দ্বীন ও দুনিয়ার মাঝে সমন্বয়। কথাটি আমরা প্রায়ই শুনি। ইসলাম আমাদের সংসারত্যাগী হতে বলে না। আবার এমন ভাবে দুনিয়ার পেছনে এমনভাবে ছোটা যাবে না যাতে আমাদের সব চিন্তা, সব কাজ দুনিয়াকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। দুটোর মধ্যে ব্যালেন্স করতে হবে। এটুকুতে কোন সমস্যা নেই। এটুকু সবাই মানে। তবে দ্বীন ও দুনিয়ার মাঝে সমন্বয় এর তত্ত্ব আমরা যেভাবে আজকাল বাস্তবায়ন করছি সেখানে মনে হয় সমস্যা থেকে যাচ্ছে। বিষয়টাকে আজ যতোটা সহজে আমরা অ্যাপ্রোচ করছি, আদতে হয়তো সেটা অতোটা সহজ না।

দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে ব্যালেন্স সবচেয়ে সুন্দরভাবে করেছিলেন সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম। তাঁদের জন্যও একাজটা খুব একটা সহজ ছিল না। মদীনাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দারসে বসার জন্য সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম স্পেশাল রুটিন বানাতেন। দুজন সাহাবী মিলে ঠিক করে নিতেন, একজন সকালে দারসে বসবেন আর কাজ করবেন বিকেলে। আরেকজন সকালে কাজ করবেন আর বিকেলের দারসে থাকবেন। এভাবে যার যেটা মিস হবে অপর জনের কাছ থেকে তিনি সেটা জেনে নেবেন।

অধিকাংশ সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম তেমন একটা ধনী ছিলেন না। তবু দ্বীনের জন্য তাঁরা নিজেদের অফিস আওয়ার বদলে নিতেন। নিজেদের ডেইলি রুটিন পালটে ফেলতেন। যে সময়টুকু কাজ করলে উপার্জন বাড়ানো যেতো, নিজের পরিবারের স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং উঁচু করা যেতো, তাঁরা সেটা ব্যয় করতেন দ্বীনের জন্যে। এটা ছিল সাধারন রুটিন। যখন প্রয়োজন দেখা দিত তখন এটাও পালটে যেতো পুরোপুরি। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ আসলে অন্য সব কাজ ছেড়ে সেটাতেই মনোযোগী হতেন তাঁরা। রাসূলুল্লাহ যখন কোন জিহাদের অভিযানে বের হবার নির্দেশ দিতেন, তখন বাকি সবকিছুকে স্ট্যান্ডবাই রেখে বেরিয়ে পড়তেন সাহাবীগণ। রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন।

ইসলাম ছিল তাঁদের প্রায়োরিটি লিস্টের এক নাম্বারে। প্রথমে ইসলাম ঠিক রেখে তারপর বাকি সবকিছু। নিজের ঘর, চাকরি, ব্যবসা, সমাজ – যেখানে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু ছিল, সেটা মুহূর্তের মধ্যে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। প্রস্তুত ছিলেন ইসলামের জন্য যেকোন সময় যেকোন আত্মত্যাগের জন্যে। ইসলাম ছিল তাঁদের জন্য প্রথম। বাকি সব কিছু অনেক দূরবর্তী এক দ্বিতীয় অবস্থানে।

আজ আমরাও ইসলাম পালন করার কথা বলি। দ্বীন ও দুনিয়া ব্যালেন্স করার শিক্ষাও আজ অনেকভাবে দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের সাথে সোনালী প্রজন্মের তফাৎ হল, আমাদের প্রায়োরিটি লিস্টের প্রথম জায়গাটা দখল করে রাখে দুনিয়া। আল্লাহ্‌ আযযা ওয়া জাল আমাদের সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। রাসূলগণকে (আলাইহিমুস সালাম) তিনি পাঠিয়েছেন তাগুত বর্জন ও এক আল্লাহর ইবাদতের শিক্ষা দেয়ার জন্য। কথাটা স্পষ্টভাবে কুরআনে বলা আছে। দ্বীন ও দুনিয়ার ব্যালেন্স করতে হলে এই মৌলিক ভিত্তিগুলোর ওপরেই তো হতে হবে। ইসলামের সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম এভাবেই বুঝেছিলেন, এভাবেই সাজিয়েছিলেন নিজেদের জীবন। দুনিয়ার পেছনে অতোটুক সময় দিয়েছেন যেটুকু না দিলেই না, আর ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন নিজেদের জীবন। এভাবেই তাঁরা ব্যালেন্স করেছিলেন দ্বীন ও দুনিয়ার। দুনিয়ার পেছনে সময় দেয়ার অংশটা ছিল পার্টটাইম কাজ, আর দ্বীন তাঁদের জন্য ফুল টাইম জব।

কিন্তু আমরা দ্বীন ও দুনিয়া ব্যালেন্স বলতে বুঝি আমার উপার্জন, সম্পদ, স্ট্যাটাস – সবকিছু যেভাবে যেমন আছে, সেভাবেই রেখে আমার জায়গা থেকে যতোটুকু পারা যায় ততোটুকু ইসলাম আমি পালন করবো। ইসলামের জন্য আসলে কাজ করতে হলে, যেভাবে সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম করেছেন, সেই অর্থে কাজ করতে হলে যে নিজের জীবনের অনেক ভোগবিলাস, আনন্দ, অবসর ত্যাগ করতে হবে, এটা আমরা মানতে চাইনা, বা মনে রাখতে চাইনা। যে যান্ত্রিক, অতৃপ্ত বস্তুবাদী প্রতিযোগিতার মধ্যে আমরা এখন দিন কাটাই, এটার মধ্যে ডুবে থেকে আসলে কতোটা ইসলাম পালন করা যায়, সেটা নিয়ে আমরা ভাবি না হয়তো। আমি আসলেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কী করছি, আখিরাতের জন্য কী প্রস্তুত করছি, এ চিন্তাগুলো আমরা চাপা দিয়ে রাখি। এই অবস্থা নিয়ে আমরা যে ব্যালেন্সটা করি সেটা দ্বীন আর দুনিয়ার মধ্যে ব্যালেন্স? নাকি নিজের অপরাধবোধকে আত্মতৃপ্তিতে পরিণত করার জন্য আত্মপ্রতারণা আর হিসেবী অপব্যাখ্যার ব্যালেন্স, সেটা হয়তো আমরা চিন্তা করি না। কিছু চিন্তা দূরে ঠেলে রাখাই সুবিধাজনক।