বলুন তো রিবা, অর্থাৎ সুদ কখন সম্পূর্ণ ভাবে হারাম করা হয়েছে?
অনেকেই হয়তো জানেন, তবে যারা জানেন না তাদের জন্য উত্তরটা জানিয়ে দিচ্ছি। রিবা সম্পূর্ণ ভাবে হারাম করা হয়েছে বিদায় হজ্জের সময়। এর আগে ধাপে ধাপে রিবার ব্যাপারে আয়াত ও হুকুম নাযিল হলেও এ ব্যাপারে চুড়ান্ত হুকুম আসে এই সময়ে। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছিলেন –
‘জাহেলী যুগের সমস্ত সূদ আমার পায়ের নিচে ধ্বংস হয়ে গেল। সবার আগে যা আমি মিটিয়ে দিচ্ছি তা হল আববাস ইবনু আব্দিল মুত্তালিবের।”
[সূত্র তাফসির ইবন কাসির, সূরা বাক্বারা, আয়াত ২৭৮-২৮১]
অর্থাৎ রিবা হারাম করা হয়েছে রাসূলুল্লাহর ﷺ নবুওয়্যাতের জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে গিয়ে। যে প্রেক্ষাপটে, যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতিতে রিবা বা সুদকে বিলুপ্ত ঘোষনা করা হয়েছে সেটার দিকে তাকানো যাক।
এটি ছিল এমন এক সময় যখন উম্মাহর মধ্যে একজন নবী ﷺ উপস্থিত ছিলেন, যিনি ﷺ ওয়াহী অনুযায়ী উম্মাহকে চালিত করছিলেন। এ হুকুম এসেছিল এমন সময় যখন মুসলিমরা শক্তিশালী ছিলেন। শরীয়াহ অনুযায়ী শাসন করা একটি ইসলামি রাষ্ট্র বিদ্যমান ছিল। এ রাষ্ট্রের প্রধান ঘোষণা দিয়েছিলেন যদি কোন ব্যক্তি সম্পদ রেখে মারা যায় তবে সে সম্পদ তার পরিবার ও সন্তানসন্ততির। আর যদি কোন ব্যক্তি ঋণ রেখে মারা যায় আর যদি তার পরিবার সে ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয় তবে - সেই ঋণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রপ্রধানের!
চিন্তা করে দেখুন – কেউ যদি ঋণ পরিশোধ না করে মারা যায় তাহলে ঋণদাতাকে সেই টাকা দেয়ার দায়িত্ব নিচ্ছে রাষ্ট্র। অর্থাৎ আপনি কাউকে লোন দিলে সেই লোন যে আপনি ফেরত পাবেনই। খোদ রাষ্ট্র নিশ্চয়তা দিচ্ছে। জামিনদার যখন রাষ্ট্র, জামিনদার যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তখন কে-ই-বা তার মুসলিম ভাইকে ঋণ দিতে আপত্তি করবে?
আবার চিন্তা করুন এই হুকুম কোন ধরনের মানুষগুলোর উপর নাযিল হয়েছিল? এই হুকুম এসেছিল সাহাবীদের জন্য রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন। তারা ছিলেন এমন মানুষ, যারা ইসলাম শিখেছিলেন খোদ রাসূলুল্লাহর ﷺ কাছ থেকে। এমন সব মানুষ যারা ইমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, বদর, উহুদ, খন্দক আর বাইয়াতুর রিদওয়ানে। এ হুকুম এসেছিল আবু বাকর, উমার, উসমান, আলী সহ জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্তদের প্রজন্মের সময়ে – রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন। এই হুকুম এসেছিল আনসার ওয়াল মুহাজিরিনের উপর।
তারা ছিলেন এমন সব মানুষ যারা তাদের পরিবার, পরিজন, গোত্র, রাষ্ট্রসহ সমগ্র বিশ্বকে ত্যাগ করেছিলেন, সমগ্র বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, তাওহিদ, তাওয়াক্কুল ও মুসলিম ভাতৃত্বকে আঁকড়ে ধরে। তারা ছিলেন সেইসব মহীরুহ যাদের কেউ কেউ তার মুসলিম ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলতেন – আপনি আমার অর্ধেক সম্পত্তি নিয়ে নিন আর আমার দুজন স্ত্রী আছে, যাকে পছন্দ হয় বলুন। আমি তাকে তালাক দেই আপনি তাকে বিয়ে করুন।
.
এমন সব মহামানব যারা যুদ্ধের ময়দানে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে থাকার সময়ও যখন তাদের কাছে পানি নিয়ে যাওয়া হতো বলতেন - আগে আমার পাশের ভাইকে পান করান। এমন ছিল তার পারস্পরিক ভালোবাসা। এ মানুষগুলোর মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তারা একে অপরকে যেভাবে চিনেছিলেন আমাদের সময়ে খুব কম মানুষেরই এমন হৃদ্যতাপূর্ণ গভীর সম্পর্কের স্বাদ পাবার সুযোগ হয়।
অর্থাৎ শুধু যে ঋণের জামিনদার রাষ্ট্র হচ্ছে তা-ই না বরং, রিবা হারাম হবার হুকুম এমন এক প্রজন্মের উপস্থিতিতে নাযিল হয়েছিল যারা ছিলেন সমগ্র দুনিয়ার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম। ঋণদাতাও সাহাবী, ঋণগ্রহীতাও সাহাবী! কোন পর্যায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তাবোধ ও আস্থা তাদের মাঝে ছিল, একবার কল্পনা করার চেষ্টা করুন।
ভেবে দেখুন তো, এমন প্রেক্ষাপটে, এমন সমাজে, এমন রাষ্ট্রে আমি বা আপনিও কি ঋণ দেয়ার সময় এতোটা চিন্তা ভাবনা করতাম?
অথচ আজকের প্রেক্ষাপট, আজকের পরিস্থিতি, আজকের সমাজ, আজকের মানুষদের কথা চিন্তা করুন। রাষ্ট্র জামিনদার হওয়া তো দূরে থাকা খোদ রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে শত কোটি- হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে যায়, রাষ্ট্রের টনক নড়ে না। শেয়ারবাজার থেকে হাজারো কোটি টাকা গায়েব হয়ে যায়, নিয়মতান্ত্রিক ভাবে লাখ লাখ মানুষকে পথে বসানো হয়। সাধারন মানুষ সাধারন মৃত্যুর নিশ্চয়তা খোজে। প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে বিশ্বাস করে না। মেয়ে বাবামাকে হত্যার পরিকল্পনা করে, ছেলে বাইক পাবার জেদে বাবাকে আগুন ধরিতে মেরে ফেলে। ক্লাস নাইনের ছেলে ৭ বছরের আত্মীয়াকে ধর্ষনের পর মেরে ফেলে, আর স্কুল পড়ুয়া যুগল সোশ্যাল মিডিয়াতে পাবলিকলি অ্যাবরশান করা না করা নিয়ে আলোচনা করে।
না আছে শরীয়াহ, না আছে ইসলামী রাষ্ট্র। না আছে বিশ্বাস, না আছে বিশ্বস্ততা। না আছে বর্তমানের গ্যারান্টি, না আছে আস্থা। না আছে সামাজিক স্থিতিশীলতা। না আছে নৈতিকতা। না আছেন এমন কোন একজন ব্যক্তি যার ব্যাপারে সমস্ত উম্মত একমত। না আছে সেই ধাতুতে গড়া মানুষ, না আছে সেই আদর্শের সমাজ। মানুষ আজ ব্যাঙ্কে রাখা টাকার নিশ্চয়তা নিয়েই শংকিত, কাউকে ঋণ দেওয়া তো অনেক দূরের কথা।
কিন্তু এসব কিছুর বিবেচনায় – বাস্তবতা, প্রেক্ষাপট, পরিস্থিতি, সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদির অজুহাত দিয়ে যদি কেউ বলে – রিবা বা সুদ হারাম হবার হুকুম আজ আর প্রযোজ্য না, রিবা হারাম হবার শর্ত সমূহ আজ উপস্থিত নেই – তবে কি তার সেই কথা গ্রহনযোগ্য হবে?
ধরুন কেউ একজন বললেন –
“সাহাবীগণ আরবী পারতেন, তাদের উপস্থিতিতে আয়াত নাযিল হত, তারা হাদিস শুনতেন ও বর্ণনা করতেন, তারা ক্বুর’আনের আয়াতের তাফসির শিখতেন খোদ রাসূলুল্লাহর ﷺ কাছে থেকে, তারা ইমান-আক্বিদা- আমলের শিক্ষা নিতেন রাসূলুল্লাহর ﷺ কাছ থেকে, তাদের আখলাক ছিল বিশুদ্ধ, তাদের আমল ছিল অসামান্য, তাদের ইমান ছিল বিশুদ্ধ, জীবন্ত - রাদ্বিয়াআল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন। কিন্তু আমরা ঠিকমতো সূরা ফাতিহাই তিলাওয়াত করতে পারি না, তাজউয়ীদের সাথে চার লাইন ক্বুর’আন পড়তে পারি না, দু-চারটা সূরা মুখস্থ রাখতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। আজ আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষের ইমান-আমল-আক্বিদা কোনটাই ঠিক নেই। শিরক, কুফর বিদ’আতে মানুষ ডুবে আছে।
তখন ইসলামী শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত ছিল, ইসলামীর রাষ্ট্র ছিল। আজ কোনটাই নেই। তখন মুসলিমরা শক্তিশালী ছিল, আজ ৯০ শতাংশ মুসলিমদের ভূখন্ডেও মুসলিমরা দুর্বল। সে সময়ের মানুষগুলো ছিলেন নির্ভেজাল, আমাদের মানুষগুলো নির্ভেজালভাবে ভেজাল। সেই প্রেক্ষাপট, সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষগুলোর সাথে বর্তমানকে মেলানো যায় না। আর তাই রিবা এখন আর হারাম না। যখন মুসলিম উম্মাহ আবার এসব দিকে দিয়ে ঐ অবস্থানে যাবে – যখন ইমান-আমলের উন্নতি হবে, যখন আক্বিদা বিশুদ্ধ হবে, যখন সবার শরীরে সুন্নত প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন সবাই ফজরের সালাত মাসজিদে আদায় করবে, যখন নুসরাহ আসবে, যখন ইসলামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সমাজ নির্মিত হবে, যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, যখন আবেদরা আরেফ হয়ে যাবে - তখন আবার রিবা হারাম হবে। তার আগ পর্যন্ত রিবা হালাল।”
যদি কেউ এমনটা বলেন তবে কি তার কথা গ্রহন করা হবে?
না। বরং উম্মাহর ইজমা হল এমন ব্যক্তি সুস্পষ্ট কুফর করেছে, এবং তার এই কুফর এমন কুফর যা তাকে ইসলামের গন্ডি থেকে বের করে দেয়।
একবার যখন শরীয়াহর কোন একটি হুকুম নাযিল হয়ে গেছে তখন ক্বিয়ামত পর্যন্ত তা উম্মাহর উপর বলবৎ থাকবে। যা আল্লাহ হারাম করেছেন তা হারামই থাকবে, যা আল্লাহ হালাল করেছেন তা হালালই থাকবে। যা আল্লাহ ফরয করেছেন তা ফরযই থাকবে – পরিবেশ, পরিস্থিতি প্রেক্ষাপটের দোহাই দিয়ে ওয়াহিকে রদ করা যাবে না। এই পরিস্থিতি আসবে জেনেই রাব্বুল আলামিন এই শরীয়াহ নাযিল করেছেন – যদি বর্তমানে তা পালন অসম্ভব হতো তাহলে এই শরীয়াহর অনুসরন ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য তিনি আবশ্যক করতেন না।
আর তাই আমরা বলি না যে আজকের অবস্থায় আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা হারাম হয়ে গেছে। আমরা বলি না আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হালাল হয়ে গেছে। আমরা বলি না আল্লাহ যা ফরযে আইন করেছেন পরিস্থিতির কারনে তা আজ মুবাহ, মাকরুহ কিংবা হারাম হয়ে গেছে অথবা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেছে।
যে শর্ত আল্লাহ আরোপ করেননি, রাসূলুল্লাহ ﷺ আরোপ করেননি, আস সালাফ-আস সালেহিন আরোপ করেননি, ইমামগন যে শর্তারোপ করেন নি – আমরা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো সেখানে নতুন নতুন শর্তারোপ করি না। আমরা নিজেদের খেয়ালখুশি, সুবিধামতো শরীয়াহর অপব্যাখ্যা করি না। আমরা বলি না যে শরীয়াহর আম হুকুম আম ভাবে বদলে গেছে কারন আজকে পরিস্থিতি প্রতিকূল। আমরা আমাদের অক্ষমতা, কাপুরুষতা এবং ওয়াহ্নকে জাস্টিফাই করার জন্য আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি ঘটাই না।
এটাই সঠিক অবস্থান, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাহর অবস্থান। ইসলামের অবস্থান। রিবার হুকুমের ক্ষেত্রে এবং শরীয়াহর অন্যান্য হুকুমের ক্ষেত্রে যদিও কাফির-মুশরিকগণ তা অপছন্দ করে।
যারা বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ’, অতঃপর (তাদের কথার উপর) সুদৃঢ় থাকে, তাহলে তাদের কোন ভয় নেই, আর তারা দুঃখিত হবে না। তারাই জান্নাতের অধিবাসী, তাতে তারা চিরকাল থাকবে, তারা যে কাজ করত তার পুরস্কার স্বরূপ। [আল আহক্বাফ, ১৩,১৪]