নবী-রাসূল (আলাইহিমুস সালাম)-গণের জীবনীর দিকে লক্ষ করলে একটি বিষয় চোখে পড়ে। কোনো সম্প্রদায়ের কাছে দাওয়াহ পৌঁছে দেওয়ার সময়, তাঁরা (আলাইহিমুস সালাম) ওই সম্প্রদায়ের মূল সমস্যাকে চিহ্নিত করতেন এবং তাদের সরাসরি সতর্ক করতেন। মূল সমস্যাকে ফেলে রেখে বিভিন্ন গৌণ বিষয়ে তাঁরা (আলাইহিমুস সালাম) মনোযোগী হতেন না। তাঁরা (আলাইহিমুস সালাম) উপসর্গ দেখে, ব্যাধি শনাক্ত করতেন, তারপর সেটার চিকিৎসা করতেন। এটাই নববী দাওয়াহর বৈশিষ্ট্য।

দুঃখজনকভাবে এ বৈশিষ্ট্য আজ বিরল। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর নামে ইসলামের বিরুদ্ধে অ্যামেরিকার যুদ্ধের এ সময়ে সবকিছু যেন উলটে গেছে। অধিকাংশ দা’ঈ ও ‘আলিমরা আজ ওই কথাগুলো বলেন, যেগুলো মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র বা বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা শুনতে পছন্দ করে। ওই কথাগুলো, যেগুলো আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে শেখায় বিদ্যমানতার সাথে। কিন্তু যা শোনা জরুরি, যা করা আবশ্যক, তা বলা হয় না। চেষ্টা করা হয় না স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সত্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরার। তার বদলে দেখা যায় সংঘাত এড়িয়ে চলার মানসিকতা। ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করার আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও রাষ্ট্রীয় এজেন্ডার সাথ যেকোনো মূল্যে খাপ খাইয়ে নেয়ার উৎকণ্ঠিত আকাঙ্ক্ষা।

অবধারিতভাবে অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আজকালকার অধিকাংশ সেলেব্রিটি স্কলার কিংবা দা’ঈ, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় আমাদের আত্মকেন্দ্রিক হবার শিক্ষা দেন। তাঁদের বেশিরভাগ আলোচনা সীমাবদ্ধ থেকে যায় আত্মশুদ্ধি, আমল, আখলাক, মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী কিংবা সন্তানের প্রতি দায়িত্ব, আর মন নরম করা আলোচনায়। নিঃসন্দেহে এ বিষয়গুলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু ইসলাম কেবল এ বিষয়গুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না। ইসলাম শুধু ‘আমি আর আমরা’ এর সীমারেখায় আটকে থাকে না। ইসলাম আরও ব্যাপক।

আজকের দেশি-বিদেশি জনপ্রিয় বক্তাদের মাঝে ইসলামের এই ব্যাপকতা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। ইসলামের অবস্থান থেকে সৎ কাজের আদেশ আর মন্দ কাজে বাধা দেয়ার শিক্ষা সাধারণ মুসলিমদের সামনে তুলে ধরা হয় কালেভদ্রে। বলা হয় না ঘৃণ্য জাতীয়তাবাদের সাথে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের সাংঘর্ষিকতার কথা। আল ওয়ালা ওয়াল বারা-র কথা। স্পষ্ট করা হয় না গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, লিবারেলিযমসহ নানান তন্ত্রমন্ত্রের সাথে তাওহিদের চিরন্তন লড়াইয়ের বাস্তবতা। ইসলামের সামাজিক ভূমিকা, আর শাসনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা তো অনেকটাই ট্যাবু। গুরুত্ব পায় না সভ্যতার সংঘাতও। স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায় না ইসলামের বিরুদ্ধে চলা যুদ্ধের ব্যাপারে। খুব একটা মনোযোগ পায় না সারা বিশ্বজুড়ে নির্যাতিত মুসলিমদের কথা, আর দিন দিন লম্বা হতে আক্রান্ত মুসলিম ভূখণ্ডের তালিকা। উচ্যবাচ্য হয় না ইসলামের বিভিন্ন দিককে ‘সন্ত্রাস’ আর ‘উগ্রবাদ’ নাম দিয়ে বেআইনি সাব্যস্ত করা নিয়েও। কথা হয় না আল্লাহর পৃথিবীতে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন নিয়ে।

আমাদের সামনে তুলে ধরা হয় কাটছাঁট করা এক ইসলামকে। অনেকে তো সরাসরি বলেই বসেন—‘

উম্মাহর কী অবস্থা তা নিয়ে ভাবার দরকার নেই, নিজেকে নিয়ে ভাবুন।’

‘শরীয়াহ প্রতিষ্ঠা হয়েছে কি না সেটা নিয়ে আপনাকে প্রশ্ন করা হবে না, নিজের আমল নিয়ে চিন্তা করুন।’

‘আমি ও আমরা’, ‘এখানে ও এখন’ নিয়ে ব্যস্ত থাকার শিক্ষা দেয়া হয় ইসলামের মোড়কে। চ্যালেঞ্জ করা হয় না বিদ্যমানতাকে। যা চলছে, যেভাবে চলছে এর মধ্যে থেকে শান্তি আর স্বস্তিতে, হাসিখুশি কতটুকু ‘ইসলাম’ পালন করা যায়, তা নিয়েই সব আলোচনা। সব আয়োজন। যেন নিরন্তর ‘ভালোলাগার’ কিংবা ‘ভুলে থাকার’ এক কল্পজগতে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। সারাক্ষণ যেখানে কুসুম কুসুম রোদ। রোদের আলস্য গায়ে মেখে সেখানে আমরা আত্মকেন্দ্রিকতার প্রাসাদ বানাই। ইটের পর ইট বসাই। আনন্দের অবসাদে ভুলে থাকি পতনের শব্দ আর ঝড়ের তাণ্ডব।

হকপন্থী আলিম এবং দাঈ গণের দাওয়াহকে চেনার একটা সহজ উপায় আছে। তাঁদের কথা ও কাজে ওপরে বলা নববী দাওয়াহর বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাবেন।

ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে ইসলাম পালন করাকে অন্যরা যখন উম্মাহ ও ইসলামের জন্য কাজ করার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন, তখন তাঁরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অনুযায়ী দুটোকে উপস্থাপন করেন পরিপূরক হিসেবে। ‘নিজেকে নিয়ে চিন্তা করো, উম্মাহর কথা পড়ে ভাবা যাবে’–এই চরম আত্মকেন্দ্রিক মেসেজের বদলে তাঁরা বলেন–

‘নিজেকে আগুন বাঁচাতে হবে। উম্মাহর জন্য কাজ করতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি পার নিজেকে গুছিয়ে নাও।’

তাঁদের বক্তব্য সহজ, সংক্ষিপ্ত, সোজাসাপ্টা। একইসাথে গভীর অর্থবোধক। কেবল তাত্ত্বিকতায় সীমাবদ্ধ না থেকে তাঁরা কথা বলেন আমাদের জীবন এবং আজকের পৃথিবীতে ইসলামের প্রয়োগ নিয়ে তাঁদের কথাগুলো পাঠকশ্রোতাকে নাড়া দেয়। যেভাবে আমরা পৃথিবীকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি সেই কাঠামোকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে। বাধ্য করে নিজেকে নতুন করে দেখতে, নিজের নিষ্ক্রিয়তা আর জড়তাকে প্রশ্ন করতে।

তাঁরা ওই কথাগুলো বলেন, যেগুলো আমরা শুনতে চাই না, কিন্তু আমাদের শোনা দরকার।