তিন জনের সংসারে চার বছরের ছোট্ট খুকিটা যথেষ্ট মনোযোগ পায় না। বাবা অফিস থেকে বাসায় ফেরে সন্ধ্যার পর। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে পড়ে থাকে সোফায়। মা সারাদিন ব্যস্ত ঘরের যুদ্ধে। খুকীর জন্য বরাদ্দ সময়ে থাবা বাসায় মধ্যবিত্ত জীবনের কাজ আর কষ্ট। সাথে নিয়ে আসে রাগ আর বিরক্তি। কতোক্ষণ খুকীর অন্তহীন প্রশ্নের জবাব দেয়া যায়? তাল মেলানো যায় নিত্যনতুন পাগলামির সাথে? ওদিকে শব্দটার অর্থ এখনো না বুঝলেও, খুকী ভেতরে ভেতরে অবহেলা টের পায়। অবহেলার চেয়ে বেশি টের পায় একঘেয়েমি। কতোক্ষণ আর নিজের মনে খেলা যায়? সময় কাটানো যায়?
পাশের বাসার সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দেয়া কিশোর যখন খুকিকে নিয়ে খেলে তখন দু পক্ষই খুশি হয়। ওরা দুজন মিলে ঝাপিয়ে পড়ে সিড়িঘরের অদৃশ্য কোন বাহিনীর সাথে যুদ্ধে। অথবা গল্প করে রাস্তায় চিন্তিত মুখে ঘুরে বেড়ানো নেড়িকুকুর আর বিদ্যুতের তারে ভাবগাম্ভীর্যের সাথে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো কাকগুলোর পারিবারিক ইতিহাস আর নাড়িনক্ষত্র নিয়ে। মা-বাবা হাফ ছেড়ে বাঁচে। খুকী খুশি। খুকীর নতুন বন্ধুর জন্য সামনের দরজাটা দিনের অনেকটা সময় জুড়ে এখন খোলাই থাকে।
পরিবারের খুশির কারণ হওয়া সেই কিশোর একদিন খাবার টেবিল থেকে খুকীকে উঠিয়ে নিয়ে যায় পাশের আন্ডারকন্সট্রাকশান বিল্ডিং এ। মুখে গামছা গুঁজে দিয়ে ছোট্ট দেহটাকে ধর্ষন করে। বেশ কয়েক বার। তারপর বড়সর একটা ইট নিয়ে খুব হিসেব করে খুকীর খুলিটা ধসিয়ে দেয়। শিস দিতে দিতে বের হয়ে আসে চাপা উত্তেজনা নিয়ে। এক সপ্তাহের জন্য ঘুরতে চলে যায় বন্ধুদের সাথে কক্সবাজারে। চার বছরের ছোট্ট মেয়েটা থেতলানো মাথা, রক্তাক্ত ফ্রক আর এক বুক ভয় আর অভিমান নিয়ে নিথর পড়ে থাকে আন্ডারকন্সট্রাকশান বিল্ডিং এর এক কোনায়….
ওপরের গল্পটা কাল্পনিক। আবার পুরোপুরি কাল্পনিক না। এমন অনেক বাস্তব ঘটনা আমাদের এই দেশটাতে ঘটেছে। খবরের লিঙ্ক, রেফারেন্স দিয়ে এখানে প্রমাণ করার দরকার নেই। কারণ আমরা জানি এমন ঘটনা ঘটেছে। এমন ঘটনাগুলোর পর আমরা লজ্জাবোধ করি, ঘৃণা অনুভব করি। বোধহয় সবচেয়ে বেশি অনুভব করি ক্রোধ আর দুঃখ। আমরা প্রায় সবাই এক বাক্যে স্বীকার করি এই ছেলেটার মতো মানুষগুলোকে হত্যা করা উচিৎ। আমরা অনেকে হত্যার অভিনব অনেক পদ্ধতি নিয়ে হাজির হই। এমন মানুষগুলোকে শাস্তি পেতে দেখলে আমরা আনন্দিত হই। আদর্শিকভাবে যারা মৃত্যুদন্ডের বিরোধী, তারা ছাড়া বাকি সবার ক্ষেত্রে এ কথাগুলো প্রযোজ্য।
কেন মানুষ হয়ে আমরা আরেকটা মানুষের মৃত্যু কামনা করি?
প্রত্যেকটা মানুষের একটা থ্রেশহোল্ড, একটা সীমানা থাকে। সেই সীমানা লঙ্ঘিত হলে কসে অপরাধীর জন্য শাস্তি চায়। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী বাড়ে শাস্তির মাত্রা। আমাদের সবার হিসেবেই এমন কোন না কোন অপরাধী আছে যাদের মৃত্যুতে আমরা খুশি হবো। কেউ রাজাকার মারা গেলে আনন্দিত হয়, কেউ ‘ছাগু’ মারা গেলে, কেউ পাকিস্তানী মারা গেলে।কারো জন্য শ্রেণীটা হল ধর্ষক, কিংবা শিশু ধর্ষক। কারো জন্য মৃত্যুপযোগী শ্রেণীটা হল শাহবাগী, কারো জন্য ‘ধরে ধরে জবাই করা’র স্লোগান দেয়া সংগঠন। অনেকে আবার মাদক ব্যবসায়ী কিংবা সন্ত্রাসীরা মারা গেলে শুধু খুশি হন না বরং তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে হত্যা চালিয়ে যাওয়ার জন্য জোর দাবিও জানান।
কিন্তু এই আমরাই আবার কাফিরদের শাস্তি চাইতে পারি না। তাদের বিপর্যয়ে আনন্দিত হওয়াকে মেনে নিতে পারি না। তৌবা ! তৌবা! এটা কিভাবে সম্ভব?
অথচ ওপরে যতোগুলো অপরাধের কথা বললাম, যতোগুলো সীমালঙ্গনের কথা বললাম তার চেয়ে বড় অপরাধ হল শিরক এবং কুফর। খুন, ধর্ষন, রাজনৈতিক বিরোধ, গণহত্যা, কিংবা অন্য কোন অপরাধ কুফর কিংবা শিরকের মতো গুরুতর না। এই সবগুলো অপরাধ আল্লাহ্ ক্ষমা করে দেবেন কিন্তু শিরক আল্লাহ্ ক্ষমা করবেন না। দুনিয়ার বুকে শ্রেষ্ঠ কাফির দিনশেষে নির্দোষ না। তার কুফরের কারণে সে দোষী। সবচেয়ে অপরাধ হল আল্লাহ্র একত্বকে অস্বীকার করা, তার সাথে শিরক করা। আমাদের মাথায় না ঢুকলেও এটা সত্য, কারণ এটা আল্লাহর কথা। এটা আমার কথা না আল্লাহ্র কথা। পৃথিবীর বুকে এমন কোন মুসলিম নেই যে এ কথা অস্বীকার করতে পারবে।
ছোট অপরাধী শাস্তি পেলে আমি খুশি হই, কিন্তু বড় অপরাধী শাস্তি পেলে খুশি হওয়া যাবে না?
কেন? এটা কেমন কথা? এর পেছনে যুক্তি কী?
কাফিরদের বিরুদ্ধে শাস্তির জন্য দুআ করা যাবে। আল্লাহ্র রাসূল ﷺ করেছেন। আলিমগণ বলেছেন এমন দুআ করা ইবাদতের অংশ। আমরাই মিশর কিংবা ফিলিস্তিনে তারাবীতে করা এমন দুআর ভিডিও শেয়ার দিয়ে প্রত্যেক রমাদ্বানে আবেগঘন স্ট্যাটাস দেই তাই না?
তো শাস্তির জন্য দুআ করা যাবে কিন্তু শাস্তি হতে দেখলে খুশি হওয়া যাবে না?
এই অসংলগ্ন চিন্তার ভিত্তি কী?
সমস্যা হল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। মানদন্ডে। আমাদের সংজ্ঞায়নে। রাইচাস অ্যাঙ্গার; ন্যায়নিষ্ঠ ক্রোধ – যৌক্তিক। এটা সবার মাঝেই থাকে। প্রশ্ন হল ন্যায়নিষ্ঠতার সঠিক সংজ্ঞা নিয়ে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি এক না। কুফর আর শিরক যে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ, এর ভিত্তিতেই ন্যায়অন্যায়ের মানদন্ড ঠিক করতে হবে - এটা আমরা মানতে পারি না। অনেকে মুখে স্বীকার করি, কিন্তু মন মানে না। মানে না দেখেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে দশকের পর দশক যুদ্ধ করা, যুলুম করা কাফিরের ওপর বিপর্যয়ে আনন্দিত হওয়াকে আমাদের গুরুতর কিছু একটা মনে হয়। আমরা ধর্ষক, খুনী কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মৃত্যুকে ইনসাফ মনে করতে পারি, কিন্তু কাফিরের ক্ষেত্রে পারি না। কারণ আমরা কাফিরের অপরাধকে অপরাধ মনে করি না।
সেই সাথে আমরা বিশ্বের মুসলিমদের নিজেদের অংশ মনে করি না। যদিও মুখে বলি। আমার সমাজে একটা মেয়ে ধর্ষিত হলে আমরা বীরদর্পে ধর্ষককে নানান ভাবে টর্চার করে মারার কথা বলি। কিন্তু যে জাতিগুলো আক্ষরিকভাবে কোটি কোটি মুসলিমদের হত্যার জন্য দায়ী তারা আমাদের কাছে নির্দোষ। নিজের পরিবারের সাথে হওয়া ছোট থেকে ছোট অপরাধ সারা জীবন মনে রেখে দেই আমরা। কিন্তু যারা লক্ষ মুসলিম শিশু হত্যার জন্য দায়ী, মুসলিম নারীর ধর্ষনের জন্য দায়ী তাদের প্রতি কাঁচুমাচু শ্রদ্ধা আর গোলামির ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু আমাদের রোচে না। ওরা আফগানিস্তানের মুসলিম মেরেছে, ইরাকে মেরেছে, পাকিস্তানে মেরেছে, সিরিয়াতে মেরেছে, মালিতে মেরেছে, সুদানে মেরেছে তাতে আমার কী? আমি তো বাংলাদেশের মুসলিম। কিংবা বেটার ইয়েট, আমি তো পশ্চিমে সম্মানের সাথে আছি। পশ্চিম আমাকে এমন জীবন দিয়েছে যা মুসলিম ভূখণ্ডগুলো আমাকে দিতে পারেনি। আমি কেন তাদের খারাপ চাইবো?
দিনশেষে আমার আনুগত্য আর শত্রুতার মাপকাঠি হলো নেইশান-স্টেইটের সীমান্ত, অথবা আমার ব্যক্তিগত ভালোলাগা, অথবা সমাজের ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ, কিংবা সোজসাপ্টা আত্মকেন্দ্রিকতা, ব্যক্তিস্বার্থ আর সুবিধাবাদ। আমি অপরাধ মাপি হার্ম প্রিন্সিপালের মানদন্ডে আর রাহমাহ এর বুঝ নেই ইউনিভার্সাল ডিক্লারেইশান অফ হিউম্যান রাইটস থেকে। আর আমি যেহেতু আমছালা দুটোই চাই, তাই আমি আমার অসংলগ্ন যুক্তিবিন্যাসে এই ভালোলাগাকেই সবচেয়ে সুক্ষ, পরিশীলিত ধার্মিকতা হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাবো। কারণ আমি আধুনিক মুসলিম। বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেসেন্টেবল মুযলিম। আমি গ্রহণযোগ্য, উপস্থাপনযোগ্য, ওদের টেবিলে ওদের সাথে বসার জন্য একটা চেয়ার পাওয়ার যোগ্য মুযলিম হতে চাই। তাই আমি জোড়াতালি দিয়ে মুখোশ বানাই। ওদের চিন্তা, ওদের মানবতা, ওদের নৈতিকতা কপিপেইস্ট করি। তারপর উত্তর মেলানোর হিসেব কষে আমার কপিপেইস্টকে ‘শরীয়াহসম্মত’ বানাই।
আমি আধুনিক মুসলিম, আল্লাহ্, রাসূল ﷺ আর উম্মাহ ছাড়া বাকি সবার কাছে দায়বদ্ধ।