টিমোথি ম্যাকভেই, অ্যান্ডার্স ব্রেইভিক, ব্রেন্টন ট্যারান্ট। তিন মহাদেশের, তিন প্রজন্মের, তিন সন্ত্রাসী। তিনজনের মধ্যে পার্থক্য প্রচুর। টিমোথি ম্যাকভেই ছিল নব্বইয়ের দশকের অ্যামেরিকান প্যাট্রিয়ট মুভমেন্ট, মিলিশিয়া মুভমেন্ট, আরইয়ান রিপাবলিকের মতো নব্য নাৎসি সংগঠন আর ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী চিন্তার ফসল। এ আদর্শগুলোর পেছনে আছে শতাব্দী পুরোনো ইতিহাস। দীর্ঘদিন ধরে নিস্তেজ হয়ে আসা এ ধারণাগুলো ওয়েইকো আর রুবি রীজের ঘটনার পর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেই মিশ্রণ থেকে বের হয়ে আসে ম্যাকভেই। অ্যান্ডার্স ব্রেইভিকের ওপর ছিল ৯/১১ এর পরপর ইউরোপের ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী চেতনা ও পশ্চিমা মিডিয়ার ব্যাপক ইসলামবিরোধী প্রপ্যাগ্যান্ডার প্রভাব। ব্রেন্টন ট্যারান্টের চিন্তার কাঠামোকে বদলে দেয় ২০০৮ এর বৈশ্বিক মন্দার পর তীব্র হওয়া মার্কিন রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মাঝ থেকে অলট-রাইট নামে নব্য নাৎসি আন্দোলনের উত্থান, পশ্চিমের অভিবাসন নীতি আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির মাধ্যমে তৈরি রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ। ম্যাকভেই-এর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল সরকার। ব্রেইভিকের নিশানায় ছিল সরকার আর লিবারেলরা। ট্যারান্ট মসজিদে ঢুকে খুন করে ৫০ জন মুসলিমকে।
তবে এতসব পার্থক্য সত্ত্বেও তিনজনের মধ্যে আছে মৌলিক মতাদর্শিক কিছু মিল। তিনজনের চিন্তাই দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের ওপর। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের দর্শন অনুযায়ী শ্বেতাঙ্গরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, শারীরিক, জেনেটিক, প্রতিটি দিক দিয়ে জন্মগতভাবে সাদারা শ্রেষ্ঠ। আর এ কারণে সাদাদের নৈতিক অধিকার আছে বাকি পৃথিবী ওপর কর্তৃত্ব করার। বর্ণবাদ, ইহুদীবিদ্বেষ, দেশের নাগরিকদের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি ও হস্তক্ষেপের বিরোধিতাসহ আরও অনেক ধারণা এর সাথে যুক্ত থাকলেও মোটা দাগে এই হলো এই মতাদর্শের প্রস্তাবনা। ম্যাকভেই, ব্রেইভিক এবং ট্যারান্ট, তিনজনই এ মতাদর্শে বিশ্বাসী। তিনজনই মনে করে পশ্চিমা সভ্যতা এবং শ্বেতাঙ্গ জাতি উপনীত হয়েছে ধ্বংস এবং পতনের কিনারায়। পশ্চিমা সরকার এবং গ্লোবালিস্টরা ওদের তিনজনের চোখেই শত্রু, এবং তিনজনই মনে করে অস্ত্র ছাড়া কোনো পরিবর্তন সম্ভব না।
সাদা চামড়ার মানুষরা গণহত্যা চালালে সাধারণত মিডিয়া তাতে তেমন একটা শোরগোল করে না। তাই আমাদের চোখে এ মতাদর্শিক মিলগুলোর গুরুত্ব ধরা নাও পড়তে পারে। কিন্তু এই ধরনের মতাদর্শের মানুষ এবং সংগঠনের সংখ্যা প্রায় এক যুগ ধরে বাড়ছে পুরো পশ্চিমজুড়ে। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ কিংবা নব্য নাৎসিবাদ–যে নামেই ডাকুন না কেন, ক্রমশ বড় হচ্ছে শ্বেতসন্ত্রাসের কালো ছায়া। ২০১১ থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিবছর কোনো না কোনো হাই প্রোফাইল সন্ত্রাসীর হামলায় উঠে এসেছে এ আদর্শের নাম।
২০১১ এর জুলাইতে হয় ব্রেইভিকের হামলা। ২০১২ এর অগাস্টে মসজিদ মনে করে পিস্তল হাতে উইসকনসনের এক শিখ মন্দিরে ঢুকে ৬ জনকে গুলি করে মেরে ফেলে ওয়েইড মাইকেল পেইজ নামের মার্কিন বাহিনী থেকে ছাটাই হওয়া এক সাবেক সেনা এবং নব্য নাৎসি।[1] শিখদের দাড়ি এবং পাগড়ির কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেকেই তাদের মুসলিম মনে করে।
২০১৪ তে অ্যামেরিকার ক্যানসাসের দুটো ইহুদী কমিউনিটি সেন্টারে হামলা চালিয়ে ৩ জন হত্যা করে নব্য নাৎসি ফ্রেইযার গ্লেন মিলার।[2]
২০১৫ তে সাউথ ক্যারোলিনার এক ঐতিহ্যবাহী কৃষ্ণাঙ্গ গির্জায় ঢুকে ৯ জনকে হত্যা করে ডিলান রুফ নামে এক শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী। অ্যামেরিকাজুড়ে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু করতে চাওয়া ডিলান রুফও হামলার আগে নিজের ম্যানিফেস্টো আপলোড করে ইন্টারনেটে।[3]
২০১৬ তে ইংল্যান্ডে ছুরিকাঘাতে খুন হয় লেবার পার্টির এমপি জো কক্স। খুনি ছিল ৫২ বছর বয়সী নব্য নাৎসি থমাস অ্যালেক্স্যান্ডার মায়ার। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং অভিবাসন নীতির প্রতি কক্সের সমর্থনের কারণে তাকে হত্যা করে সে। মায়ারও বিশ্বাস করত শ্বেতাঙ্গ ইউরোপ অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি হয়েছে এবং কক্সের মতো উদারনৈতিক-বামপন্থীরা হলো সাদা জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতক।
এ হামলার পেছনের মায়ারের অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল অ্যান্ডার্স ব্রেইভিক।[4]
২০১৬ এর রমাদ্বানে তারাবীহর কিছুক্ষণ পর লন্ডনের ফিন্সবারি পার্ক মসজিদের কাছে পথচারীদের ওপর চলন্ত ভ্যান তুলে দেয় ড্যারেন অসবর্ন। এ হামলায় আহত হয় দশজন এবং মারা যান একজন মুসলিম। ইসলামবিদ্বেষী ড্যারেন অসবর্নের উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি সম্ভব মুসলিম হত্যা করা।[5]
২০১৭ এর জানুয়ারিতে কানাডার কুইবেকের এক ইসলামিক সেন্টারে ঈশার নামাযের আগে গুলি করে হত্যা করা হয় ১৯ জন মুসল্লিকে, আহত হয় আরও ১৯ জন। হত্যাকারী অ্যালেক্স্যাঁন্ড বিসোনেট ছিল শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং কানাডার অভিবাসন নীতির ঘোর বিরোধী।
২০১৮ তে অ্যামেরিকার পেনসিলভ্যানিয়ার এক সিনাগগে ঢুকে ১১ জনকে হত্যা করে রবার্ট বাওয়ারস নামের এক নব্য নাৎসি।[6]
২০১৯ এ নিউযিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে হামলার এক মাস আগে অ্যামেরিকায় গ্রেফতার হয় কোস্ট গার্ডের লেফটেন্যান্ট ক্রিস্টোফার পল হ্যাসেন। অ্যান্ডার্স ব্রেইভিকের উদাহরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ডেমোক্রেট দলীয় বিভিন্ন নেতা আর বামঘেঁষা মিডিয়া ব্যক্তিদের আক্রমণ করার জন্য দু-বছর ধরে অস্ত্র আর গোলাবারুদ জমা করছিল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী হ্যাসন।[7]
গত দশ বছরে অ্যামেরিকায় ঘটা সব চরমপন্থী হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৭৩.৩% সংঘটিত হয়েছে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের হাতে।[8]২০১৮ তে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের হাতে অ্যামেরিকায় খুন হয়েছে ৫০ জন।[9] ২০০৭ থেকে অ্যামেরিকাজুড়ে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র প্যারামিলিটারির সংখ্যা। শুধু ২০১৭ থেকে ২০১৮ এর মধ্যে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী সংগঠনের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫০%।[10]
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো প্রাথমিকভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে গড়ে ওঠা অ্যামেরিকার অলট-রাইট (Alt-Right/Alternative Right) আন্দোলন–যা আদর্শের দিক থেকে খোলাখুলিভাব শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী, যদিও ইন্টারনেট ট্রোলিং এবং মিম এর মাধ্যমে তারা নিজেদের ধ্যানধারণাগুলো ঠাট্টা আর রসিকতার আড়ালে হালকা চালে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। ইউরোপ ও অ্যামেরিকা থেকে শ্বেতাঙ্গ ছাড়া বাকি সবাইকে বের করে দিয়ে শ্বেতরাষ্ট্র (white ethnostate) প্রতিষ্ঠার কথা বলে অলট-রাইট। ব্রেন্টন ট্যারান্টের মতো তারাও বিশ্বাস করে এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সহিংসতা এবং গণহত্যসহ যেকোনো ধরনের পদ্ধতির ব্যবহার নৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে বৈধ। এক সময় অলট-রাইটকে সরাসরি সমর্থন দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার মাস্টারমাইন্ড স্টিভ ব্যানন। ব্রেইটবার্ট নিউয নেটওয়ার্কের প্রধান থাকা অবস্থায় ব্যানন মন্তব্য করে, ‘(ব্রেইটবার্ট) হলো অলট-রাইটের প্ল্যাটফর্ম’[11]। ২০১৬ এর অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় আলোচনায় উঠে আসে অলট-রাইট। ধীরে ধীরে মূলধারার মিডিয়াগুলোতে পরিচিতি ও প্রচার পেতে শুরু করে অলট-রাইট ও তাদের আদর্শ। ২০১৬ তে নাৎসি স্যালুট এবং স্লোগান দিয়ে ট্রাম্পের বিজয় উদ্যাপন করে অলট-রাইট নেতা রিচার্ড স্পেন্সার এবং তার সমর্থকরা।
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এই নব্য নাৎসিরা। ২০১৭ সালে ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে আয়োজন করা হয় ‘Unite The Right’ নামে এক র্যালির। উদ্দেশ্য ছিল অ্যামেরিকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন নব্য নাৎসি এবং শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের একত্র করে এক নতুন উত্থানের ইঙ্গিত দেয়া। স্বস্তিকাসহ বিভিন্ন নাৎসি প্রতীক এবং স্লোগান নিয়ে দুদিন ধরে চলে এ র্যালি। দুদিন ধরেই উগ্র ডানপন্থী নব্য নাৎসিদের সাথে থেমে থেমে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া আর হাতাহাতি চলে উগ্র বামপন্থী অ্যান্টিফা এবং অন্যান্য দলের। র্যালির দ্বিতীয় দিন বিরোধীপক্ষের ভিড়ে চলন্ত গাড়ি ঢুকিয়ে দেয় নব্য নাৎসি জেইমস অ্যালেক্স ফিল্ডস, এতে ১৯ জন আহত এবং একজন নিহত হয়। এ ঘটনার পর প্রেস ব্রিফিংয়ে সরাসরি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের নিন্দা করার বদলে ট্রাম্প বলে,
‘বিভিন্ন পক্ষের দিক থেকে ঘৃণা, গোঁড়ামি আর সহিংসতা দেখা গেছে’, এবং ‘দু-পক্ষেই অনেক ভালো মানুষ আছে’।[12]
এ ঘটনার পর সৃষ্ট মিডিয়া ব্যাকল্যাশের কারণে কৌশল বদলে অ্যামেরিকান অলট-রাইট এখন চেষ্টা করছে নিজেদের কার্যক্রম ও বিস্তারকে গোপন করার। অন্য কোনো র্যালি বা কর্মসূচির বদলে গত দেড় বছর ধরে তারা আবার মনোযোগী হয়েছে অনলাইন প্রচারণা এবং আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক প্রসারে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত চার বছরে অলট-রাইটের মাধ্যমে প্রভাবিত সন্ত্রাসীদের আক্রমণে অ্যামেরিকায় মারা গেছে এক শ’রও বেশি মানুষ।[13] ডিলান রুফ, অ্যালেক্স্যান্ড্রে বিযোনেট, রবার্ট বাওয়ারস, পল হ্যাসন এবং ব্রেন্টন ট্যারান্ট–প্রত্যেকেই ছিল কোনো না কোনোভাবে অলট-রাইটের ফসল।
অ্যামেরিকার অলট-রাইটের ধাঁচে ইউরোপজুড়ে একই ধরনের মতাদর্শ প্রচার করে যাচ্ছে আইডেন্টিটারিয়ান আন্দোলন। গত আট বছরে বিভিন্ন নামে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদী এ সংগঠনের শাখা ছড়িয়ে গেছে পুরো ইউরোপজুড়ে। এ আন্দোলনের অস্ট্রিয়ান শাখায় ১,৫০০ ইউরো চাঁদাও দিয়েছিল ব্রেন্টন ট্যারান্ট।[14] ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজেদের আদর্শ প্রচার করছে আইডেন্টিটারিয়ানরা। পুরো ইউরোপজুড়ে বাড়ছে তাদের সমর্থন, বিশেষ করে ৩০ এর নিচে থাকা তরুণদের মধ্যে। অলট-রাইট এবং আইডেন্টিটারিয়ানরা সহিংসতা থেকে আপাতত বিরত থাকার কথা বললেও, এ সিদ্ধান্ত কৌশলগত, নৈতিক না। পর্যাপ্ত সাংগঠনিক কাঠামো, জনসমর্থন এবং উপযুক্ত নেতৃত্ব না থাকার কারণে এই মুহূর্তে সাংগঠনিকভাবে সশস্ত্র আন্দোলনে যাওয়াকে কৌশলগত ভুল মনে করে তারা। তার বদলে সমর্থক ও অনুসারীদের উৎসাহিত করে ট্যার্যান্ট, বাওয়ারস কিংবা ব্রেইভিকের মতো একাকী হামলায়।
অ্যামেরিকা, ইউরোপ কিংবা অস্ট্রেলিয়া, যে মহাদেশেই থাকুক না কেন, পশ্চিমা এই শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা মুসলিমদের দেখে পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য হুমকি হিসেবে। ইসলাম হলো ইউরোপের ঐতিহাসিক শত্রু, তাই ব্রেন্টন ট্যারান্টের মতো তাদের ব্ল্যাকলিস্টেও সবার ওপরে থাকে মুসলিমদের নাম। ইসলামবিদ্বেষী এ মনোভাব ক্রমশ বাড়ছে পশ্চিমা বিশ্বে এবং এর স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাস্তব পরিসংখ্যানে। ২০১৬ তে অ্যামেরিকায় মুসলিমবিদ্বেষী আক্রমণের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে আগের সব রেকর্ড। ২০০১ এর চেয়েও বেশি ইসলামবিদ্বেষী অপরাধ ঘটেছে এ বছর।[15] ২০১১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ইউরোপ, অ্যামেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়াতে মোট ৩৫০টি সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা। এ সময়টাতে ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল মুসলিমরা। বিশেষ করে ২০১৫ থেকে বেড়েছে মুসলিম এবং অভিবাসী-বিরোধী আক্রমণের সংখ্যা। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমরা দেখছি ইউরোপ কিংবা অ্যামেরিকায় ঘটে যাওয়া কোনো না কোনো মুসলিমবিদ্বেষী ঘটনার খবর কিংবা ভিডিও। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখনো হয়তো হতাহতের ঘটনা ঘটছে না, কিন্তু মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার মাত্রা ও তীব্রতাবৃদ্ধির একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। শুধু এক-দুটো দেশে ব্যাপারটা ঘটছে না, হচ্ছে পুরো ইউরোপেই।
ডেনমার্কে ২০১৬ তে ইসলামবিদ্বেষী আক্রমণ হয় ৫৬ বার। ডেনমার্কের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫% হওয়া সত্ত্বেও মোট বর্ণবাদী আক্রমণের ২০% এর লক্ষ্যবস্তু হয় মুসলিমরা।[16] সুইডেনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে মোট ৪৩৯টি বর্ণবাদী আক্রমণের ঘটনা ঘটে ২০১৬তে।[17] একই বছর মুক্তচিন্তা এবং স্বাধীনতার কেন্দ্র ফ্রান্সে বন্ধ করে দেয়া হয় ১৯টি মসজিদ। গৃহবন্দী করে রাখা হয় ৭৪৯ জন মুসলিমকে এবং মুসলিমদের ঘরবাড়িতে পুলিশ রেইড দেয় ৪,৫০০ বারেরও বেশি। বিভিন্ন মসজিদে আক্রমণ করা হয় মোট ১০০ বার।[18] অন্যদিকে ২০১৭ তে শুধু লন্ডনেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে আক্রমণের ঘটনা ছিল ১,৬৭৮টি।[19] অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল মুসলিম নারীরা। মার্চ থেকে জুলাই, মাত্র চার মাসে বিভিন্ন মসজিদের ওপর আক্রমণ করা হয় মোট ১১০ বার।[20] পোল্যান্ডে ২০১৭ তে সবচেয়ে বেশি বর্ণবাদী হামলার শিকার গোষ্ঠী ছিল মুসলিমরা।[21] জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এ ধরনের মোট ৬৬৪টি ঘটনা ঘটে।[22] একই বছর স্পেইনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করা হয় ৫৪৬ বার।[23]
গালি দেয়া থেকে শুরু করে হত্যাচেষ্টা–২০১৭ সালের সরকারি হিসেবমতে সব মিলিয়ে জার্মানিতে ইসলামবিদ্বেষী আক্রমণ হয় ৯০৮টি, মসজিদে হামলা হয় মোট ১০১ বার। দুটো ঘটনা থেকে উদাহরণ দিলে জার্মানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া ইসলাম ও শরণার্থীদের প্রতি বিদ্বেষ এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের প্রভাবের মাত্রা বোঝা যাবে।
২০১৭ এর এপ্রিলের ১৫ তারিখ রাস্তা পার হবার সময় একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দেয় ২২ বছর বয়সী মিসরীয় ছাত্রী শাদিন মুহাম্মাদকে। মুমূর্ষু অবস্থায় মাটিতে পড়ে কাতরানোর সময় সাহায্য করার বদলে শাদিনকে গালি এবং টিটকারি দিতে থাকে আশেপাশের মানুষরা। তিন দিন পর মারা যায় শাদিন।[24] এ ঘটনার দু-মাস আগে ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ ভিয়েনা বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার হয় জার্মান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ফ্র্যাঙ্কো। সিরিয়ান শরণার্থী সেজে শরণার্থীবান্ধব রাজনীতিবিদদের ওপর হামলার প্ল্যান করছিল সে। তদন্ত করতে গিয়ে জানা যায় ফ্র্যাঙ্কোসহ জার্মান সেনাবাহিনী, স্পেশাল ফোর্স এবং গোয়েন্দা বাহিনীর কমপক্ষে ২০০ জন সদস্য নাৎসি মতাদর্শে বিশ্বাসী। রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি জার্মানির বিভিন্ন ইসলামী সেন্টারে আক্রমণেরও পরিকল্পনা ছিল তাদের।[25] ২০১৮ তে জার্মান ম্যাগাযিন ডের স্পিগেলের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয় পুলিশ এবং সশস্ত্রবাহিনীর ভেতর প্রভাব বাড়ছে রাইসবারগার (‘রাইখের নাগরিক’) নামের নাৎসি সংগঠনের। এ সংগঠনের মোট সদস্য সংখ্যা আনুমানিক ১৬,৫০০[26]এবং তারা চেষ্টা করছে এক নব্য নাৎসি সেনাবাহিনী গড়ে তোলার।[27]
মহাসমুদ্রের ওই পাড়ে নিজেকে অ্যামেরিকান সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য দাবি করা নরম্যান স্পিয়ার নামের এক নব্য নাৎসি গড়ে তুলেছে ‘দা বেইস’ নামের এক সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম। এ প্ল্যাটফর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের প্রয়োজনীয় শারীরিক, সামরিক ও বিস্ফোরক প্রশিক্ষণ দেয়া যাতে করে তারা বিভিন্ন টার্গেটে সফলভাবে হামলা করতে পারে। দা বেইস শুধু আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ দেবে, টার্গেট খুঁজে নিতে হবে ওদের নিজেদেরকেই। প্রাইভেট চ্যাটের মাধ্যমে এ প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীদের দেয়া হচ্ছে হচ্ছে গেরিলা যুদ্ধ, বিস্ফোরক তৈরি, সামরিক প্রশিক্ষণসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ের ম্যানুয়াল। প্রশিক্ষণ অনলাইনে চললেও নিয়মিত বিরতিতে সদস্যদের মধ্যে সীমিত পরিসরে চলছে দেখা-সাক্ষাৎ, আলোচনা এবং পরিকল্পনা। স্পিয়ার চেষ্টা করছে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত নব্য নাৎসি ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মনোযোগ ইন্টারনেট থেকে বাস্তব দুনিয়ার সহিংসতার দিকে ঘোরানোর। দা বেইসের কর্মপদ্ধতি নিয়ে স্পিয়ারের বক্তব্য হলো,
‘এখন আমাদের যথাসম্ভব গোপনীয়তার সাথে কাজ করতে হবে। কিন্তু অবস্থার অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা আরও সংগঠিত হয়ে কাজ করতে পারব, আর হয়তো একসময় গিয়ে একেবারে প্রকাশ্যে আমাদের কার্যক্রম চলবে… এই মুহূর্তে আমাদের এমন সব কাজ (হামলা) করা দরকার, যেগুলো সরাসরি কোনো সংগঠন বা গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত করা যাবে না। কিন্তু এগুলোর মাধ্যমে ঘটনাপ্রবাহ ত্বরান্বিত হবে এবং প্রচার হবে আমাদের আদর্শের।’[28]
দা বেইস চেষ্টা করে অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের মধ্যে লৌন উলফ (একাকী যোদ্ধা) এবং ‘টেরোরিস্ট সেল’ (অল্প কয়েকজন সদস্যের সন্ত্রাসী সেল) ভিত্তিক হামলা চালানোর মনোভাব গড়ে তোলার। যাতে করে কোনো নির্দিষ্ট সংগঠনের সাথে যুক্ত না হয়েই যে কেউ ইন্টারনেট থেকে আদর্শিকভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে যেকোনো হামলা চালাতে পারে। ষাটের দশকের শুরুর দিকে অ্যামেরিকান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার একজন অফিসারের তৈরি করা নেতাবিহীন প্রতিরোধ (Leaderless Resistance) এর এই ধারণা শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আশির দশকে। স্পিয়ার বিশ্বাস করে পশ্চিমা বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আরও কিছুদিন এভাবেই অগ্রসর হওয়া উচিত শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের।[29], [30] স্পিয়ারের উপসংহার মিলে যায় অলট-রাইট এবং আইডেন্টিটারিয়ানদের বিশ্লেষণের সাথে।
‘দা বেইস’ এর মতো একই রকম নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করা অ্যামেরিকা ও ইস্রায়েল সমর্থিত[31]নব্য নাৎসি প্যারামিলিটারি বাহিনী ‘আযভ ব্যাটালিয়ন’ (Azov Battalion)। আযভের সদস্যরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে নতুন সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। বৈশ্বিক শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের কথা জানতে পেরে নিজ থেকে আগ্রহী হয়েও অনেকে পাড়ি জমায় ইউক্রেনে। ইউক্রেনে বর্তমানে যুদ্ধাবস্থা থাকার কারণে একই সাথে নিজ আদর্শের প্রচার, বিদেশি রিক্রুট গ্রহণ এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আবার অন্যান্য দেশে ফেরত পাঠাবার দুর্লভ সুযোগ পাচ্ছে আযভ। এ দিক দিয়ে ইউক্রেনের বর্তমান অবস্থার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় আশি ও নব্বইয়ের দশকের আফগানিস্তানের। এ সুযোগ ব্যবহার করে আযভ চেষ্টা করছে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমিকে বৈশ্বিক শ্বেতসন্ত্রাসের ঘাঁটিতে পরিণত করার। এরই মধ্যে আযভ ব্যাটেলিয়নের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে অ্যামেরিকা, নরওয়ে, ইটালি, জার্মানি, ব্রিটেন, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী আর নব্য নাৎসিরা। ক্রাইস্টচার্চে ৫০ জন মুসলিমকে হত্যা করে ব্রেন্টন ট্যারান্টের সাথেও পাওয়া গেছে আযভ ব্যাটালিয়নের সম্পর্কের সম্ভাব্য প্রমাণ।[32]
পুরো পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে একদিকে বাড়ছে ইসলাম ও শরণার্থীদের প্রতি বিদ্বেষ, বাড়ছে উগ্রবাদী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী আদর্শের প্রভাব, অন্যদিকে দ্রুতগতিতে সামরিকায়ন হচ্ছে এসব আদর্শের সবচেয়ে কট্টর অনুসারীদের। অলট-রাইট এবং আইডেন্টিটারিয়ানদের প্রচারণার মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়া নতুন সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য গড়ে উঠছে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞদের মতে এটা হলো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বড় ধরনের হামলার দিকে যাবার ঠিক আগের পর্যায়। আপাতত তারা ব্রেইভিক কিংবা ট্যারান্টের মতো ‘লৌন উলফ’ বা একাকী হামলার দিকে মনোযোগ দিলেও, খুব দ্রুত তারা চেষ্টা করবে আরও বড় মাপের হামলার দিকে যাবার।
২০১১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ৮ বছরে অ্যান্ডার্স ব্রেইভিককে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে কমপক্ষে আরও ৪ সন্ত্রাসী, যাদের মধ্যে সর্বশেষ হলো ব্রেন্টন ট্যারান্ট। এ ৮ বছরে বহুগুণে বেড়েছে পশ্চিমা সমাজের অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ আদর্শিক দ্বন্দ্ব। সেই সাথে সমীকরণে যুক্ত হয়েছে অলট-রাইট, আইডেন্টিটারিয়ান আন্দোলন, দা বেইস এবং আযভ ব্যাটেলিয়নের মতো বিক্রিয়ক। বেড়েছে লক্ষ লক্ষ রিফিউজি এবং ইসলামবিদ্বেষ। শুরু হয়েছে ট্রাম্প যুগ।
ইসলামবিরোধী ঘৃণার চাষাবাদের এ যুগে ঠিক কতজনকে উদ্বুদ্ধ করবে ব্রেন্টন ট্যারান্ট?
চিন্তাপরাধ বইয়ের ‘শ্বেত সন্ত্রাস’ প্রবন্ধ থেকে।
চলবে ইন শা আল্লাহ্
[1] Did Islamophobia Fuel the Oak Creek Massacre?, August 10, 2012
[2] Kansas Jewish Center Shooting Suspect Identified as Former KKK Leader, ABC News, April 13, 2014
[3] Dylann Roof's Manifesto, December 13, 2016
[4] The slow-burning hatred that led Thomas Mair to murder Jo Cox, The Guardian, Novermber 23, 2016
[5] Finsbury Park attack: Why Darren Osborne was not charged with terror offences, Independent, February 2, 2018
[6] Pittsburgh shooter was fringe figure in online world of white supremacist rage, The Guardian, October 30, 2018
[7] Arrested Coast Guard Officer Allegedly Planned Attack 'On A Scale Rarely Seen', NPR News, February 20, 2019
[8] Right-Wing Extremism Linked to Every 2018 Extremist Murder in the U.S., ADL Finds, https://bit.ly/2CIIIkp
[9] U.S. sees steady rise in violence by white supremacists, CBS News, March 15, 2019
[10] The Year in Hate: Rage Against Change, Southern Poverty Law Center, February 20, 2019
[11] How Donald Trump’s New Campaign Chief Created an Online Haven for White Nationalists, Mother Jones, August 22, 2016
[12] Trump Gives White Supremacists an Unequivocal Boost, The New York Times, August 15, 2017
[13] The Alt-Right is Killing People, Southern Poverty Law Center, February 05, 2018
[14] Christchurch terror suspect gave money to Austrian far right: Chancellor Kurz, Politico, March 27, 2019
[15] Assaults against Muslims in U.S. surpass 2001 level, Pew Research Center
[16] Ibid
[17] Swedish Crime Survey-NTU
[18] Observatory of Islamophobia
[19] Scotland Yard
[20] Tell MAMA UK
[21] National Prosecutor’s Office, Poland
[22] Ministry of Interior, Poland
[23] Plataforma Ciudadana contra la Islamofobia
[24] European Islamophobia Report 2017
[25] A German right-wing extremist soldier's double life, DW, April 26, 2018
At least 200 soldiers in German Army neo-Nazi terror network, November 15, 2018
[26] Dozens of neo-Nazis serving in German police, army: Der Spiegel, Reuters, April 20, 2018
[27] Report: Far-right Reichsbürger movement is growing, building army, DW, January 12, 2018
[28] Neo-Nazis Are Organizing Secretive Paramilitary Training Across America, Vice, November 21, 2018
[29] Ibid
[30] Norman Spear- Leaderless Guerrillas, https://www.youtube.com/watch?v=daQP4gdElk8, alternate link - https://www.bitchute.com/video/9V0mBEndvMkI/
[31] Israel is arming neo-Nazis in Ukraine, July 4, 2018
[32] Intelbrief: The Transnational Network That Nobody Is Talking About, The Soufan Center, March 22, 2019