ভাষা হিসেবে বাংলা বেশ দুর্বল। প্রেম, আদিখ্যেতা কিংবা আবেগের ভাষা হিসেবে বাংলা চমৎকার, কিন্তু দু’ এক শব্দে গভীর অর্থ তুলে ধরার ক্ষেত্রে এ ভাষা তেমন উপযুক্ত না। তার ওপর বাংলায় দখল তেমন ভালো না হওয়ায় প্রায়ই যুতসই শব্দের খোঁজে হাতড়ে বেড়াতে হয়। শাব্দিক বা আক্ষরিক অনুবাদ করে চালিয়ে দেয়া তো যায়-ই, কিন্তু তাতে তৃপ্তি পাওয়া যায় না। মনে হয় যা বোঝাতে চাচ্ছি তা স্পষ্ট হচ্ছে না। ভাষার বাহুল্যের জন্য অনর্থক জটিলতা চলে আসছে। তাই দেখা যায় নিজ মনের খচখচানি দূর করতে গিয়ে একটা শব্দকে ব্যাখ্যা করতে হয় কয়েকটা বাক্যে। প্রায়ই এমন হয়। এখনো হচ্ছে। এই মূহুর্তে যে শব্দটার যুতসই বাংলা নিয়ে চিন্তা করছি সেটা হল – Presentism. তিনটা সম্ভাব্য ‘ভাবানুবাদ’ মাথায় ঘুরছে ‘বর্তমানমুগ্ধতা’, ‘বর্তমানআচ্ছন্নতা’, বর্তমানকেন্দ্রিকতা। কিন্তু কোনটা বেছে নেয়া উচিৎ ঠিক করতে পারছি না। এ ব্যাপারে আপনি হয়তো আমাকে সাহায্য করতে পারেন তবে তার আগে Presentism বলতে কী বোঝায়, বা আমি কী কোন অর্থে শব্দটাকে ব্যবহার করতে চাইছি, সেটা একটু ব্যাখ্যা করি।

Presentism শব্দের দুটি অর্থ হয়, বা বলা ভালো দুই ধরনের অর্থ হয়। একটি হল Philosophical Presnetism. ফিলোসফিকাল প্রেযেন্টিযম এর ধারণা মোটামুটি জটিল, এবং সময়ের ধরণ ও দর্শন দিয়ে এই কনসেপ্টটা ঠিকমতো বোঝা ও বোঝানোর বেশ কিছুটা মেন্টাল জিমন্যাস্টিক্সের দরকার। তাই আপাতত এটা আমরা এ স্কিপ করে যাই। Presentism এ দ্বিতীয় এবং অধিকতর প্রচলিত অর্থের প্রয়োগ ঘটে ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে। সহজ ভাষায় প্রেযেন্টিযম হল ঐতিহাসিক ঘটনা বা কোন সাহিত্যিক রচনাকে বর্তমান ধ্যানধারণার আলোকে ব্যাখ্যা করা। বর্তমানের চিন্তাগুলোকে অতীতের ওপর চাপিয়ে দেয়া। ধরুন আরব্য রজনীর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমি বললাম –

‘আরব্য রজনী হল একজন নারীর ক্ষমতায়নের গল্প। বিভিন্ন অলৌকিক, বিচিত্র সব গল্পের আড়ালে আসলে এটা হল পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ শাহরিয়ারের ওপর বুদ্ধিমতী ও কৌশলী নারী শেহেরযাদের বিজয়ের গল্প। নিজের দক্ষতা, কল্পনাশক্তি ও গল্প বলার অসাধারন ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এই শক্তিশালী নারী খুনী, অত্যাচারী, পুরুষকে শেষ পর্যন্ত সভ্য করে তুলেছে।’

এখানে আমি আরব্য রজনী ও এর প্রধান দুটি চরিত্রকে বিশ্লেষন করলাম আধুনিক নারীবাদের বিভিন্ন ধারণার আলোকে। কিংবা বলা যায় আমি নারীবাদী দর্শনের আধুনিক কিছু ধারণা তাদের ওপর চাপিয়ে দিলাম, এবং আমার নিজের ধ্যানধারণার আলোকে মনমতো একটা ব্যাখ্যা তৈরি করে নিলাম। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায় এ গল্পগুলো তৈরি করার সময় আরব্য রজনীর লেখক কিংবা লেখকেরা নারীবাদ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত ছিলেন না। সুতরাং এই ব্যাখ্যা হয়তো আমার কাছে ভালো লাগতে পারে, আমার সমমনাদের কাছে ভালো লাগতে পারে, কিন্তু দিনশেষে এটি হল একটি ভুল ব্যাখ্যা, কল্পনাবিলাস, প্রজেকশান, ডিলিউশান। আমি ধরে নিচ্ছি এই মূহুর্তে আমি যেসব ধ্যানধারণা পোষণ করছি তা সব যুগে, সব মানুষের কাছে সত্য ছিল। সহজ ভাষায় এই হল ঐতিহাসিক কিংবা সাহিত্যিক প্রেযেন্টিযম। বর্তমানের আদলে অতীতের চিত্রায়ন।

যা হোক, এ দুটো অর্থের কোনটা নিয়েই আমার মাথাব্যাথা নেই। আমার আগ্রহ তৃতীয় আরেকটি অর্থ নিয়ে। আচ্ছা বলুন তো ঐতিহাসিকরা কি আসলে কখনো কি নিরপেক্ষ হতে পারেন? ধরুন ৭১ এর কিংবা ৪৭ এর ঘটনা নিয়ে আমাদের বেছে নেয়া ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আসলে কতোটুকু নিরপেক্ষ? কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের ব্যাপারে বর্তমানে গৃহীত ঐতিহাসিক অবস্থানই বা কতোটুকু নির্মোহ, নিরপেক্ষ? এসবক্ষেত্রে বায়াস বা পক্ষপাত সনাক্ত করা মোটামুটি সহজ, তাও কিন্তু আমরা এই পক্ষপাত এড়িয়ে যেতে পারি না। আসুন আরেকটু সূক্ষ আরেকধরনের পক্ষপাতের কথা বলা যাক। কোন মানুষ তো খালি কাগজ হয় না। প্রতিটি মানুষের মধ্যে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ভালোমন্দ, সুন্দর-অসুন্দরের একটি ধারণা থাকে। খুব অল্প মানুষই হয়ত নিজের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি বা দর্শনকে কথায় প্রকাশ করতে পারবে কিন্তু অবশ্যই প্রতিটি মানুষের মধ্যে পৃথিবীকে দেখার, বোঝার একটি কাঠামো থাকে। এই কাঠামোর সাপেক্ষে যে সে তার চারপাশের বাস্তবতাকে বিশ্লেষন করে।

একইভাবে এই কাঠামোর সাপেক্ষেই সে ইতিহাসকেও বিশ্লেষন করে। অর্থাৎ আমরা যখন কোন ঐতিহাসিক ঘটনাকে বিশ্লেষন করতে যাই তখন সেটা পুরোপুরি নির্মোহ, নিরপেক্ষ, অবজেক্টিভ বিশ্লেষণ হয় না। বরং আমাদের সহজাত পক্ষপাত বা একটি Inherent bias সেখানে কাজ করে। অর্থাৎ আমরা যখন বর্তমানের কোন ব্যাখ্যা অতীতের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি না, তখনো আমরা বর্তমানে সাপেক্ষে অতীতকে বিশ্লেষণ। অনেকে একে Historian’s Fallacy ও বলেন। কিন্তু আমার মতে এই ব্যাপারটা আসলে Historical Presentism এবং Histoian’s Fallacy এর একটা মিশ্রন। নাম যাই হোক, চিন্তার এই বাক্স থেকে বেড়িয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন, এবং সবসময় যে প্রয়োজন, তা না। কিন্তু এ বায়াসের কারণে একটা গুরুতর সমস্যা তৈরি হয়। আমরা মনে করতে শুরু করি যে বর্তমান সময়, বর্তমানে সভ্যতা হল মানব উৎকর্ষের শিখর, মানবইতিহাসের চূড়ান্ত পর্যায়। আমাদের মধ্যে এক ধরনের সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স কাজ করে। আমরা মনে করি সভ্যতা হিসেবে আমরা আগের সব সভ্যতার চাইতে উত্তম। শুধু প্রযুক্তির দিক দিয়ে না, জ্ঞান ও বুদ্ধির দিক দিয়ে আমরা আগের সভ্যতাগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে। আমরা তাই তাদেরকে judge করি। এবং আমরা ধরে নেই আমরা ব্যতিক্রম। আমরা আলাদা, আমরা বিশেষ কিছু।

সমস্যা হল যুগে যুগে প্রায় সভ্যতাই এমন মনে করে এসেছে। সব সভ্যতাই নিজেদেরকে ব্যতিক্রম, অন্যদের থেকে আলাদা, ‘বিশেষ কিছু’ ভেবেছে। এবং ‘বর্তমান’-কে মানবইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় ধরে নিয়েছে। প্রায় সব সভ্যতা – আমরাসহ – কিশোরসুলভ আত্মমুগ্ধতা, আত্মকেন্দ্রিকতা নিয়ে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেছে। এবং এই প্রবণতাই অনেক ক্ষেত্রে তাদের ধ্বংস ডেকে এনেছে। আমি Presentism এর এই অর্থ নিয়ে আগ্রহী। The narcissism of civilization - সভ্যতার আত্মউপাসনার প্রবণতা।

বর্তমানমুগ্ধতা, বর্তমানআচ্ছন্নতা, বর্তমানকেন্দ্রিকতা - এই শব্দের ভাবানুবাদ হিসেবে কোনটা ভালো হয়? বর্তমানমুগ্ধতা- র মধ্যে একটু শৈল্পিকতা আছে, কিন্তু অর্থের দিক দিয়ে কিছুটা অতিরঞ্জন হয়ে যায়। অন্যদিকে বর্তমানকেন্দ্রিকতা সম্ভবত অর্থের দিক দিয়ে সবচেয়ে accurate, কিন্তু শুনতে সবচেয়ে সাদামাটা। বর্তমানআচ্ছন্নতা দু দিক দিয়েই দুটোর মাঝামাঝি, তাই অনেকে হয়তো এটাকেই পছন্দ করবেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এধরনের মাঝামাঝি পছন্দগুলো অনেক সময় ‘দু দিকের ভালোটা’ নেয়ার বদলে দু’দিকের দুর্বলতা নেয়া হয়ে যায়। সে যা হোক, শব্দের ভাবানুবাদ নিয়ে বিশ্লেষণ আসলে আমার মূল উদ্দেশ্য না। Presentism নিয়ে কথা বলার দরকার ছিল কারণ অনেক সময় বাস্তবতাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণের জন্য একটু পিছিয়ে যেতে হয়। বর্তমানমুগ্ধতাকে ঝেড়ে ফেলে প্রয়োজন হয় ঐতিহাসিক দূরত্ব থেকে নির্মোহ বিশ্লেষণের। যেকোন একটা বেছে নিন, অথবা না নিন – শব্দ তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। তবে আমাদের বর্তমানকে বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হল কনসেপ্টটা বোঝা।

#বিক্ষিপ্ত