শরীয়াহর বিভিন্ন বিধানের সাথে আপস করার জন্যে আজকাল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অজুহাত মনে হয় প্র্যাগম্যাটিসম। বাস্তববাদীতা। বাস্তবতা জানতে হবে, আধুনিক সময়কে বুঝতে হবে। জেনে বুঝে শরীয়াহর ক, খ, গ বিধানের ব্যাপারে কিছু আপস করতে হবে। পরিবর্তন আনবে হবে। ইসলামের কিছু আদর্শ কিছু বিশ্বাসের ব্যাপারে একটু ছাড় দিতে হবে। বাস্তববাদী হয়ে শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক ট, ঠ, ড –কে কিছুটা হলেও মেনে নিতে হবে। সম্ভব হলে চেষ্টা করতে হবে একটু ‘ইসলামী’ বানানোর। যারা কোন কারণে এমন দৃষ্টিভঙ্গি রাখে না, তারা বাস্তবতা বোঝে না। অথবা বোঝার সামর্থ্য রাখে না। এই হল বাস্তববাদী হবার অর্থ।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেহেতু দাঁড়িয়ে গেছে, এখন মন্দের ভালো হিসেবে ভোট দিতে হবে। অধিকার আদায়ের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। সুদী সিস্টেমের ভেতরে থেকে যতোটুক সম্ভব ‘ইসলামী’ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে একটুআধটু সুদ, একটা নির্দিষ্ট পরিমান হারাম উপার্জন মেনে নিতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলোতে সমকামীরা স্বাধীনতা আর অধিকারের লিবারেল কনসেপ্ট ব্যবহার করে আন্দোলন করে। পশ্চিমা দেশগুলোতে থাকা মুসলিমরাও ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা দু দলই সেক্যুলার সংবিধানের অধীনে কিছু অধিকার দাবি করে। তাই দুদলের মধ্যে ঐক্য হতেই পারে। সবাই যখন টিভি দেখছেই তখন ভারতীয় সিরিয়াল না দেখে, ‘ইসলামী’ সিরিয়াল দেখুক। নেটফ্লিক্স না দেখে উসমানীফ্লিক্স দেখুক। আর সিরিয়াল হিট করাতে হলে, গানবাজনা, প্রেমভালোবাসা একটু আধটু লাগেই। বোরকানিক্বাব পরা নায়িকা দেখতে তো কেউ চ্যানেল পাল্টাবে না। একটু আঁটসাঁট পোশাক, জামার গলা একটু বড় না হলে, একটু নিচে না নামলে কি হয় নাকি! গণতন্ত্র, ব্যাংকিং, ফাইন্যান্স থেকে শুরু করে হালআমলের সোশ্যাল ও পলিটিকাল অ্যাক্টিভিসম, এমনকি ‘ইসলামী’ টিভি শো – সবক্ষেত্রেই বাস্তববাদীতার জয়জয়কার।

কিন্তু যেটাকে বাস্তববাদীতা বলা হয় সেটার এন্ড রেসাল্ট কী? এই বাস্তববাদী অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে আমরা কি দিনদিন সমাজ ও পৃথিবীকে ইসলামের দিকে আনতে পারছি, যেমনটা দাবি করা হয়েছিল? নাকি আমরাই উল্টো সময়ের সাথেসাথে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছি?

ইসলামী ব্যাংকিং আর ফাইন্যান্স প্রচলিত সিস্টেমকে ইসলামের দিকে আনতে চেয়েছিল। সেই সব উচ্চাঙ্গের কথাবার্তা বই আর অ্যাকাডেমিক পেইপারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। আর প্রায় চার দশক পর ইন্ডাস্ট্রি আজ সবদিক থেকে প্রচলিত সিস্টেমের অনুসরণ করে যাচ্ছে। যারা সিস্টেমকে বদলানোর জন্য গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে গেছে তারা আজ পর্যন্ত সিস্টেমের বিন্দুবিসর্গ বদলাতে পারেনি, কিন্তু নিজেরা ঠিকই বদলে গেছে। যেগুলোকে একসময় ‘প্রয়োজনের খাতিরে’ গ্রহণ করা কথা বলেছে সেগুলো এখন মূল উদ্দেশ্য হয়ে গেছে। জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নত হয়ে মুসলিমরা পশ্চিমের সাথে টেক্কা দেবে, এই স্বপ্ন নিয়ে কতো লক্ষ মুসলিম পশ্চিমে গেছে। তারপর তারা না পশ্চিমকে বদলেছে না মুসলিম বিশ্বকে। লাভের লাভ কী হয়েছে? তারা এখন পশ্চিমের সাথে মিলিয়ে ইসলামকে বদলে দিতে শুরু করেছে। গানবাজনায় মগ্ন থাকা মুসলিমদের কুরআনের দিকে আনার জন্য অনেক ক্বারী নাশীদ গাইতে শুরু করেছিল। একসময় দেখা গেল ছেলেপেলে তো কুরআনের দিকে আসেইনি, বরং ক্বারীরা এখন বাদ্যবাজনা নিয়ে পুরোদমে ‘মিউযিক করতে’ শুরু করেছে। এমন উদাহরণ অনেক।

ছাড় দিতে দিতে আমাদের শেকড় কী ছিল, আমরাই ভুলে গেছি। নিজেদের দেয়া জোড়াতালিগুলো আমরা নিজেরাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ছাড় দেয়ার এই অ্যাপ্রোচ অবধারিতভাবে আমাদের দুর্বল করেছে। দশকের পর দশক ধরে গণতান্ত্রিক রাজনীতি কিংবা পশ্চিমের ইসলামীকরণের চেষ্টা আমাদের কী দিয়েছে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ইসলাম আরো দুর্বল হয়েছে। সাধারণ মুসলিমরা গণতন্ত্র, সেক্যুলারিযমের মতো বিষয়গুলোতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নিজেদের অজান্তেই তাদের চিন্তার অক্ষ বদলে গেছে। এই কথিত ‘বাস্তববাদীতা’ প্রায় পুরোপুরিভাবে বাস্তবতাবিচ্ছিন্ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এধরণের বাস্তববাদীতার মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদী কিছু উদ্দেশ্য অর্জন ছাড়া আর তেমন কিছুই হয় না। অনেক সময় তাও হয় না। আর কোন অবস্থাতেই এই ধরণের অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে স্থায়ী মৌলিক পরিবর্তন আসে না। বরং স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ছাড় দিতে গিয়ে মুসলিমরাই বদলে যেতে শুরু করে। একদিকে ইসলামী আদর্শ ও চেতনা দুর্বল হয়, অন্যদিকে বিদ্যমান কাঠামো আরো শক্তিশালী হয়। আমাদের কষ্টের বিনিময়ে ওরা লাভবান হয়।

অন্যের প্রাসাদ সাজাবার জন্য যতোটুকু সময় ও শ্রম আমরা ব্যয় করেছি তার অল্প কিছু অংশ যদি নিজের কুড়েঘর বানানোর পেছনে দিতাম তাহলে আজ নিজের দ্বীন বিক্রি করে প্রাসাদ মালিককে খুশি করতে হতো না। তাদের অনুমোদনের জন্য লালায়িত হতে হতো না। কিন্তু আমরা আশ্রিত হয়ে হলেও প্রাসাদে থাকতে চাই। কুড়েঘরের জীবনে আমাদের পছন্দ না। আমরা চড়ুই। তাই বাবুই পাখিকে বাস্তবতাজ্ঞানহীন, ব্যাকডেইটেড, মৌলবাদী জঙ্গি বলি।