ আর ভোগবাদ যৌক্তিক। দস্তেয়েভস্কি আর নিৎচশা ব্যাপারটা অনেকে আগেই বলে গেছে। কিন্তু খুব কম মানুষ আজো ব্যাপারটা বুঝতে পারে, যদিও বেশির ভাগ মানুষ সত্যটা অনুভব করতে পারে। মুভি হিসেবে দা ডার্ক নাইটের সাফল্য, আর সামগ্রিক ভাবে আধুনিক চিন্তায় জৌকারের জনপ্রিয়তার পেছনে এটা একটা বড় কারণ। এতো জঞ্জালের মধ্যে ওর কথায় অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়, যেহেতু ও জোর করে অর্থ খুঁজছে না।

৮.
গ্রাম থেকে শহরে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসা একটা ছেলে এমন অনেক কিছু জানে যেটা আমার মতো শহুরে ছেলে জানে না। আমার শহুরে হওয়া আমাকে উত্তম করে না। ওর গ্রাম থেকে আসা ওকে অধম করে না। এটা অনেকেই মুখে বলে, বিশ্বাস করে না। কিন্তু এটাই সত্য। কিন্তু শহরের চাকচিক্য দেখে গ্রাম থেকে আসা ছেলেটার যখন মাথা ঘুরে যায়, যখন সে ‘শহুরে’ হওয়ার, জাতে ওঠার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে তখন সেটা লজ্জাজনক। ব্যাপারটা দেখাও লজ্জাজনক। পশ্চিমা জাহেলিয়্যাহ আমরা ছেড়ে এসেছি, আল্লাহর ইচ্ছায়। আপাত ভাবে এতে অনেক চাকচিক্য আছে। সত্য। মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত অনেক কিছু আছে, সত্য। আমরা বড়ই হয়েছি এর মাঝে। চিন্তাই করতাম এই ভাষায়। আর কিছু চিনতাম না। কিন্তু যখন দেখি মাদ্রাসা থেকে আসা ভাইরা, বা যাদেরকে আল্লাহ অনেক শৈশবেই দ্বীনকে বোঝার তাউফিক দিয়েছেন, তারা এই জঞ্জালের মধ্যে দিয়ে পরিচয় খোজার চেষ্টা করছেন, দ্বীনি বুঝ আর পশ্চিমা বুঝ – দুটোই আছে এটা প্রমাণের নানা হাস্যকর চেষ্টা করছেন, আদতে দুটোর কোনটাই করতে পারছেন না, তখন সেটা দেখতেও লজ্জা লাগে।

#বিক্ষিপ্ত