নিউসফিডে হেফাযতে ইসলামের সমাবেশ নিয়ে ছবি আর পোস্ট ঘুরছে। ঘোষিত ফ্রান্সের দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচী বাইতুল মোকাররম থেকে শুরু করে শান্তিনগর মোড়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ‘দূতাবাস’ ঘেরাও কর্মসূচীও একইভাবে শুরু এবং শেষ হয়েছিল। তবে আজকের সমাবেশ সংখ্যা এবং আকারের দিক থেকে আরো বড়। সমাবেশ নিয়ে অনেকে উচ্ছসিত, অনেকে হতাশ।

এই উচ্ছাস এবং হতাশার বড় একটা অংশ সম্ভবত মিসপ্লেইসড। হেফাযতে ইসলাম কী, আর কী না, সেটা ভালোভাবে বুঝলে উচ্ছাস এবং হতাশা দুটোই কমবে বলে আমার মনে হয়। প্রথমে হেফাযতে ইসলাম কী না, সেটা বলি।

হেফাযতে ইসলাম - কোন বিপ্লবী শক্তি (revolutionary force) নাকোন সংগঠিত রাজনৈতিক দল নাসরকারবিরোধী আন্দোলন নাবাংলাদেশে ইসলামী শরীয়াহ শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য চালানো আন্দোলন নাবর্তমান সাংবিধানিক, ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা বিরোধী আন্দোলন না.তাহলে হেফাযত কী?

আমার মতে হেফাযতকে একটা প্রেশার গ্রুপ বা মাইনরিটি লবি হিসেবে দেখা তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে অ্যাকুরেট। হেফাযত স্ট্যাটাস কৌ-কে ডিসরাপ্ট করতে চায় না। বিদ্যমানতাকে বদলাতে চায় না। বরং বিদ্যমানতার ভেতরে থেকে ইসলামের অবস্থান থেকে কিছু কিছু বিষয়ে দাবি আদায় বা দর কষাকষির চেষ্টা করে।

হেফাযত কিছু নির্দিষ্ট ইস্যু এবং বিষয়কে কেন্দ্র করে ইসলামী মূল্যবোধের জায়গা থেকে আন্দোলন করে। অধিকাংশ সময় তাঁদের আন্দোলন প্রতিক্রিয়ামূলক। সিডও সনদ পাশ হতে যাচ্ছে, হেফাযত সেটার বিরোধিতা করে কর্মসূচী দেবে। শাহবাগীরা নবী ﷺ-এর অবমাননা করছে, হেফাযত সেখানে বাঁধা দেবে। পাঠ্যপুস্তকে কিছু বিষয় ঢোকানো হচ্ছে, কোর্ট প্রাঙ্গনে মূর্তি বসানো হচ্ছে, সংবিধান থেকে একটা লাইন বাদ দেয়া হবে - হেফাযত এসব জায়গাতে বিরোধিতা করবে।

এগুলো প্রতিক্রিয়া। নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে হেফাযত কিছু করছে না। তাঁরা নিজস্ব কোন ম্যানিফেস্টো, রোডম্যাপ, বা আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে না। তাঁদের নিজস্ব কোন রাজনৈতিক দর্শন নেই। বরং তাঁরা একরকম বাধ্য হয়ে এসব ইস্যুতে কর্মসূচী দেয়। হেফাযত এবং সামগ্রিক কওমি রাজনীতি বিদ্যমান কাঠামোকে মেনে নিয়েছে। এ কাঠামোর ভেতরে থেকে কিছু ইস্যুতে ক্ষমতাসীন সরকার এবং নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ তৈরি করে তাঁরা নিজেদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করে। হেফাযত অনেকটা মাইনরিটি লবির মতো।

সরকারগুলো তাঁদেরকে একেবারে উপেক্ষা করতে পারে না। কারন প্রথমত, হেফাযতসহ অন্যান্য কওমি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মগুলো একটা সিগনিফিক্যান্ট সাইযের জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। তিন দিনের মধ্যে ঢাকা শহরে এক লাখ লোক জড়ো করে ফেলা সহজ কিছু না। বাংলাদেশের সব বামপন্থী দল মিলে তিন মাসেও এটা করতে পারবে কি না সন্দেহ। দ্বিতীয়ত, যদিও এ দলগুলো এককভাবে ক্ষমতায় আসার কোন সম্ভাবনা আগামী ২/৩ দশকের মধ্যে নেই। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে জোট গঠন করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে, সেক্যুলার জোটের সম্ভাব্য জুনিয়র পার্টনার হিসেবে তাঁদের গুরুত্ব আছে।

তাই হেফাযতের কাছ থেকে বৈপ্লবিক কিছু আশা করা উচিৎ না। সরকারপতন, নতুন রাজনৈতিক দর্শন, ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন – এগুলো হেফাযতের কাজ না। হেফাযতের মিছিলে কালো পতাকা থাকবে কি থাকবে না, সেটাও আসলে সিরিয়াস তর্ক হওয়া উচিৎ না। কালো পতাকার ওজন অনেক। হেফাযত এ ভার বহনের দায়িত্ব নেয়নি, এবং সেই সামর্থ্যও তাঁদের নেই। আর এমনিতেও কালো পতাকা, মিটিং মিছিল করে দাবি আদায়ের পতাকা না। একইভাবে, এধরনের কর্মসূচীতে ‘সাবিলুনা...’ স্লোগান দিতে না দেয়া হলে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ এই স্লোগানে যে পথের কথা বলা হচ্ছে সেটা হেফাযত কিংবা অন্য কোন কওমি প্ল্যাটফর্মের পথ না। এ বিষয়গুলো নিয়ে আবেগী না হয়ে, একটু ধীরেসুস্থে আমাদের ভাবা দরকার।

এর মানে কি হেফাযতের গুরুত্ব নেই? না। অবশ্যই গুরুত্ব আছে। এবং এই গুরুত্ব বোঝা জরুরী। একটা উদাহরণ দেই। বাংলাদেশে লাইসেন্স থাকলে মদ বিক্রি করা যায়, এটা সবাই জানে। কিন্তু ধরুন একটা প্রস্তাব আনা হল, মুদির দোকান, ফাস্টফুড শপ এবং সুপারশপগুলোতে এখন থেকে মদ বিক্রি করা বৈধ। এসব জায়গাতে একটা ‘হারাম’ (নন-হালাল) সেকশন থাকবে যেখানে মদ, বিয়ার ইত্যাদি বিক্রি হবে। এরকম কোন প্রস্তাব যদি আসলেই বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হয় তাহলে আমার ধারণা, হেফাযত এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। দেশে যে আগে থেকে লাইসেন্স দিয়ে মদ বিক্রি চলছে, বিভিন্ন ক্লাব-রেস্টুরেন্ট বিক্রি হচ্ছে, সেটার বিরুদ্ধে তাঁরা অবস্থান নেবে না। তাঁরা কাঠামোর বিরুদ্ধে যাবে না। বিদ্যমানতার বিরুদ্ধে যাবে না। এটা আশা করলে আপনাকে হতাশ হতে হবে। কিন্তু মদ বিক্রিকে আরো ছড়িয়ে দেয়ার, আরো প্রকাশ্য করে দেয়ার বিরোধিতা তাঁরা করবে।

ওপরে যে সিনারিওটার কথা বললাম, এটা বিভিন্ন মুসলিম দেশে ঘটেছে। এমন মুসলিম দেশ আছে এখানে দোকানে দোকানে ‘নন-হালাল’ সেকশনে মদ বিক্রি হয়। আমার দেশে এধরনের কিছুর বাস্তবায়ন যে কঠিন তাঁর একটা বড়সর কৃতিত্ব ওই শক্তির, হেফাযত যার প্রতিনিধিত্ব করে। এটা বাস্তবতা। নবী ﷺ-এর অবমাননার প্রতিবাদে পপুলার মুসলিম সেন্টিমেন্টের প্রতিনিধিত্ব করা, বিশ্বকে দেখানো এ বাংলাদেশের মুসলিমরা এটা মেনে নেবে না, ফ্রান্সের সরকারের প্রতি বার্তা দেয়া – এগুলোর জন্য হেফাযতের আজকের সমাবেশ দরকার ছিল। আমরা মানি কিংবা না মানি, এই মূহুর্তে বাংলাদেশের অন্য কোন ইসলামী সংগঠন কিংবা দলের পক্ষে এধরনের শো-ডাউন করা, এবং ব্যাপক জনসমর্থন জেনারেট করা সম্ভব না।

হেফাযতের এই ভূমিকা এবং গুরুত্ব আমাদের স্বীকার করতে হবে। তবে এর বেশি আশা করাটাও হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। হেফাযতে ইসলামের কাছ থেকে শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার জন্য, কালেমাকে সর্বোচ্চ করার জন্য কাজ আশা করা রিয়েলিস্টিক না। একই সাথে আমাদের এটাও স্বীকার করতে হবে যে, হেফাযত কিংবা কওমি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মগুলোর পক্ষ থেকে কেউ যখন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে দাবি করে যে তাঁরা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে, তখন আপত্তি ওটা স্বাভাবিক, যৌক্তিক এবং উচিৎ। .এই বাস্তবতাগুলো বোঝা আমাদের জন্য জরুরী। উচ্ছাস এবং হতাশায় বাঁধ দেয়ার জন্য বটেই, সেই সাথে ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তার জন্যেও।