১৯৪৫ সালের ৬ অগাস্ট আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার ধারক ও বাহক আম্রিকা জাপানের হিরোশিমাতে মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুদ্ধাবস্থায় একটি আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। মজার ব্যাপারটা হচ্ছে “লিটল বয়” নামের এই ৬৪ কেজি ওজনের বোমা ফেলা হয়েছিল এমন এক অবস্থায় যখন জাপান যুদ্ধে পরাজয় মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ৬ অগাস্টের আগেই জাপানের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিলো। এবং এই খবর মিত্র বাহিনীর কাছে গোপন ছিল না। অর্থাৎ সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই বোমা হামলা করার কোন দরকার ছিল না।

ইতিমধ্যে বিজিত একটি যুদ্ধে কেন বেসামরিক জনগণের উপর এরকম ভয়ানক ধরণের বম্বিং করার দরকার হল এ ব্যপারে কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আজ ৭০ বছর পরও জানা যায় নি। ইরাকের ১৫ লক্ষ মুসলিম শিশু নিয়ে নিশ্চুপ আর ৯/১১ এর ৩,০০০ কাফিরদের নিয়ে অশ্রুসিক্ত দাসত্বমনা বুদ্ধিবৃত্তিক এস্টাব্লিশমেন্টে বেড়ে ওঠা আমরা হিরোশিমা-নাগাসাকি নিয়ে প্রশ্ন করি না। কারণ সভ্যতার ধারক-বাহকদের অসভ্য কাজগুলো নিয়ে প্রশ্ন না তোলা, কথা না বলার শিক্ষা ছোটকাল থেকেই আমাদের সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের মগজে গেথে দেয়।

অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। একবার সাদা চামড়ার ফিরিঙ্গি প্রভুদের দোষ চোখে ধরা পড়া শুরু করলে সেই লোককে দিয়ে তো আর সারাদিন দাড়িটুপিওলা বর্বর-অসভ্য মুসলিমদের মানব জাতির জন্য ক্যান্সার হিসেবে চিত্রায়িত করানোর কাজ করানো সম্ভব না। তাই পেটের হোক বা পূজোর দায়ে, প্রভুদের দোষ নিয়ে প্রশ্ন না তোলাটাই উত্তম।

প্রথমবারের মতো যখন মেক্সিকো মরুভূমিতে আণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটানো হয় তখন উপস্থিত ম্যানহাটন প্রজেক্টের সদস্যদের মধ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে কেউ কেঁদে ফেলেন, কেউ বা হাসতে শুরু করেন। বেশীর ভাগই নিরবতা অবলম্বন করেন। কিন্তু রবার্ট ওপেনহাইমার, যাকে পারমাণবিক বোমার পিতা গন্য করা হয়, উচ্চারণ করেন গীতার একটি লাইন-
“Now I am become Death, the destroyer of worlds.”

“এখন আমি পরিণত হয়েছি জগৎসমুহের ধ্বংসকর্তা মৃত্যুতে”

ওপেনহাইমার জানিয়েছিলেন বিস্ফোরণ দেখার পরই গীতার আরেকটি লাইনের কথা তার মনে হয়েছিল-

If the radiance of a thousand suns were to burst at once into the sky, that would be like the splendour of the mighty one …

“যদি আকাশে সহস্র সূর্য একসাথে বিস্ফোরিত হতো তবে সেই প্রভা হয়তো সমকক্ষ হতো এই মহান [আণবিক বোমা-র] দীপ্তির…”

ইহুদী ওপেনহাইমার কেন এই সময়ে বলার জন্য গীতা থেকে অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে বলা কৃষ্ণের এই লাইনটিকেই পছন্দ করলেন, সেটা একটা অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং আলোচনা কিন্তু ভিন্ন আলোচনা। তবে পরবর্তীতে “Brighter than a thousand suns”/সহস্র সূর্যের চেয়ে উজ্জ্বল – এই কথাটা বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই নামে লেখা হয় বই, তৈরি করা হয় গান।

সহস্র সূর্যের দীপ্তি ছুয়েছিল যে মেয়েটিকে

ছবিতে যে মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছেন তার সৌভাগ্য হয়েছিল “সহস্র সূর্যের চেয়ে উজ্জ্বল” এই মহান দীপ্তি অবলোকন করার। ওপেনহাইমারের মতো নিরাপদ দূরত্ব থেকে না। সরাসরি গ্রাউন্ড যিরো থেকে। ইন ফ্যাক্ট ওপেনহাইমার শুধু এই সহস্র সূর্যের ঔজ্জ্বল্য দেখেছিলেন, কিন্তু এই মেয়েটি সেই সহস্র সূর্যের দীপ্তিকে ছুয়েছিল। আপনাদের কথা জানি না, তবে প্রথম বার এই ছবিটা দেখার পর মনে হয়েছিল আমি কোনদিন এই চোখ দুটোর কথা ভুলতে পারবো না।

তবে সহস্র সূর্য দেখার মাসুল মেয়েটিকে দিতে হয়েছিল। সহস্র সূর্যের দীপ্তির পর এই দুটি চোখ আর কোন কিছু দেখেনি। পশ্চিমা সভ্যতার ধর্মটাই মনে হয় এরকম। এর ঔজ্জ্বল্য এমন যে তাকে ছুলে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। এর দাবি এমন যে একবার আলোকিত হতে হলে সারা জীবনের জন্য অন্ধকারকে বরণ করে নিতে হয়।

আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় আর যেকোন কিছুর চাইতে এই সভ্যতাকে ভালো মতো সংজ্ঞায়িত করে এই বম্ব। আপনার দ্বিমত থাকতে পারে কিন্তু আমার মনে হয় না আর কোন লাইন এই সভ্যতাকে এতো সুন্দর ভাবে এক লাইনে চিত্রিত করতে পারে-

“Now I am become Death, the destroyer of worlds.”

আসুন আমরা আবার ভুলে যাবার চেস্টা করি। ভুলে গিয়ে ফিরিঙ্গীদের শেখানো “সভ্যতা”-র সংজ্ঞা অনুযায়ী মনেপ্রানে সভ্য হবার চেস্টা করি। কারণ ভুলে না গেলে, নিজের পরিচয় বিস্মৃত না হলে, এবং আল্লাহ্‌ যে সত্য অবতীর্ণ করেছেন, মুহাম্মাদ ﷺ যে পথ দেখিয়ে গেছেন, তা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে উদাসীন হয়ে না গেলে এই সভ্যতাকে মেনে নেয়া কারো পক্ষে সম্ভব না। আর আমাদের এই সভ্যতাকে মেনে নিতেই হবে। ওদের মতো পড়তে হবে, বলতে হবে, করতে হবে। জাতে উঠতে হবে, আর সভ্য হতে হবে। অ্যাপ্রুভাল পেতে হবে। তাই আসুন চোখ বন্ধ করি আর ভুলে যাবার চেস্টা করি।