১.

লোকবলের দিক দিয়ে ভারতের সামরিক বাহিনী আকারে পাকিস্তান আর্মির প্রায় ৭ গুণ। ট্যাংক-বিমান-মিসাইল ইত্যাদি প্রায় সবগুলো হিসেবে পাকিস্তান ভারতের অর্ধেক। সহজাত এ দুই শত্রুর মধ্যে আছে শক্তির ভারসাম্যহীনতা। হিসেবের পাল্লা নিজেদের দিকে ঝোকানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ধরণের স্ট্র্যাটিজি অনুসরণ করে আসছে পাকিস্তান। এজন্য তারা গ্রহন করেছে নিউক্লিয়ার ফার্স্ট স্ট্রাইক অপশান, ম্যাসিভ রিটালিয়েশানসহ বিভিন্ন ধরনের ডকট্রিন বা সামরিক নীতি। তবে এসব গালভরা নামের পদ্ধতিগুলোর অনেক আগেই পাকিস্তান আবিস্কার করেছিল বিস্ময়কর রকমের কার্যকরী আরেক কৌশল। প্রক্সি ওয়ার, ইররেগুলার অ্যাসিমেট্রিক ওয়ারফেয়ার। সহজ ভাষায় বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবক সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ। ভারতের বিরুদ্ধে এ কৌশলে পাকিস্তানের তুরুপের তাস হল বিভিন্ন সশস্ত্র ইসলামী দল।

সাধারন বিশ্বাস হল, নিজেদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সশস্ত্র ইসলামী দলগুলোকে পাকিস্তান ব্যবহার করা শুরু করে ৭০ এর দশকের শেষ দিকে। রাশিয়ার আফগানিস্তান আক্রমনের সময়। কিন্তু বাস্তবতা হল তার প্রায় তিন দশক আগে থেকেই এ কৌশল কাজে লাগিয়ে আসছে পাকিস্তান। আজকের আযাদ কাশ্মীর ‘আযাদ’ হবার পেছনে ভূমিকা ছিল সশস্ত্র পশতুন গোত্রগুলোর। ১৯৪৭ এ প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ‘এমবেডেড’ হয়ে অপারেশন পরিচালনা করছিল পাক আর্মির মিড লেভেল অফিসাররা। অবশ্যই হুকুমাতের সম্মতি ও আদেশক্রমে। সংঘাতে মাত্রা বাড়ার এক পর্যায়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে সরাসরি অংশগ্রহণ করে পাক আর্মি। সেই থেকে অত্যন্ত সফলতার সাথে এধরণের দলগুলোর পাকিস্তান ব্যবহার করে আসছে পলিসি টুল হিসেবে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আর না-পাক আর্মির ‘ইসলামপ্রেম’ নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে চোখে পানি এনে ফেলা আমাদের দেশের অনেক মানুষের কাছে তেতো লাগলেও, বাস্তবতা হল, কাশ্মীর, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান বেইসড বিভিন্ন সশস্ত্র ইসলামী দলগুলোর সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের পেছনে আছে প্রক্সির মাধ্যমে অ্যাসিমেট্রিক ওয়ারফেয়ার চালানোর এই নীতি। এ দলগুলো হল ভারতের বিপক্ষে লোকবল ও অস্ত্রে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের গ্রেট ইকুয়ালাইযার। এ নিয়ে আরো অনেক বিস্তারিত এবং ইন্ট্রেস্টিং আলোচনা করা সম্ভব, তবে এ মূহুর্তে জরুরী না।

যে বিষয়টা বোঝা জরুরী তা হল, এসব দলগুলোর প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন ও সহায়তার পেছনে কোন আদর্শ কাজ করে না। কাজ করে রিয়েলপলিটিক আর ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক হিসেব। আর যদি কখনো কোন আদর্শ থেকে থাকেও তবে তার শেষ ছিটেফোঁটাটুকুও মিলিয়ে গেছে গত ১৫/১৮ বছরে। বিষয়টা বোঝা সহজ হবে এক্ষেত্রে পাকিস্তানের সাথে ইরানের পলিসির তুলনা করলে। প্রক্সি ওয়ারের এই একই নীতি অনুসরণ করে আসছে ইরান। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইরান গড়ে তুলেছে ‘শিয়া ক্রিসেন্ট’। আজ লেবানন থেকে শুরু করে পাকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন সশস্ত্র রাফিদ্বি দলের জাল। ইরানের পক্ষে এই চমকপ্রদ ফলাফল অর্জন করা সম্ভব হয়েছে অন্যান্য হিসেবনিকেশের পাশাপাশি তাদের কাজের পেছনে থাকা আদর্শিক ফ্যাক্টরের কারণে। অন্যদিকে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ফলাফল স্পটতই ভিন্ন।

২.

চট্টগ্রাম যাবার জন্যে বের হয়ে পঞ্চগড়ের বাসে কেউ চেপে বসলে প্রতি মূহুর্তে সে গন্তব্য থেকে আরো দূরে সরে যাবে। নিজের জায়গায় ঠায় দাড়িয়ে থাকলে যে দূরত্ব অপরিবর্তিত থাকতো, প্রতি সেকেন্ডের এখন সেটা বাড়বে। ‘অ্যাটলিস্ট আমি গাড়িতে তো উঠেছি, অন্যরা তো এখনো বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো’, এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলে বাস্তবতা বদলাবে না। ইমরান খানের মতো নেতাদের বক্তব্য নিয়ে উচ্ছাস এবং তাদের বেদীতে বসানোর প্রবণতা কেন উম্মাহর জন্য অত্যন্ত বিপদজনক তা বোঝার জন্য এ সহজ উদাহরণটা মাথায় রাখা যেতে পারে। যে সেন্টিমেন্টের কারণে সাধারনভাবে মুসলিমরা ইমরান খান, এরদোগান, আহমেদিনেজাদ, জামাল নাসের কিংবা গাদ্দাফির মতো লোকদের কিছু কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে যান সেটা আমি শ্রদ্ধা করি। মুসলিম পরিচয়, উম্মাহবোধ ইত্যাদির ভূমিকা এখানে থাকে। কিন্তু আবেগটুকুকে সম্মান করলেও যে ধরণের চিন্তাধারা আমাদের বারবার এ জায়গায় নিয়ে আসে এবং দশকের পর দশক এর জন্য মাসুল উম্মাহকে দিতে হয়, সেটাকে সম্মান করা যায় না। সম্ভব না। পুরো ব্যাপারটা একটা চক্রের মতো। আমরা উচ্ছসিত হই, আবেগাপ্লুত হই, ওরা আমাদের ধোঁকা দেয়, আমরা ভুলে যাই, উম্মাহ মার খেতে থাকে, ধর্ষিত হয়, পুড়ে যায়, পচে যায়। কিছুই বদলায় না। আসলে বদলায়, প্রতিনিয়ত অবস্থায় অবনতি হয়। আমরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তারপর আবার আসে অন্য কেউ। দেয় নতুন কোন বক্তব্য। আমরা উচ্ছসিত হই, আবেগাপ্লুত হই, ওরা আমাদের ধোঁকা দেয়, আমরা ভুলে যাই…

এই চক্র থেকে বের হতে না পারলে উম্মাহর অবস্থা বদলানো তো দূরে থাক, বদলানোর চিন্তা করাও সম্ভব না। ভুল পথের যাত্রীকে জানানো দরকার যে সে ভুল গাড়িতে চেপে বসেছে। আর আমরা যদি সবাই একই জাহাজের যাত্রী হই তাহলে নিচ তলার যাত্রীরা গলুইয়ে ফুটো করার সময় তাদের মানা করা অন্য যাত্রীদের দায়িত্ব। আমার বা অন্য কারো প্রশংসা বা সমালোচনায় ইমরান খানের মতো লোকদের কিছু যায় আসে না। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আপনার-আমার আবেগ-অনুভূতি-চিন্তাকে পাত্তা দেয় না। তাই আমার কোন কথায় কেউ অসন্তুষ্ট হলেও তাতে বড় কিংবা বিশেষ কোন ক্ষতি কারো হবে না। কিন্তু দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, দশকের পর দশক এধরণের লোকদের নিয়ে আবেগে গদগদ হওয়া, কিংবা এদেরকে মডেল বানানো – এটা অনেক অনেক বড় ক্ষতি। এক-দুজনের ক্ষতি না। পুরো মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি। কাজেই বিষয়টা কারো প্রশংসা বা সমালোচনা নিয়ে না। এটা হল ব্যাপকভাবে প্রচলিত অত্যন্ত বিপদজনক ক্ষতিকর একটি ভুলের প্রশ্ন, যার সংশোধন ব্যাতীত উম্মাহর সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না।

৩.

বিয়ের পাত্রপাত্রী সালাত আদায় করে কি না এ বিষয়টা যাচাই করার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আলিমরা একটা কথা বলে থাকেন। যে বান্দা সালাত আদায় করে না, যে তাঁর সৃষ্টি কর্তার হক্ব আদায় করে না সে কিভাবে তোমার হক্বগুলো আদায় করবে? যে আল্লাহর সাথে নাফরমানী করে, সে কিভাবে তোমার সাথে বিশ্বস্ত হবে?

বিদ’আহ ব্যাপারে শায়খরা বলেন, আল্লাহর ইবাদত করতে হবে আল্লাহর নির্ধারিত পদ্ধতিতেই। আল্লাহর অবাধ্যতা করে তাঁর সান্নিধ্য অর্জন করা যায় না। রাসূলুল্লাহ ﷺ –কে ভালোবাসার ব্যাপারে শায়খরা বলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে ভালোবাসার উপায় হল তাঁর সুন্নাহ পালন করা। তাঁর সুন্নাহ ছেড়ে দিয়ে, তাঁর আনা শরীয়াহর বাইরে গিয়ে যতো ভালোবাসার সাথে যে কাজই করা হোক না কেন তাতে আশেকে রাসূল হওয়া যাবে না। সত্যিকারের আশেকে রাসূল সে-ই যে রাসূলুল্লাহ ﷺ যা এনেছেন তা আকড়ে ধরে থাকে।

পরের লাইনগুলো পড়ার সময় উদাহরনগুলো মাথায় রাখতে পারেন।

আল্লাহর আইন ব্যাতীত অন্য আইন দিয়ে শাসন করা, ইসলামী শরীয়াহকে বাতিল সাব্যস্ত করা, অন্য আইন প্রণয়ন করা, আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাকে সকল উপায়ে প্রতিহত করা – এসবগুলো কাজ কুফর আকবর যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইমাম ইবনু কাসীর, ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম বলেছেন এটা উম্মাহর ইজমা। মুখে কালিমার সাক্ষ্য দেয়া, নামায পড়া, যাকাত দেয়া শাসকগোষ্ঠী যদি আল্লাহর আইন ব্যাতীত অন্য আইন দিয়ে শাসন করে তাহলে তারা কাফির, সুস্পষ্ট ফতোয়া দিয়ে ইবনু তাইমিয়্যাহ এটা বলেছেন। শুধু বলেননি, এমন শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি সশরীরে অংশগ্রহণও করেছেন। একই কথা বলেছেন তাঁদের আগেপরে আরো অসংখ্য আলিম। আধুনিক সময়ে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইব্রাহীম, আল্লামাহ আহমাদ শাকির, আল্লামাহ মুহাম্মাদ আল-আমিন আশ-শানক্বীতি, শায়খুল মাশায়েখ উমার আবদুর রাহমানসহ আরো অনেকে স্পষ্টভাবে বলেছেন, আল্লাহর আইন ব্যাতীত অপর আইন দিয়ে চলা আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে কুফরের শাসন চলে, রাহিমাহুমুল্লাহ। এবং এ শাসকরা তাগুত। পূর্ববর্তীদের অবস্থান থেকে সরে এসে আধুনিক কিছু উলামায়ে কেরাম এসব শাসকদের ওজর দেয়ার অনেক চেষ্টা করলেও, এই কাজগুলো যে কুফর সেটা সবাই স্বীকার করেছেন।

যে ব্যক্তি আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল এর সাথে কুফর করে, সে কিভাবে উম্মাহকে পথ দেখাবে? সে কিভাবে উম্মাহর জন্য ভালো কিছু আনবে? আবেগ আর জযবার পাগলা ঘোড়ায় লাগাম দিয়ে এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের একটু ভাবা দরকার।

৪.

Those who stand for nothing fall for anything – বিভিন্ন ডকুমেন্টারিতে প্রায়ই এধরণের একটা উদ্ধৃতি দেখা যায়। একথার সাথে আমি একমত। তবে আমার মতে এটা আরেকটু মডিফাই করা যায়। আল্লাহ ‘আয্যা ওয়া জাল কুর’আনকে বলেছেন আল-ফুরক্বান। সত্য-মিথ্যা, হক্ব ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। সবকিছু মাপতে হবে আল্লাহর ঠিক করে দেয়া এ মাপকাঠিতেই। তাওহিদ, আকিদা, ইমানের মানদন্ডে সবকিছু মাপতে হবে আমাদের। আল্লাহ ‘আয্যা ওয়া জাল কোন কিছুকে কুফর বলেছেন, আর আমরা রিয়েলপলিটিক, ভূ-রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ, কিংবা আবেগের দোহাই দিয়ে সেটাকে কুফর থেকে বদলে জায়েজ বানিয়ে নেবো, প্রশংসনীয় বানিয়ে নেবো – সেই অধিকার আমাদের দেয়া হয়নি। আসমান ও যমীনের অধিপতি ইমান ও কুফর, হালাল ও হারাম নির্ধারন করেছেন সবকিছু জেনেবুঝেই। সকল বিষয়ে তিনিই সর্বাধিক জ্ঞাত। আজকের বাস্তবতা, আজকের রাজনীতি, আজকের পৃথিবী কোন কিছুই মালিকুল মুলক আল্লাহ-র কাছে অজানা না। এই ইসলামকে, এই কুরআনকে তিনি কোন টাইমস্ট্যাম্পসহ পাঠাননি। কিয়ামত পর্যন্ত এই একই মাপকাঠি। ছেলেভুলানো নানা অজুহাত আর তর্ক তাই অর্থহীন। এতে সাময়িক সন্তুষ্টি কিংবা সাময়িকভাবে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ছাড়া আর কিছু মেলে না।

আকিদাহর সঠিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বিচার না করলে পত্রিকার আন্তর্জাতিক পাতা পড়ে পড়েই বছর মানহাজ ঠিক হবে, তারপর বদলে যাবে। এভাবে গোলকধাঁধার গভীর থেকে আরো গভীরে ঘুরপাক খেতে থাকবো আমরা। আকিদার বিশুদ্ধ মাপকাঠি যার নেই, সে প্রত্যেক প্রতারণাকারীর প্রতারণায় বিভ্রান্ত হবে।