নাস্তিক ও সংশয়বাদীদের আরেকটি বহুল ব্যবহৃত যুক্তি হল উত্তরাধিকারসূত্রে ধর্মবিশ্বাস লাভ করার “যুক্তি”। “যুক্তিটা” অনেকটা এরকম –
“ধর্ম তো জন্মসূত্রে পাওয়া। হিন্দুর ঘরে জন্মে আজ যে হিন্দু পূজা পালন করে, সে যদি খ্রিষ্টানের ঘরে জন্ম নিত তাহলে ক্রিসমাস পালন করতো। মুসলিমের ঘরে জন্মালে এই একই লোক নামায পড়তো। ব্যক্তির জন্মই তার ধর্মবিশ্বাসকে নির্ধারিত করে দেয়। সবাই নিজ নিজ ধর্মকেই ঠিক মনে করে…”
মূলত এটাই হল এই “যুক্তির” ভাষ্য। এইটুকু বলার পর নাস্তিকরা তাদের ধরাবাঁধা মুখস্থ কথায় চলে যায়। সব ধর্মই মিথ্যা। স্রষ্টা বলে আসলে কিছু নেই। বিশ্বাসীরা আসলে বোকা। কাল্পনিক বিশ্বাস নিয়ে থাকে…ইত্যাদি।
ডকিন্স, ক্রাউস, হ্যারিস থেকে শুরু করে আরজ আলি মাতুব্বর এবং ফেইসবুকের বিভিন্ন পোষ্টে এলেমেলো কমেন্ট করে নিজের প্রতিভার প্রমান রাখতে চাওয়া উঠতি নাস্তিক – সবাই বিভিন্ন ভাবে এই “যুক্তিটি” ব্যবহার করে।
নাস্তিকদের অন্যান্য “যুক্তি”গুলোর মতো এই “যুক্তিটিরও” লক্ষ্য হল একাধিক অপ্রাসঙ্গিক বিষয়কে একত্রিত করে ইচ্ছেমতো একটা উপসংহার দাঁড় করানো এবং নাস্তিকদের অন্যান্য “যুক্তির” মতো এই যুক্তিও কোন কিছুকে সঠিক বা ভুল বলে প্রমান করে না।
যদি আমরা ধাপে ধাপে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করি তাহলে এক্ষেত্রে নাস্তিকদের বক্তব্য হল নিম্নরূপঃ
১) আপনি ধর্মে বিশ্বাস করেন
২) আপনার এই বিশ্বাস উত্তরাধিকারসূত্রে (বা পরিবার থেকে পাওয়া) পাওয়া
৩) অতএব আপনার ধর্মবিশ্বাস ভুল
কিন্তু যদি আপনি আসলে যুক্তির অনুসরণ করেন তাহলে দেখবেন ২ থেকে কোনভাবেই কিন্তু ৩ নং ধাপে পৌছানো যায় না। যেমন উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সবকিছুই কি ভুল? পরিবার থেকে আমরা দুইয়ের নামতা বা বর্ণমালা শিখি - এগুলো কি ভুল?
হতে পারে পরিবার থেকে আমরা যা কিছু শিখি তার কিছু কিছু ভুল। হতে পারে যে পরিবার থেকে আমরা যা কিছু শিখি তার অধিকাংশই ভুল। কিন্তু পরিবার থেকে আমরা যা কিছুই শিখি তার সবই আবশ্যকভাবে (necessarily) ভুল - এমন কি বলা যায়?
অবশ্যই না।
কোন বিশ্বাস একজন মানুষ ঠিক কোন উৎস (source) থেকে অর্জন করছে তা কি সেই বিশ্বাসের সঠিক বা ভুল হওয়াকে নির্ধারন করে দেয়? অর্থাৎ আমি একটা বিশ্বাস কিভাবে অর্জন করেছি তার সাথে আমার বিশ্বাস সঠিক বা ভুল হবার সম্পর্ক কি? আমার বিশ্বাস এর উৎস আর আমার আমার বিশ্বাসের সঠিক বা ভুল হওয়া – এদুটি দুটো আলাদা বিষয়।
ধরুন ঢাকার কোন এক বস্তির কোন এক খুপরি ঘরে কোন এক মা তার ৭ বছর বয়েসই বাচ্চাকে বলছেন – জানো পৃথিবিতে এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে শীতকালে আকাশ থেকে দানা দানা তুষার পড়ে?
ধরে নিন বস্তিনিবাসী এই মায়ের সন্তান তার মায়ের এই কথাটি বিশ্বাস করে নিল। এবং সারাজীবনে একবারও চোখের সামনে তুষারপাত না দেখলেও সে এই কথাকে সারাজীবন সত্য বলে বিশ্বাস করলো।
এ থেকে কি প্রমাণিত হয় তার এই বিশ্বাস ভুল, যেহেতু সে পরিবার থেকে এই বিশ্বাস পেয়েছে? পৃথিবীর কোন কোন জায়গায় তুষারপাত হয় – এই বিষয়টির সঠিক হওয়া বা না হওয়ার সাথে কি আদৌ কোন উৎস থেকে বিশ্বাসটা আসছে তার কোন সম্পর্কে আছে? আচ্ছা, যদি যুবক বয়সে পরিবার থেকে পাওয়া এই বিশ্বাসকে এই ছেলেটা অস্বীকার করে – কারন এটা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিশ্বাস – তাহলে কি পৃথিবিতে তুষারপাত বন্ধ হয়ে যাবে?
ইন ফ্যাক্ট কোন কিছু কি আপনি যৌক্তিক কারনে বিশ্বাস করেন নাকি অন্ধভাবে বিশ্বাস করে সেটা দিয়েও কিন্তু সেই বিশ্বাসের সত্য বা মিথ্যা হওয়াকে প্রমান করা যায় না। যদি কোন সত্যকে আমি অন্ধভাবে বিশ্বাস করি তাহলে কি সেই সত্য মিথ্যা হয়ে যাবে?
ধরুন একজন জন্মান্ধ ব্যক্তিকে বলা হল - গাছের পাতা সবুজ। যদি লোকটি এই কথাটি বিশ্বাস করে তাহলে আক্ষরিক ভাবেই তার বিশ্বাস একটি অন্ধ বিশ্বাস। কিন্তু তার মানে কি এই বিশ্বাস ভুল? লোকটি অন্ধভাবে বিশ্বাস করছে তাই বলে কি গাছের পাতা সবুজ এটা মিথ্যা হয়ে যাবে?
কোনো একজন মানুষ কোন উৎস থেকে একটি বিশ্বাস পাচ্ছে এ থেকে সর্বোচ্চ ঐ ব্যক্তির বিশ্বাসের ধরন সম্পর্কে কোন মন্তব্য করা যেতে পারে। কিন্তু ঐ বিশ্বাসের ঠিক হওয়া বা না হওয়ার সাথে কোন উৎস থেকে বিশ্বাসটা আসছে তার কোন সম্পর্ক নেই। এ সবকিছুই উক্ত ব্যক্তির বিশ্বাসের ধরনের সাথে সম্পর্কিত কিন্তু কোন কিছুই ঐ বিশ্বাসের সঠিক হওয়া বা না হওয়ার পক্ষে বা বিপক্ষে প্রমাণ না।
নাস্তিকরা ঠিক এই জিনিসটাই দাবি করছেন। তাদের এই যুক্তিকে যদি স্পেসিফিক থেকে জেনারেল ফর্মে আনা হয় তাহলে আমরা পাইঃ
১) একজন ব্যক্তি বিশ্বাস করে “ক” - এর অস্তিত্ব আছে
২) এই বিশ্বাস সে পেয়েছে উৎস “খ” থেকে
৩) তার মানে “ক” এর অস্তিত্ব নেই
যদি আমরা ৩-কে সত্য প্রমাণ করতে চাই তাহলে আমাদের হয় “ক” এর অনস্তিত্বকে প্রমান করতে হবে, অথবা “ক” এর অস্তিত্বের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ আনতে হবে। কিন্তু যৌক্তিকভাবে ২নং ধাপ থেকে ৩নং ধাপে যাবার কোন পথ নেই।
এক্ষেত্রে দুটি অপ্রাসঙ্গিক বিষয়কে – কোনো বিশ্বাস বা দাবির উৎস (origin or source of belief/claim) এবং বিশ্বাসের সঠিক হওয়া (whether the belief/claim is true or false) – একত্রিত করা হচ্ছে। এটি একটি বহুল ব্যবহৃত লজিকাল ফ্যালাসি এবং এটা এতোটাই বহুল ব্যবহৃত যে এই ধরনের ফ্যালাসির আলাদা একটা নাম আছে – Fallacy of origins.
কিভাবে একজন মানুষ “স্রষ্টা নেই” – এই দাবি প্রমান করার জন্য এই যুক্তি ব্যবহার করতে পারে তা ঠিক বোধগম্য না। কিভাবে একজন মানুষ – “তোমার ধর্ম ভুল, কারন তুমি পরিবার থেকে তোমার ধর্মবিশ্বাস পেয়েছো” – এই যুক্তি সুস্থ মস্তিস্কে বিশ্বাস করতে পারে এটাও ঠিক বোধগম্য না। সম্ভবত নাস্তিকরা এই কথার মাধ্যমে নিজেদেরকে “স্পেশাল” প্রমান করতে চান।
“দেখো সবাই পরিবারের বিশ্বাস গ্রহন করেছে, কিন্তু আমি পরিবারের বিশ্বাস ত্যাগ করেছি” – এই জাতীয় কিছু ভেবে হয়তো তারা নিজেদের বিশেষায়িত মনে করতে চান। কিন্তু বাস্তবতা হল, ঠিক যেইভাবে পরিবার থেকে পাওয়ার কারনে কোন বিশ্বাস মিথ্যা হয়ে যায় না, ঠিক তেমনিভাবে পরিবারের বিশ্বাস ত্যাগ করার মানেই অটোম্যাটিকালি সত্যকে খুঁজে পাওয়া না।
পরিবার থেকে পাওয়া বিশ্বাস বা তথ্য ভুলও হতে পারে ঠিকও হতে পারে। কিন্তু নিছক পরিবার থেকে পাওয়া – এটাই কোন কিছুর ভুল বা সঠিক হবার ব্যাপারে প্রমান না। নাস্তিকরা যদি বলতে চায় স্রষ্টা নেই – তাহলে তাদের এ বিষয়ে প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। কেউ কোন কিছু কেন বিশ্বাস করে, কিভাবে বিশ্বাস করে, কিভাবে সে এই বিশ্বাস অর্জন করলো - স্রষ্টার অনস্তিত্ব প্রমাণ করার ক্ষেত্রে এগুলো অপ্রাসঙ্গিক।
একইভাবে যদি নাস্তিকরা দাবি করে অমুক ধর্ম ভুল তাহলে তাদেরকে সেই দাবির পক্ষে প্রমাণ আনতে হবে। কিন্তু নাস্তিকরা যুক্তির কথা খুব করে বললেও, যুক্তি-যুক্তি খেলতে চাইলেও সত্যিকার ভাবে যুক্তির ব্যবহার তারা করতে পারে না। আর তারা ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারে বারবার প্রমাণের কথা বললেও নিজেদের দাবির পক্ষে বলা চলে কখনোই প্রমাণ উপস্থাপন করে না। গত প্রায় এক শতাব্দীতে নাস্তিকতায় বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যটি অপরিবর্তিত আছে। নাস্তিকরা তাদের দাবির পক্ষ কোন যুক্তি পেশ করে না, কিন্তু নিজেদের দাবিকে (“স্রষ্টা নেই”) যৌক্তিক বলে দাবি করে।
তারা বিশ্বাসের সমালোচনায় বারবার অন্ধবিশ্বাসের কথা আনে কিন্তু তারা নিজেরাই অন্ধভাবে একটি অপ্রমাণিত, অবৈজ্ঞানিক এবং অযৌক্তিক বিশ্বাস লালন করে। আর সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হল যুক্তি-প্রমাণ-বিজ্ঞানের স্তুতি গাওয়া এই নাস্তিকদের তথাকথিত “যুক্তি”গুলো হতাশাজনক রকমের শিশুসুলভ এবং মোটা দাগের বুদ্ধিবৃত্তিক হাতসাফাই ছাড়া কিছুই না। নাস্তিকদের সমস্ত আর্গুমেন্ট তৈরি করা মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি করা, মানুষকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেওয়া, মানুষের মধ্যে আবেগময় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির জন্য – কিন্তু নিজ অবস্থানের সমর্থনে কোন নিরেট যৌক্তিক বা সায়েন্টিফিক আলোচনা তাদের কথায় নেই।
আশ্চর্যজনক বিষয় হল এই জোড়াতালি দেওয়া কুযুক্তি উপস্থাপন করে তারা নিজেদের “বুদ্ধিমত্তার শিখরে আরোহনকারী” জাতীয় কিছু মনে করে এবং অবলীলায় সবাইকে আক্রমণ করে যায়। আবার এরাই মানুষকে মানবতার কথা শেখাতে চায়।
তাই বারবার ভাঙ্গা টেপের মতো এই লজিকাল ফ্যালাসিটা রিপিট করে যাওয়া বাঙ্গালী “মুক্তমনা”, নাস্তিক, ইসলামবিদ্বেষী, “সুশীল”-দের জন্য আমার একটা পাল্টা প্রশ্ন আছে।
আমরা জানি ৭১ সালের যুদ্ধে দুটো পক্ষ ছিল। (যদিও অনেকে বলে পক্ষ ছিল ৩টি কিন্তু আমরা আপাতত দুটিই ধরে নেই)
এই দুটো পক্ষের মধ্যে কোন পক্ষটি সঠিক ছিল?
প্রায় নিশ্চিতভাবেই জবাব আসবে – বাঙ্গালীরা সঠিক অবস্থানে ছিল।
কিন্তু একই প্রশ্ন যদি কোন পাঞ্জাবী বা পাকিস্তানীকে করা হয় তবে সে জবাব দেবে – “পাঞ্জাবীরা সঠিক অবস্থানে ছিল। বাঙ্গালীরা গাদ্দার ছিল।”
আমরা বাঙ্গালী হবার কারনে আমরা বিশ্বাস করছি ৭১ এর যুদ্ধে বাঙ্গালীরাই সঠিক অবস্থানে ছিল। যদি আমরা পাঞ্জাবী হতাম তাহলে আমরাই বলতাম - বাঙ্গালীরা গাদ্দার, পাঞ্জাবী আর্মিও সঠিক অবস্থানে ছিল।
৭১ এর যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের অবস্থান বাঙ্গালী হিসেবে জাতীয়তা সূত্রে পাওয়া একটি বিশ্বাস। এখন প্রশ্ন হল, মুসলিম পরিবারের জন্মগ্রহন করে কেউ মুসলিম হওয়ার কারনে যদি ইসলাম ধর্ম ভুল হয়, তাহলে নিশ্চয় এটাও বলা যায় যে জাতীয়তার কারনে ৭১ এর ব্যাপারে বাঙ্গালী হিসেবে আমরা যে উপসংহার দিচ্ছি তাও ভুল? অর্থাৎ বাঙ্গালী হবার কারনে বাঙ্গালীদের অবস্থান সঠিক ছিল বলে আমরা যে মত দিচ্ছি সেটাও ভুল?
একইভাবে পাঞ্জাবী হবার কারনে পাঞ্জাবীদের অবস্থান সঠিক ছিল বলে পাঞ্জাবীরা যে উত্তর দেবে সেটাও ভুল। সুতরাং এই যুদ্ধে আসলে কোন পক্ষই সঠিক ছিল না। দুই পক্ষই ভুল ছিল। পাকিস্তানি আর্মি যদি যুদ্ধে অংশগ্রহন করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করে তাহলে বাঙ্গালীরাও যুদ্ধে অংশগ্রহন করে অপরাধ করেছে।
এই উপসংহার কি কোন “মুক্তমনা”, “সুশীল”, নাস্তিক মেনে নেবে?